আমাদের অনেকেরই বই পড়ার প্রবণতা না থাকলেও সবারই যে বাধ্য হয়ে পাঠ্যবই পড়া লাগে তা বলাই বাহুল্য। সেই হিসেবে বলা যায়- আমরা সবাই বই পড়ি, তবে সেই বই পড়া যে আমাদের কতটা আনন্দ দিয়ে থাকে সেটাই প্রশ্ন! কেননা, বই পড়ার কারণে প্রধান যে প্রভাব আমাদের মনে পড়া উচিৎ তা হচ্ছে ‘আনন্দ’ অনুভব করা। আর, আমার মনে হয় না যে জোর করে পাঠ্যবই পড়ে কেউ সেই আনন্দ অনুভব করে। উল্টো যারা পাঠ্যবইয়ের বাইরে উপন্যাস বা প্রবন্ধের বই পড়ে, তাদের অনেককেই পড়ালেখায় ‘অমনোযোগী’ আখ্যা দেওয়া হয়। আবার, অনেক সময় বইপোকাদের কেউ বই পড়তে দেখলে প্রশ্ন করে বসে, “এসব বই পড়ে লাভ কী?” তখন অনেকেই আমরা যথাযথ উত্তর দিতে পারি না, কেননা অনেকেই বই পড়ে কেবলমাত্র আনন্দের জন্য। সেক্ষেত্রে যদি এই উত্তর দেয়া হয়, তাহলে বোঝাই যায় যে প্রশ্নকর্তা হেসেই উড়িয়ে দেবে। আবার, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের আপন মনেই প্রশ্ন জাগে যে, বই পড়লে ঠিক কী কী বিষয়ে আমরা লাভবান হই? অথবা, বই পড়ার সঠিক অর্থে কী কী উপকারিতা রয়েছে? আশা করা যায় এই লেখাটি পড়ে আপনি এই ব্যাপারে চমৎকার একটি ধারণা পেয়ে যাবেন।
আপনার মস্তিষ্কের উন্নতিসাধন করে
২০১৫ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় এমআরআই স্ক্যানের মাধ্যমে দেখা যায়- বই পড়ার সময় মস্তিষ্কের খুব জটিল নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং সিগনাল সক্রিয় থাকে। আর যতই আপনার বই পড়া বৃদ্ধি পায়, ততই সেই তা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ২০১৩ সালে করা আরেকটি গবেষণায় ফাংশনাল এমআরআই স্ক্যান ব্যবহার করে একটি উপন্যাস পড়ার সময় মস্তিষ্কে কী রকম প্রভাব পড়ে সেটা পর্যবেক্ষণ করা হয়। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ২১ জনকে ৯ দিন ‘পম্পেই’ উপন্যাস পড়তে দেয়া হয়। সেই উপন্যাস পড়াকালে যখন উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখন মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই গবেষণায় দেখা যায়, এই ৯ দিনের বই পড়ার পরের সময়ে অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্কের কানেক্টিভিটি বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে Somatosensory Cortex অংশে, যে অংশের কাজ শারীরিক সংবেদনশীলতার প্রতি সাড়া দেয়া।
আপনার সহানুভূতিশীলতা বৃদ্ধি করে
গবেষণায় দেখা গিয়েছে– যেসব ব্যক্তি বিভিন্ন উপন্যাস পড়ে থাকে, বিশেষত, যেসব উপন্যাসের চরিত্রগুলো অভ্যন্তরীণ জীবন অন্বেষণ করে, তাদের অন্যদের তুলনায় পরিস্থিতি উপলব্ধির ক্ষমতা বেশি থাকে। গবেষকরা একে ‘Theory of Mind’ বলেন। এটি একজন মানুষের সামাজিক বন্ধন অটুট রাখতে এবং ভালো অবস্থা বজায় রাখার জন্য অতীব জরুরি।
যদিও বছরে মাত্র একটি বই পড়লে এসবের কিছুই কারো মধ্যে গড়ে উঠবে না, কিন্তু যদি কেউ নিয়মিত বই পড়ে, তাহলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই সে অন্যদের তুলনায় অধিক বিকশিত একটি মন পাবে।
আপনার শব্দকোষ সমৃদ্ধ করে
১৯৬০ সালে একদল গবেষক একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন, যাকে ‘The Mathew Effect’ বলা হয়। মূলত এটি একটি বাইবেলের শ্লোককে কেন্দ্র করে গঠিত। এই শ্লোক থেকেই ‘গরীব গরিব হচ্ছে এবং বড়লোকের সম্পদ আরো বাড়ছে’ প্রবাদের উদ্ভব ঘটে। এই প্রবাদ যেমন অর্থের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ঠিক ততটাই একজন মানুষের শব্দকোষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
‘Matthew effects in young readers: reading comprehension and reading experience aid vocabulary development’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, যে ছাত্র যত আগে থেকে বই পড়ে আসছে, তার শব্দকোষ ভবিষ্যতে ততই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। আর একজন ছাত্রের সমৃদ্ধ শব্দকোষ তাকে ছাত্রজীবন এবং কর্মজীবন উভয় ক্ষেত্রেই অনেক সাহায্য করে। ২০১৯ সালে ‘সেনগেজ’ এর করা এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ৬৯% নিয়োগকর্তা এমন আবেদনকারীকে প্রাধান্য দেন, যাদের মানুষের সঙ্গে সুন্দর বাচনভঙ্গিতে এবং গুছিয়ে কথা বলার দক্ষতা রয়েছে। আর আমরা সবাই জানি, এই দক্ষতা অর্জন করতে বই পড়ার থেকে বেশি কার্যকর কিছু আর হয় না।
বার্ধক্যকালীন স্নায়বিক সমস্যা প্রতিরোধ
আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অন এজিং পরামর্শ দিয়েছে, নিয়মিত বই পড়া একজন মানুষের বার্ধক্যকালীন স্নায়বিক সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে। যদিও গবেষণা সরাসরি এটা দাবি করে না যে নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস স্নায়বিক রোগ (অ্যালঝেইমার্স , ডিমেনশিয়া ইত্যাদি) প্রতিরোধ করে। তবে দেখা গেছে, নিয়মিত বই পড়া এবং জটিল গাণিতিক সমস্যা নিয়ে চর্চাকারীদের স্নায়ু অন্যদের তুলনায় উন্নত অবস্থায় থাকে।
তবে এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি নিজের জীবনে যত আগে থেকে এই অভ্যাস গড়ে তুলবেন, ততটাই তার জন্য কার্যকরী হবে। ২০১৩ সালে ‘রাস ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টার’ দ্বারা পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে আসে- যেসব ব্যক্তি মানসিকভাবে উদ্দীপক কর্মে বেশি সক্রিয়, তাদের মস্তিষ্কে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের তুলনায় টিউমার বা সিস্ট ধরনের কিছু উৎপত্তি হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই কম।
মানসিক চাপ হ্রাস করে
২০০৯ সালে পরিচালিত এক পরীক্ষায় কয়েকজন ছাত্রকে যোগব্যায়াম, হাস্যরস এবং বই পড়া মানসিক চাপের উপর কেমন প্রভাব ফেলছে তা দেখা হয়। সেই পরীক্ষায় উঠে আসে যে, ৩০ মিনিটের বই পড়া রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন ইত্যাদি স্বাভাবিক রাখতে যোগব্যায়াম এবং হাস্যরসের মতোই কার্যকর প্রমাণিত হয়। এই পরীক্ষার সাথে জড়িত একজন গবেষক বলেন,
যেহেতু স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের ছাত্রদের দেয়া রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের মানসিক চাপের কারণগুলোর মধ্যে সময়ের সীমাবদ্ধতা একটি, তাই এই পদ্ধতির মধ্যে যেকোনো একটি ৩০ মিনিটের জন্য তাদের দৈনন্দিন কর্মের সাথে যুক্ত হলে তাদের পড়ালেখার সময় নষ্ট হবে না।
পর্যাপ্ত ঘুমে সাহায্য করে
মায়ো ক্লিনিকের পরামর্শ, রাতে পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য বই পড়া খুব কার্যকর একটি পন্থা। তবে এক্ষেত্রে বেশ কিছু দিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। যেমন- আপনি যদি বই সাধারণত পিডিএফ আকারে পড়েন, তাহলে আপনার একটি ই-বুক রিডারের মাধ্যমে বই পড়া উচিত। কেননা, রাতে আপনি যদি স্মার্টফোনের মাধ্যমে বই পড়েন, তাহলে মোবাইলের ব্লু-লাইট আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে। তবে, আপনি যদি কাগজের বই পড়েন, তাহলেও আপনার উচিৎ হবে খাটে বসে বই না পড়া। অন্য কোথাও গিয়ে বই পড়তে থাকবেন, যখন ঘুম ঘুম ভাব আসবে তখন খাটে গিয়ে ঘুমিয়ে যাবেন।
বিষণ্নতার উপসর্গ উপশম করতে সাহায্য করে
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিষণ্নতায় ভুগতে থাকা মানুষরা অন্যদের থেকে নিজেদের ভিন্ন এবং বিচ্ছিন্ন বোধ করেন। এই খারাপ অনুভূতিগুলো বই পড়ার মাধ্যমে হ্রাস করা সম্ভব।
সাহিত্যপাঠ আপনাকে সাময়িকভাবে বিষণ্ন বাস্তবজীবন থেকে পালিয়ে থাকতে সাহায্য করে, এবং আপনাকে সুযোগ করে দেয় যেন আপনি কাল্পনিক চরিত্রের জীবনের অভিজ্ঞতা অনুভব করতে পারেন। আর এরই সাথে নন-ফিকশন (প্রকৃত তথ্যভিত্তিক সাহিত্য) সাহায্য করে আত্মোন্নয়ন ঘটাতে এবং নিজের জীবনের বিষণ্নতা কাটিয়ে ওঠা শিখতে।
আর এজন্যই যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ‘রিডিং ওয়েল’ নামক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন মানুষের মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে তাদের সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে কার্যকর বই পড়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কেননা, বই পড়ার উপকারিতার মধ্যে বিষণ্নতা কাটানো অন্যতম।
দীর্ঘায়ু প্রাপ্তিতে সাহায্য করে
৩,৬৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্ককে নিয়ে একটি ১২ বছর দীর্ঘ গবেষণা করা হয়, যেখানে উঠে আসে- যেসব ব্যক্তির বই পড়ার অভ্যাস রয়েছে, তাদের বই পড়ায় অভ্যস্ত নয় এমন ব্যক্তিদের তুলনায় ২ বছর বেশি আয়ু ছিল।
এই একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তিগত বিপ্লবের ফলে বই পড়ার অভ্যাস অনেকের মাঝে প্রায় উঠেই গিয়েছে বলা চলে। তবে, বই পড়ার চেয়ে সুখকর ও নির্মল আনন্দ যে হয় না, সেটা যারা বই পড়ে তারা অবশ্যই মানতে বাধ্য। বই পড়ার মাধ্যমে যেমন বিনোদন নেয়া যায়, সেই সাথে জ্ঞান আহরণও করা যায়। এজন্যই, যাদের বই পড়ার অভ্যস এখনও গড়ে ওঠেনি, তাদের সবারই উচিৎ এই সুন্দর অভ্যাস গড়ে তোলা।