বাংলায় একটি কথা আছে, “মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে।” অর্থাৎ জীবনে দুঃখ দেখে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ দুঃসময়ের পরেই আসবে সুসময়। তবে এই পৃথিবীতে সবার ক্ষেত্রে এই কথাটা খাটে না। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা ভাগ্যের গ্যাঁড়াকলে পিষ্ট হয়ে সারাটা জীবন শুধু দুঃখই পেয়ে যান, সুখ তাদের কাছে বহুদূরের এক মরীচিকা হিসেবেই থেকে যায়। এমনই এক চিরদুঃখী মানুষকে নিয়ে প্রখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগো রচনা করেন সর্বকালের অন্যতম সেরা উপন্যাস, নাম ‘লা মিজারেবল’।
পুরো উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে জাঁ ভালজাঁর জীবন কাহিনীকে ঘিরে। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে বড় বোনের সংসারে মানুষ হতে হয়েছিলো তাকে। তবে সাত সন্তানকে নিয়ে তার বোনও ছিল অথৈ সাগরে। তাই সেখানেও অভাবের যাতনা লেগেই ছিল। জাঁ ভালজাঁ যখন ২৫ বছরের যুবক তখন আচমকা তার ভগ্নীপতি মারা গেলেন। দুর্দিনে আশ্রয় দেওয়া বোনের সংসার চালানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলো সে।
সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে এত বড় সংসার চালিয়ে নিচ্ছিলো জাঁ ভালজাঁ। তবে এক শীতে কাজ না পেয়ে দারুণ অর্থাভাবে পড়ে গেলো সে। শেষপর্যন্ত সাতটি ছোট্ট শিশুকে ক্ষুধার জ্বালা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে সে রুটি চুরি করলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ধরা পড়ে গেলো সে, তার সমস্ত কাকুতিমিনতি উপেক্ষা করে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
এমন বিচারে সমাজের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এলো জাঁ ভালজাঁর মনে। এই সমাজ গরীবকে কাজ দিতে পারে না, ক্ষুধার্তকে অন্ন দেয় না, কিন্তু নিতান্ত পেটের দায়ে যদি চুরি করে, তাকে নির্মম শাস্তি দিতে মুহূর্ত দেরি করে না। সাজা মেনে নিতে না পেরে বারবার পালাতে লাগলো জাঁ ভালজাঁ, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতিবারই ধরা পড়ে গেলো। আর প্রতিবার ধরা পড়ার সাথে তার সাজার মেয়াদও বাড়তে লাগলো। শেষপর্যন্ত পাঁচ বছরের সাজা খাটতে এসে সে বের হলো উনিশ বছরের সাজা খেটে!
৪৬ বছরের প্রৌঢ় ভালজাঁ জেল থেকে বের হয়েও শান্তি পেলো না, ‘পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়’ এই কথাটা সেই সময়ের ফরাসি সমাজ ভুলেই গেছিলো। সব জায়গায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে ভালজাঁ যখন হতাশ হয়ে পড়েছিলো, তখন তার জীবনে আশার প্রদীপ হয়ে আসেন বিশপ মিরিয়েল। তার কাছ থেকে পাওয়া সাহায্য নিয়ে অলঙ্কারের ব্যবসা করে অল্প সময়ে ধনী হয়ে যায় জাঁ ভালজাঁ।
কিন্তু শুরুতেই বললাম, কিছু মানুষের জন্মই যেন হয় শুধু কষ্ট পাওয়ার জন্য, এক মিথ্যা মামলায় আবারো আদালতে যেতে হয় জাঁ ভালজাঁকে, সেখানে তাকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এই সাজা আর মেনে নিতে পারলো না সে, পালিয়ে গেলো জেল থেকে। পরিচয় আত্মগোপন করে কোজেত নামের এক এতিম মেয়েকে নিজের মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করে নতুনভাবে জীবন শুরু করে সে।
আপনজনকে কাছে পাওয়ার সুযোগ ভাঁলজা কখনোই পায়নি। তাই কোজেতকে নিজের মেয়ে হিসেবে পেয়ে যেন নতুন এক জগত খুলে যায় তার কাছে। কিন্তু সেই কোজেতও মারিয়াস নামক এক যুবককে বিয়ে করে অন্য ঘরে চলে যায়। মেয়ে দূরে চলে যাওয়ায় এমনিতেই খুব কষ্ট পেয়েছিলো সে, এরপর মারিয়াসও যখন তাকে ভুল বোঝে তখন সে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। বুকভরা কষ্ট নিয়ে পৃথিবীকে বিদায় জানানোর অপেক্ষায় জাঁ ভালজাঁ। শেষ সময়ে কি কোজেত আর মারিয়াসের দেখা সে পাবে? নাকি সারাজীবনের মতো শেষটাও হবে কষ্টের, প্রিয় মানুষের দেখা না পেয়েই কি তবে বিদায় নেবে সে?
অসাধারণ এই উপন্যাস পড়তে গেলে চোখের পানি ধরে রাখাটা মুশকিল। বিশাল এই উপন্যাসে শুধু জাঁ ভালজাঁর গল্প নয়, আরো অনেকগুলো চরিত্রের আবির্ভাব হয়েছে, সবগুলো চরিত্রই গল্পকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রেখেছে।
জাঁ ভালজাঁ
ফ্লবার্টের ম্যাডাম বভারি, মেলভিলের ক্যাপ্টেন আহাব কিংবা ডিকেন্সের ম্যাগউইচের মতো লা মিজারেবলের কেন্দ্রীয় চরিত্র জাঁ ভালজাঁও বিশ্ব সাহিত্যের চিরস্মরণীয় চরিত্র। গল্পের শুরু থেকে একদম শেষ দৃশ্য পর্যন্ত জাঁ ভালজাঁর জীবন সংগ্রামের কাহিনীই বর্ণিত হয়েছে। বোনের সন্তানদের প্রতি তার মমত্ববোধ কিংবা কোজেতের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা চরিত্রটির দায়িত্ববোধের প্রমাণ দেয়। কোজেতের চলে যাওয়াটা মনে বিশাল দাগ সৃষ্টি করলেও তার ভালোর কথা ভেবে তাকে মারিয়াসের হাতে তুলে দেওয়াটা স্বার্থত্যাগের প্রমাণ দেয়।
নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মারিয়াসকে বাঁচানোটা চরিত্রটির সাহসিকতার প্রমাণ দেয়। যাবজ্জীবন শাস্তির কথা জেনেও জ্যাভারের প্রাণ বাঁচানো তার মহানুভবতার প্রমাণ দেয়। আর নিজের জীবনের সমস্ত সঞ্চয় কোজেতকে দিয়ে দেওয়াটা তার নির্লোভ চরিত্রটির কথা বলে দেয়। সব মিলিয়ে চরিত্রটির মহত্ত্ব সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। আর এ কারণেই হয়তো জাঁ ভালজাঁর জীবনের প্রতিটি কষ্টে পাঠক এতটা ব্যথিত হয়েছে।
কোজেত
জাঁ ভালজাঁর পালক কন্যা কোজেত এই গল্পের নায়িকা। এই চরিত্রটি অনেকটা পানির মতো, যেখানে গিয়েছে সেখানেই মানিয়ে নিয়েছে। থেনারডিয়েরের পরিবারে কাজের মেয়ে হিসেবে দিন পার করার সময়েও তার কোনো অভিযোগ ছিল না, আবার ভালজাঁর কন্যা হিসেবে জীবন শুরু করার পর তার কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও সে কখনো দ্বিমত করেনি। এ কারণেই মারিয়াসকে প্রচণ্ড ভালোবাসা সত্ত্বেও বাবার নিষেধ অমান্য করে সে প্রেমিকের কাছে সবকিছু ছেড়ে চলে যায়নি। আবার বাবার অনুমতিতে যখন সে মারিয়াসকে বিয়ে করলো, তখন তার জীবন যেন শুধু মারিয়াস কেন্দ্রিক হয়ে গেলো। এ কারণেই দীর্ঘদিন জাঁ ভালজাঁ তার কাছে আসছে না দেখেও সে নিজে বাবার কাছে ছুটে যায়নি। কোজেত আরেকটু সক্রিয় হলে হয়তো শেষ বয়সে জাঁ ভালজাঁকে এত কষ্ট পেতে হতো না।
মারিয়াস
গল্পের নায়ক মারিয়াসকে পুরো উপন্যাসে আদর্শ প্রেমিক হিসেবে দেখা গেছে। ভালোবাসার মানুষ কোজেতকে কাছে পেতে নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করে শুধু তার পিছনেই ছুটেছে। কোজেতকে পাওয়ার আশা যখন শূন্যের ঘরে চলে যায় তখন বিবাগী প্রেমিক হিসেবে যুদ্ধে চলে গিয়েছে। তবে মারিয়াসকে বেশ হঠকারী চরিত্র মনে হয়েছে। জাঁ ভালজাঁর ব্যাপারে ভালোমতো খোঁজ না নিয়েই তার কাছ থেকে কোজেতকে দূরে সরানোটা হঠকারিতারই লক্ষণ। আরেকটু ভেবেচিন্তে কাজ করলে তার জীবনের অনেক জটিলতাই এড়ানো যেতো।
জ্যাভার
শতভাগ সৎ পুলিশ অফিসারের আদর্শ উদাহরণ ইন্সপেক্টর জ্যাভার। তার কাছে পুরো পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত। একভাগে সাধারণ মানুষ আর অন্যভাগে অপরাধীরা। সে বিশ্বাস করে, অপরাধী মানেই বিদ্রোহী, তাদের কোনো ভালো গুণ থাকতে পারে না। সে কারণেই বহু ভালো কাজ করা সত্ত্বেও সামান্য এক অপরাধের কারণে সে জাঁ ভালজাঁকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করে। কিন্তু তার এই ঘৃণা কিংবা শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জাঁ ভালজাঁ যখন তার প্রাণ বাঁচায় তখন তার সেই বিশ্বাসে যেন বিশাল এক ধাক্কা লাগে। সততা অবশ্যই মহৎ গুণ, তবে শুধু সততার চশমায় চোখ ঢেকে রাখলে ফলাফল ঠিক কতটা নেতিবাচক হতে পারে তার আদর্শ উদাহরণ জ্যাভার।
এছাড়াও বিশপ মিরিয়েল, থেনারদিয়ের, ফাঁতিন, এপোনাইনসহ প্রচুর চরিত্রের উপস্থিতি, তাদের বিশ্বাস, বেঁচে থাকার সংগ্রাম সব মিলিয়ে উপন্যাসটির কাহিনী এগিয়ে গেছে।
সেসময়ের ফ্রান্সে লঘু পাপে গুরু দণ্ড দেওয়ার যে প্রচলন ছিল সেটার ফলাফল যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে এই উপন্যাসে সেটাই অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন ভিক্টর হুগো। ১৮৬২ সালে বেলজিয়াম থেকে এক যোগে ৯টি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ‘লা মিজারেবল’। এর প্রথম প্যারিস সংস্করণ মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ফুরিয়ে গিয়েছিলো। তুমুল জনপ্রিয়তার সাথে এই উপন্যাসটি সমালোচকদের মনও জয় করেছিলো।
এই উপন্যাস পড়ে বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি আলফ্রেড টেনিসন হুগোকে ‘লর্ড অফ হিউম্যান টিয়ার্স’ আখ্যা দিয়েছিলেন, জর্জ মেরেডিথের মতে, এটি ছিল সেই শতাব্দীর সেরা উপন্যাস। মিল্টন তো এই উপন্যাসকে পবিত্র বাইবেলের সাথেই তুলনা করেছিলেন! এটি ভিক্টর হুগোর সেরা শিল্পকর্ম এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের তালিকা করা হলে সেখানে সগৌরবে স্থান করে নেবে ‘লা মিজারেবল’।