“তারা এই খেলার উপরে, আরো বড় এক খেলা খেলছে। এই খেলা তাদের বড় সেই খেলার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।”
দীর্ঘদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে হতাশা আর বিষাদমাখা সুরে রে বার্ক’কে একথা বলছেন স্পেন্স। এবং স্পেন্সের ভাষ্যনুযায়ী, বাস্কেটবল যদি সেই খেলা হয়, তাহলে উপরের বড় খেলাটি হচ্ছে এন.বি.এ (ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশন)। ‘হাই ফ্লাইং বার্ড’ সিনেমাটি খেলা নিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং খেলাকে ব্যবসায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা একবার বন্ধ হয়ে গেলে, বাস্কেটবল খেলার সামগ্রিক চিত্র কেমন হবে, তার অনুসন্ধান করে। আর তেমনটি করতে নির্দিষ্ট কোনো দলের নাম নিয়ে কিংবা ভেতরকার তথ্য ফাঁস না করে অত্যন্ত সঙ্গোপনে অনুসন্ধান চালিয়েছে ‘হাই ফ্লাইং বার্ড’, যেন বোর্ডরুমে নির্বাহীদের মধ্যকার গোপনীয় কথা দরজায় আড়ি পেতে শুনছে, আর ফাঁক দিয়ে চোখের দৃষ্টি যথাসম্ভব সরু করে দেখছে ভেতরের পরিস্থিতি।
‘ডেট্রয়েট পিস্টন্স’ বাস্কেটবল দলের খেলোয়াড় রেজি জ্যাকসনের সাক্ষাৎকার দিয়েই শুরু হয় সিনেমা। এরপর বিভিন্ন সময়ে বাস্তবের তিনজন বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের সাক্ষাৎকার সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে করে বাস্কেটবল খেলার ভেতরকার চিত্র সম্বন্ধে দর্শক ধারণা পায়। সাক্ষাৎকারের পরপরই দর্শককে নিয়ে যাওয়া হয় ম্যানহাটনের জাঁকজমকপূর্ণ এক রেস্তোরাঁয়, যেখানে এজেন্ট রে, মক্কেল এরিককে তাদের প্রতিষ্ঠানের এই তালাবন্দির সময়টায় অতিরিক্ত যেকোনো ঋণ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছে। এ কথার ফাঁকেই রে জানতে পারে, তার ক্রেডিট কার্ড প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অচল করে দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠান যতদিন খেলা থেকে বহিষ্কৃত থাকছে, ততদিনে রে’র ব্যাংক ব্যালেন্স ধীরে ধীরে নিম্নমুখী হবে। তাই রে’র নিজ প্রয়োজনেই এবার এ তালাবদ্ধ অবস্থা উঠিয়ে নিতে হবে।
কিন্তু, খেলোয়াড় সংঘের রিপ্রেজেন্টেটিভ মায়রা, দল অধিপতিদের খেলা নিয়ে কূট-কৌশল দেখে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে বাস্কেটবলের উপর থেকে। তাই রে’কে কোনোরকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে নারাজ সে। এর মাঝে আবার সিনেমার গল্প জটিল করতে, দুই বাস্কেটবল খেলোয়াড় নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করে গোটা বিষয়টিকে নগ্ন করে তোলে।
নতুন নতুন সিনেমা দিয়ে নিয়মিত প্রথা ভেঙে চলা এবং নিরীক্ষা করা স্বাধীনচেতা পরিচালক স্টিভেন সোডারবার্রগে আইফোনে ধারণ করা দ্বিতীয় সিনেমা এটি। ২০১৮ সালের ‘আনসেইন’ সিনেমাটি তিনি আইফোন-৬ দিয়ে ধারণ করেছিলেন এবং ‘হাই ফ্লাইং বার্ড’ শ্যুট করা হয়েছে আইফোন-৮ দিয়ে। বড় ক্যামেরা দিয়ে শ্যুট করার মাঝে যে সিনেম্যাটিক জেল্লা আছে, তা স্বভাবতই অনেকখানি পাওয়া যাবে না আইফোনের মতো ছোট ক্যামেরাগুলোয়। তবে আয়তনে ছোট হওয়ায় খুব সহজে এটি সেট করা যায়, বহন করা যায়। এ সুবিধারই সর্বোচ্চ ব্যবহার সোডারবার্গ করে নিয়েছেন। একটি কাল্পনিক এন.বি.এ. লকআউট অবস্থায় এজেন্টদের মধ্যকার ফিসফাস, নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাঝে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, দলমালিকদের মধ্যে উত্তেজিত কণ্ঠের গোপন মৈত্রী বা বিরোধিতার আলাপচারিতাগুলো কান খাড়া করে শোনার ও উঁকি মেরে দেখার ক্ষেত্রে ‘আইফোন’ আদর্শ ডিভাইস। কারণ অবশ্যই তার ক্ষুদ্রাকৃতি।
সোডারবার্গের আনসেইন, একটি মানসিক হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে দর্শকদের ক্লস্ট্রোফোবিক অভিজ্ঞতা জাগাতে আইফোনের ব্যবহার করেছিল। সেদিক থেকে এ সিনেমা তুলনামূলক চটপটে। ‘হাই ফ্লাইং বার্ড’ তার কাল্পনিক লকডাউনের মধ্য দিয়ে, পেশাদার খেলোয়াড়রা যদি নিজেদের ক্যারিয়ার নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় আর ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে ভেতরের তথ্যাবলি ফাঁস করে দেয়, তবে কী ঘটবে এবং পরিস্থিতি কেমন হবে (?) সে চিত্র উপস্থাপন করেছে। প্রচলিত ধারণায়, স্পোর্টস জনরার সিনেমা এটি নয়। ‘হাই ফ্লাইং বার্ড’ বাস্কেটবল খেলার শক্তির জায়গাটিকে অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করেছে একবিংশ শতাব্দীর পুঁজিবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে তেড়ে উঠতে এবং শ্রমবাদী মানুষের গল্প বলতে।
‘মুনলাইট’ সিনেমার চিত্রনাট্য দিয়ে অস্কার জেতা ম্যাককার্নির এই চিত্রনাট্য খুবই লেয়ারড এবং তীক্ষ্ণ। এন.বি.এ. তার খেলোয়াড়দের কীভাবে দেখে বা তাদের জন্য কী করে বা করেছে, সে সম্পর্কিত দর্শকদের পূর্বকল্পিত সকল ধারণাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ছুঁড়ে দেয় ম্যাককার্নির চিত্রনাট্য। খেলোয়াড়দের মনস্তত্ত্ব ও ক্রীড়াঙ্গনের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকতে কতটা গভীর জানাশোনা ম্যাককার্নিকে রাখতে হয়েছে, তার সংলাপগুলোতেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবে কাঠখোট্টা বিষয়গুলোতে এক-আধটু রসবোধযুক্ত করতে ভোলেননি ম্যাককার্নি।
এ চিত্রনাট্য লেখার দিক থেকে যেমন কাব্যিক সূরের মূর্ছনা যোগ করেছে, তেমনি আকৃতিগত দিক থেকে হয়ে উঠেছে সর্পিল। ম্যাককার্নির এই চিত্রনাট্য ভিজ্যুয়ালে রূপ দেওয়াও রীতিমতো চ্যালেঞ্জের বিষয়। কিন্তু তার শৈল্পিক শব্দবাহুল্যে ভরা চিত্রনাট্যকে মানবিক রূপ দিয়ে সোডারবার্গ এবং অভিনয়শিল্পীরা সে চ্যালেঞ্জ সাদরে গ্রহণ করেছেন।
‘পিটার এন্ড্রুস’ ছদ্মনামে স্টিভেন সোডারবার্গ নিজেই সিনেমাটোগ্রাফারের দায়িত্ব পালন করেছেন বরাবরের মতো। পকেট সাইজ ক্যামেরার ছোট ফ্রেমে ১৮০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে ধীরে চলা, হঠাৎ বাঁকবদল করা, মিড ক্লোজ শট, রিভার্স শট কিংবা সোডারবার্গ তার প্রিয় ওভারহেড শটে অকপটতার এক আবহ তৈরি করেছেন। আইফোনের ‘ফিশ-আই’ লেন্সে ব্যাকগ্রাউন্ডকে খাটো রেখে, চরিত্রদেরকেই প্রভাবশালী হয়ে উঠতে দিয়েছেন সোডারবার্গ। স্পেস হতে স্পেসে ঘুরে ঘুরে অস্থিরচিত্ত একটা অনুভূতি জাগানোর পাশাপাশি আইফোনের অধারাবাহিকতার মাঝেও লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যকে দৃষ্টিগোচর করে তুলেছেন সোডারবার্গ। আর এই যন্ত্রটির উপর তার পূর্ণ দখলের কথাও নিশ্চিত করেছেন। আইফোনের ছোট্ট চোখ যেকোনো জায়গায় সহজে ঢুকে পড়তে পারে এবং সে স্বাধীনতা সোডারবার্গ দিয়েছেন। সিনেমার শান্ত নীল এবং ভয়াল লাল রঙ পেশাদারী খেলার অভ্যন্তরীণ পদ্ধতির রূপের বিভিন্নতাকে নির্দেশ করে। সিনেমার প্রোডাকশন ডিজাইনে একটা বিচ্ছিন্ন ভাব জড়িয়ে আছে, যা চরিত্রদের জগতটাকেই নির্দেশ করে।
ম্যারি অ্যান বারনার্ড ছদ্মনামে সম্পাদনার কাজটিও সোডারবার্গ নিজে করেছেন, যেমনটি তিনি করে থাকেন সবসময়। দুই বাস্কেটবল খেলোয়াড় এরিক এবং জামেরোর মুখোমুখি হওয়ার দৃশ্যেই তিনি একটি চমৎকার কাট দিয়ে গোটা সিনেমার দ্বিখণ্ডিত প্রকৃতিকে স্পষ্ট করে তোলেন। আরেকটি দৃশ্যে; এরিক এবং জামেরো মুখোমুখি খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, বাচ্চারা হৈচৈ করে তাদের উৎসাহ দিচ্ছে- সেখান থেকে জাম্প কাট করে শান্ত, ধূসর সিলহ্যয়েট শটে একটি প্লেনের আকাশ ভেদ করে উড়ে যাওয়ার দৃশ্যে সোডারবার্গ এই খেলা নিয়ে খেলোয়াড়দের মধ্যকার আবেগ এবং কর্তৃপক্ষের ধান্ধাবাজির জ্বলন্ত উদাহরণকে সামনে এনেছেন। এখানে ব্যবহৃত জাম্প-কাট সোডারবার্গের সম্পাদনা রীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
উচ্চ সম্মানী ও এত এত পণ্যের বিজ্ঞাপন করেও খেলোয়াড়রা প্রধানত গতরখাটা মানুষই এবং লাভের গুড় সেই মালিকরাই কেড়ে নিয়ে যায়, এ সত্যে বারবার আঘাত করেছে ‘হাই ফ্লাইং বার্ড’। এর মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির কথা এনেছে সিনেমা এবং দেখিয়েছে, খেলাতেও বর্ণরাজনীতি কতটা প্রকট। শুধু লাভের গুড় নয়, এ প্রক্রিয়া কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের দাবিয়ে রাখার মতো করেই সৃষ্ট, যা একাধিকবার উঠে আসে স্পেন্সের বক্তব্যে। রে’র ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে সাক্ষাতে এ বিষয়গুলো আরো অভিঘাতী হয়ে উঠেছে। রে চরিত্রে আন্দ্রে হল্যান্ডের অভিনয় একইসাথে ধূর্ত, সাহসী। স্পেন্স চরিত্রে কিংবদন্তী বিল ডিউক পর্দায় গাম্ভীর্যকে পুরোদমে এনে দিয়েছেন।
তবে সবকিছুর পিঠে বাস্কেটবল খেলার প্রক্রিয়া থেকে মধ্যস্থতাকারীদের হটিয়ে দিয়ে খেলোয়াড়রা নিজেদের প্রাপ্ত সম্মানী, অধিকার নিজেদের হাতে নিয়ে নিলে কী ঘটত- সে প্রশ্নটিই বাস্কেটবল কোর্টের বাইরে, লকাররুমে, ইন্টারনেটে অনুনাদী হয়ে উঠেছে বারংবার। বর্তমান সংস্কৃতি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মুখ থুবড়ে পড়া এ খেলার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সতর্কবাণীও প্রকাশ পেয়েছে এ সিনেমায়।
কিন্তু সিনেমায় সবকিছুই যে ভ্রুকুটিহীন যথাযথ কাজ করেছে, তেমনটি নয়। কেন্দ্রীয় চরিত্র রে’র ব্যক্তিজীবনের কথাই যদি ধরা হয়, তার এক বাস্কেটবল খেলোয়াড় আত্মীয়কে ঘিরে অতীতের সেই অন্ধকার অধ্যায়ের সাবপ্লটটি প্রাসঙ্গিক হয়ে সিনেমায় ধরা দেয়নি। এছাড়াও, গল্পের চলনের শশব্যস্ততায় সিনেমার কৌতুকবোধ এবং অভিনয়ের জায়গাটি সময়ে সময়ে ফিকে হয়ে যেতে চেয়েছিল। এই টুকরো-টাকরা বিচ্ছিন্নতা অবশ্য সিনেমাটির উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনোভাবে বিশ্বাসযোগ্যতা এনেছে। ঠিক রে বার্কের মতো এ সিনেমা নিজেও খুব তাড়াহুড়োয় আছে এবং অনেক উদ্দেশ্যই তার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনো গভীর বার্তাসম্পন্ন সিনেমা হয়তো এটি নয়, কিন্তু তারপরও পেশাদারি খেলার প্রক্রিয়া কীভাবে ভেঙে পড়ছে, তা ভাবা ছাড়া সিনেমা শেষ করে চেয়ার ছেড়ে আড়মোড়া ভেঙে তড়িৎ উঠে যাওয়া কঠিন হবে চিন্তাশীল দর্শকের জন্য।
‘হাই ফ্লাইং বার্ড’ দিয়ে স্টিভেন সোডারবার্গ ফিল্মমেকিং নিয়ে তার নিজস্ব দর্শনের স্বতন্ত্র রূপ একেবারে সরাসরি প্রকাশ করেছেন। সিনেমায় রে বার্ক যেমন পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে বোকা বানিয়ে ফাঁদে আঁটকানোর পায়তারা করছিলেন, তেমনি সোডারবার্গও বর্তমানের স্টুডিওভিত্তিক ফিল্মমেকিংয়ে স্টুডিওর হম্বিতম্বি করার মনোভাবকে বুড়ো আঙুল দেখানোর পরামর্শ দেন এবং পুরোপুরি স্বাধীন অর্থায়ন কিংবা প্রয়োজনে স্মার্টফোন কেন্দ্রিক ফিল্মমেকিংয়ে ধাতস্থ হওয়ার আহ্বান জানান।