স্পাই স্টোরিজ (১): যে মার্কিন স্পাই গাদ্দাফিকে সাহায্য করতে চেয়েছিল

এবারের একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে রোর বাংলার লেখক মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার বই ‘স্পাই স্টোরিজ: এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য কিছু সত্য কাহিনী‘। বইটির একটি গল্প আমরা প্রকাশ করছি রোর বাংলার পাঠকদের জন্য। তিন পর্বে প্রকাশিত গল্পটির প্রথম পর্ব এটি। সবগুলো পর্ব পড়ুন এখান থেকে: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব

এক.

২০০০ সালের নভেম্বর মাসে নিউ ইয়র্কের লিবিয়ান কনস্যুলেটে পৃথক পৃথকভাবে তিনটি রহস্যময় প্যাকেজ এসে উপস্থিত হয়। প্যাকেজগুলো পাঠানো হয়েছিল অজ্ঞাতনামা এক প্রেরকের পক্ষ থেকে সরাসরি লিবীয় নেতা মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফিকে উদ্দেশ্য করে!

তিনটি প্যাকেজের ভেতরেই ছিল ইংরেজিতে লেখা একটি করে কভার লেটার, দুর্বোধ্য সাংকেতিক ভাষায় লেখা কতগুলো পৃষ্ঠা এবং সেই সাথে সংযুক্ত চূড়ান্ত গোপনীয় কিছু ডকুমেন্ট এবং ছবি। কভার লেটার তিনটি ছিল হুবহু একইরকম। সেগুলোর প্রতিটির উপর ইংরেজিতে বড় হাতের অক্ষরে লেখা ছিল: THIS LETTER CONTAINS SENSITIVE INFORMATION। অর্থাৎ, ‘এই চিঠিতে স্পর্শকাতর তথ্য আছে’।

শিরোনামের নিচে চিঠিগুলোতে যা লেখা ছিল, তার অংশবিশেষ ছিল মোটামুটি এরকম:

এই চিঠিটি অত্যন্ত গোপনীয়। এটি পাঠানো হয়েছে আপনাদের প্রেসিডেন্ট অথবা গোয়েন্দা-বাহিনীর প্রধানকে উদ্দেশ্য করে। অনুগ্রহ করে চিঠিটি কূটনৈতিক ব্যাগে করে পাঠিয়ে দেবেন। অফিসে, বাসায় কিংবা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে কারো সাথে চিঠিটির অস্তিত্বের কথাও আলোচনা করবেন না। এই নির্দেশ যদি অনুসরণ না করেন, তাহলে আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চিঠিটির এবং এর বিষয়বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে জেনে ফেলতে পারে এবং এগুলো সংগ্রহ করে ফেলতে পারে।

কভার লেটার ছাড়াও তিনটি খামের প্রথমটির ভেতর ছিল চার পৃষ্ঠার একটি সাংকেতিক চিঠি, যেখানে মোট ১৪৯টি লাইনে একের পর এক সাজানো ছিল অক্ষর এবং সংখ্যার সংমিশ্রণে তৈরি দুর্বোধ্য কতগুলো শব্দ। দ্বিতীয় খামের ভেতর ছিল কীভাবে সুনির্দিষ্ট সাইফার কী (Cipher Key) এবং কোড বুক (Code Book) ব্যবহার করে সাংকেতিক চিঠিটির মর্ম উদ্ধার করতে হবে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত নির্দেশনা।

আর তৃতীয় খামের ভেতর ছিল দুই সেট কোড শিট (Code Sheet)। প্রথম সেটে ছিল সাইফার কী, যা দিয়ে সাইফারটেক্সট (Ciphertext) তথা সাংকেতিক লিপিকে প্লেইনটেক্সট (Plaintext) তথা সাধারণ লিপিতে রূপান্তরিত করা যাবে। আর দ্বিতীয় সেটে ছিল ছয় পৃষ্ঠা জুড়ে লেখা দুই অক্ষরের কয়েক ডজন ব্রেভিটি কোড (Brevity Code) তথা সংক্ষিপ্ত কোড এবং তাদের অর্থের তালিকা, যেগুলো দিয়ে প্লেইন টেক্সটের সংক্ষিপ্ত শব্দগুলোর প্রকৃত অর্থ বোঝা যাবে।

অর্থাৎ তিনটি খামের মধ্যে প্রথমটিতে ছিল মূল সাংকেতিক চিঠি, আর পরের দুটো খামে ছিল সেই সাংকেতিক চিঠির মর্মোদ্ধার করার চাবি। প্যাকেজগুলো যে পাঠিয়েছিল, সে নিশ্চিত করতে চেয়েছিল, চিঠিটির প্রকৃত অর্থ যেন কেবলমাত্র গাদ্দাফি কিংবা তার গোয়েন্দা প্রধানই উদ্ধার করতে পারেন। একটি বা দুটি খাম অন্য কারো হাতে পড়ে গেলেও যেন তারা কিছু বুঝতে না পারে।

কিন্তু তার জানার কথা ছিল না, গাদ্দাফির হাতে পৌঁছা তো দূরের কথা, লিবিয়ান কোনো কর্মকর্তার হাতে পৌঁছার আগেই তিনটি খামই গিয়ে পড়বে কনস্যুলেটের ভেতর আন্ডারকভারে থাকা এফবিআই এর এক স্পাইয়ের হাতে!

স্পাই স্টোরিজ: যে বই থেকে নেওয়া হয়েছে এই গল্পটি। অর্ডার করুন এখানে

ডিসেম্বরের এক সোমবার সকালে প্যাকেজ তিনটি এসে পৌঁছে এফবিআই এর ওয়াশিংটন ডিসির ফিল্ড অফিসে। কেসটি সমাধান করার দায়িত্ব এসে পড়ে সেখানে কর্মরত স্পেশাল এজেন্ট স্টিভেন কারের উপর।

চার পৃষ্ঠার চিঠিটিকে এনসাইফার (Encipher) তথা সংকেতায়িত করা হয়েছিল ষোড়শ শতকে উদ্ভাবিত ভিজেনিয়ার সাইফার (Vigenère Cipher) নামে অত্যন্ত জটিল একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে, সাইফার কী দেওয়া থাকলেও যা সমাধান করা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তারপরেও এফবিআইর নিউ ইয়র্ক ফিল্ড অফিসের কর্মকর্তারা চিঠিটির প্রথম কয়েকটি লাইনের পাঠোদ্ধার (Decipher) করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কার সেটুকুই পড়তে শুরু করেন:

আমি সিআইএর মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর-আফ্রিকা বিষয়ক একজন অ্যানালিস্ট। আমি অত্যন্ত গোপনীয় তথ্য হস্তান্তরের মাধ্যমে আপনাদের দেশের হয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করতে চাই। আমার টপ সিক্রেট ক্লিয়ারেন্স আছে এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসএ), ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (ডিআইএ), সেন্ট্রাল কমান্ডসহ (সেন্টকম) অনেকগুলো গোয়েন্দা-সংস্থার চূড়ান্ত গোপনীয় নথিপত্রে আমার প্রবেশাধিকার আছে। …

তার দাবি যে ভিত্তিহীন না, সেটা প্রমাণ করার জন্য নিজেকে সিআইএ-র অ্যানালিস্ট দাবি করা সেই গুপ্তচর প্রতিটি খামের ভেতর CLASSIFIED SECRET তথা ‘গোপনীয় হিসেবে শ্রেণীবিন্যস্ত’ এবং CLASSIFIED TOP SECRET তথা ‘চূড়ান্ত গোপনীয় হিসেবে শ্রেণীবিন্যস্ত’ লেখা কিছু ডকুমেন্ট সংযুক্ত করে দিয়েছিল।

এর অধিকাংশই ছিল আমেরিকার স্পাই স্যাটেলাইট দিয়ে তোলা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কয়েকটি সামরিক স্থাপনার ছবি এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের সরকার ও সেনাবাহিনীর উপর আমেরিকার গোয়েন্দা প্রতিবেদন। এছাড়াও আরো কিছু ডকুমেন্টও সেখানে অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার মধ্যে একটি ছিল একেবারে নিচে দিয়ে উড়ে যাওয়া একটি প্লেন থেকে তোলা ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত গাদ্দাফির একটি প্রমোদতরীর ছবি, যেটি তুলেছিল ইসরায়েলি গোয়েন্দাবাহিনী!

স্টিভেন কার তার এফবিআই জীবনে এ ধরনের কিছু দেখেননি। এসব তথ্য যদি আসলেই লিবিয়ার হাতে পড়ে, তাহলে কী অবস্থা হবে, সেটা ভেবে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়। গুপ্তচরকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে পরামর্শের জন্য তিনি ছুটে যান তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা লিডিয়া জেখোরেকের কক্ষে। ইতোমধ্যেই অবশ্য তিনি সেই গুপ্তচরের সম্ভাব্য কিছু বৈশিষ্ট্যের একটি তালিকা তৈরি করে নিয়েছেন, যেগুলো ব্যবহার করলে অনুসন্ধান কার্যক্রম অনেকটাই সহজ হয়ে আসবে।

প্রথমত, ডকুমেন্টগুলো থেকে বোঝা যায়, গুপ্তচরটির টপ সিক্রেট ক্লিয়ারেন্স আছে। দ্বিতীয়ত, চিঠিতে ব্রেভিটি কোডের ব্যবহার থেকে ধারণা করা যায়, সম্ভবত তার সামরিক প্রশিক্ষণ আছে। তৃতীয়ত, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক ইন্টেলিঙ্কে (Intelink) তার প্রবেশাধিকার আছে। কারণ চিঠির সাথে সংযুক্ত ছবিগুলো দেখলে বোঝা যায়, সেগুলো ইন্টেলিঙ্ক থেকে প্রিন্ট করা হয়েছিল। চতুর্থত, গুপ্তচরটি বিবাহিত এবং সম্ভবত তার সন্তান আছে। কারণ চিঠির পরবর্তী অংশে সে লিখেছিল, ‘গুপ্তচরবৃত্তির মধ্য দিয়ে আমি নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে ফেলছি।’

আর পঞ্চমত, গুপ্তচরটি ইংরেজি বানানে একেবারেই কাঁচা! ছয় পৃষ্ঠার যে ব্রেভিটি কোডের তালিকা সে তৃতীয় খামের ভেতর সংযুক্ত করে দিয়েছিল, যেখানে দুই অক্ষরের বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দের প্রকৃত অর্থ লেখা ছিল, কার লক্ষ্য করেন সেখানে অনেকগুলো সহজ শব্দের বানানই ভুল। Anonymous-কে সেখানে লেখা হয়েছে Anonmus, Allegations-কে Alligations, Reveal-কে Reveil, Precaution-কে Precausion … পুরো তালিকাটিই ভুলে ভরা!

ব্যাপারটি খুবই অস্বাভাবিক। সিআইএ-র একজন অ্যানালিস্ট, যার টপ সিক্রেট ক্লিয়ারেন্স আছে, যে গুপ্তচরবৃত্তির যোগ্যতা রাখে, জটিল সাংকেতিক ভাষায় বিশাল চিঠি এনক্রিপ্ট করতে পারে, সেই ব্যক্তি এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটি চিঠিতে এতগুলো বানান কীভাবে ভুল করে? কার এর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা খুঁজে পেলেন না।

এফবিআই কর্মকর্তা স্টিভেন কার এবং তার স্ত্রী মিশেল কার; Image Source: Michelle Carr

পরদিন থেকেই কাজে লেগে পড়েন স্টিভেন কার। তিনি এফবিআই এবং এনএসএর সেরা ক্রিপ্টোলজিস্টদেরকে দায়িত্ব দেন সম্পূর্ণ চিঠিটি ডিকোড করার জন্য। সাইফার কী এবং কোড বুক সামনে থাকা সত্ত্বেও ভি সাইফারের জটিল একটি সংস্করণ ব্যবহার করে এনক্রিপ্ট করার কারণে ১৪৯ লাইনের চিঠিটির পাঠোদ্ধার করতে তাদের ৭২ ঘণ্টা সময় লেগে যায়!

ডিকোড করা চিঠিটি থেকে বেশ কিছু নতুন তথ্য জানা যায়। গুপ্তচরটি দাবি করে, সে ২০ বছর ধরে সিআইএ-র হয়ে কাজ করছে এবং আগামী ২ বছরের মধ্যেই সে অবসরে যাবে। কিন্তু এত বছর চাকরি করার পর সে যে পেনশন পাবে, সেটা তার মতে যথেষ্ট না। কাজেই সে লিবিয়ার হাতে আমেরিকার গোয়েন্দা কার্যক্রম, তাদের স্পাই স্যাটেলাইটগুলোর কক্ষপথের অবস্থান, সেগুলোর লিবিয়ার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হস্তান্তর করতে প্রস্তুত, বিনিময়ে তাকে মাত্র ১৩ মিলিয়ন ডলার দিলেই চলবে!

যোগাযোগ করার জন্য চিঠিতে একটি ইমেইল আইডিও দেওয়া ছিল। কার তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুমতি নিয়ে ইমেইল সার্ভিস প্রোভাইডারের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি জানতে পারেন, আইডিটি খোলা হয়েছে মাত্র চার মাস আগে। এর পর থেকে গত কয়েকমাসে এটি বেশ কয়েকবার ব্যবহার করা হয়েছে, প্রতিবারই ওয়াশিংটন ডিসির বিভিন্ন পাবলিক লাইব্রেরি থেকে, কেবল একবার ভার্জিনিয়ার শ্যান্টিলি এলাকা থেকে।   

আইডিটিতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইমেইল ছিল না, কিন্তু লাইব্রেরিগুলোর অবস্থান কারকে নতুন একটি সূত্রের সন্ধান দেয়। চিঠিতে গুপ্তচরটি নিজেকে সিআইএ-র অ্যানালিস্ট হিসেবে দাবি করেছিল। কিন্তু কার ধারণা করেন, সেটি হয়তো ছিল তার আসল পরিচয় গোপন করার একটি প্রচেষ্টা। বাস্তবে হয়তো তার আসল কর্মস্থল সিআইএ (CIA) না, বরং এনএসএ (NSA) অথবা এনআরও (NRO)। কারণ যেসব স্থান থেকে ইমেইল আইডিটি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেগুলোর আশেপাশে কেবল এই দুটি গোয়েন্দা সংস্থার সদর দপ্তরই ছিল।

এনএসএর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের প্রধান, রবার্ট ম্যাকক্যাসলিনের সহায়তায় স্টিভেন কার সন্দেহভাজনদের তালিকা গুটিয়ে আনতে থাকেন। ইন্টেলিঙ্ক থেকে নির্দিষ্ট ছবিগুলো ঠিক কখন প্রিন্ট করা হয়েছিল, সেই মুহূর্তে এই দুই গোয়েন্দা সংস্থার কোন কোন কর্মচারী ইন্টেলিঙ্ক ব্যবহার করছিল, তাদের মধ্যে কতজনের টপ সিক্রেট ক্লিয়ারেন্স আছে, এভাবে ফিল্টার করতে করতে শেষপর্যন্ত তাদের সন্দেহের তালিকায় মাত্র একজনের নাম অবশিষ্ট থাকে– এনআরও (NRO) তথা ন্যাশনাল রিকনিসন্স (Reconnaissance) অফিসের ইমেজ অ্যানালিস্ট ব্রায়ান প্যাট্রিক রিগ্যান।

ব্রায়ান রিগ্যান দেখতে মোটেও স্পাই সুলভ না। সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, বেশ স্থূলকায়, ৩৭ বছর বয়সী বোকাসোকা চেহারার লোকটিকে প্রথম দেখায় সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। তার চেহারায়, চাল-চলনে কিংবা কথাবার্তায় কোনো বিশেষত্ব নেই। আশেপাশের মানুষের কাছেও তিনি অলস এবং মাথামোটা হিসেবেই পরিচিত। তার একঘেয়ে, বৈচিত্র্যহীন জীবনের উপর নজরদারি করতে গিয়ে এফবিআই কর্মকর্তারা হাঁপিয়ে ওঠেন। তাদের সন্দেহ হতে থাকে, আসলেই তারা ঠিক লোকের উপর নজরদারি করছেন তো?

কিন্তু তাদের সন্দেহ দূর হতে বেশি দেরি হয় না। রিগ্যানের লেখা বিভিন্ন রিপোর্ট ঘাঁটতে গিয়ে তারা আবিষ্কার করেন, তার ইংরেজি বানানেও ছোট বাচ্চাদের মতো অজস্র ভুল!

বিমানবাহিনীতে থাকার সময় ব্রায়ান রিগ্যান; Image Source: https://noir4usa.org/

দুই.

ব্রায়ান প্যাট্রিক রিগ্যানের জন্ম ১৯৬২ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডের এক নিম্নবিত্ত আইরিশ অভিবাসী পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই রিগ্যান ছিলেন ডিসলেক্সিয়ায় (Dyslexia) আক্রান্ত। ডিসলেক্সিয়া হচ্ছে এমন একধরনের ব্যাধি, যার কারণে মানুষের অক্ষর চিনতে সমস্যা হয়। ফলে ডিসলেক্সিকরা প্রচলিত পদ্ধতির পড়ালেখায় খুব ভালো করতে পারে না। তারা বানান ভুল করে, পড়া মনে রাখতে পারে না এবং গণিতে দুর্বল হয়। কিন্তু অন্যদিকে তারা যেকোনো চিত্র এবং জটিল কারুকার্যের নকশা খুব সহজেই মনে রাখতে বা চিহ্নিত করতে পারে। ফলে এনক্রিপশন/ডিক্রিপশনে এরা চমৎকার কাজ করতে পারে।

ডিসলেক্সিয়ার কারণে রিগ্যান স্কুলের পড়ালেখায় খুবই কাঁচা ছিলেন। তার পরীক্ষার ফলাফল ছিল খুবই খারাপ। তখনও আমেরিকার সমাজে কিংবা স্কুলগুলোতে ডিসলেক্সিয়াজাতীয় রোগে আক্রান্ত শিশুদের প্রতি বাড়তি যত্ন নেওয়ার রীতি চালু হয়নি। স্কুলের সহপাঠীরা তাকে প্রতিবন্ধী বলে নিপীড়ন করত। তার সাথে প্রচণ্ড রকম দুর্ব্যবহার করত। ঘরে, বাইরে এবং পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে সবার কাছে প্রতিনিয়ত অপমানিত হওয়া আর অবমূল্যায়নের শিকার হওয়াই যেন ছিল রিগ্যানের আজীবনের নিয়তি!

রিগ্যান জানতেন, তার খারাপ ফলাফলের কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন না। ফলে হাই স্কুল শেষ করে তিনি বিমানবাহিনীতে ভর্তি হন। সেখানে বেসিক ট্রেনিং শেষ করার পর ১৯৮০ সালে তার চাকরি হয় সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স বিভাগে। তার মতো ডিসলেক্সিকের জন্য এটি ছিল চমৎকার একটি চাকরি। পনেরো বছর বিমানবাহিনীতে থাকার পর ১৯৯৫ সালে তাকে স্থানান্তর করা হয় এনআরও তথা ন্যাশনাল রিকনিসন্স অফিসে, যেটি মূলত বিশ্বব্যাপী আমেরিকার স্পাই স্যাটেলাইটগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা বিমানবাহিনীর অধীনস্থ গোয়েন্দা সংস্থা।

এনআরওতে রিগ্যানের সময় খুব ভালো যাচ্ছিল না। তিনি অনুভব করছিলেন, এখানে তার যথাযোগ্য মূল্যায়ন হচ্ছে না। তার সহকর্মীদের পদোন্নতি হলেও তার কোনো পদোন্নতি হচ্ছিল না এবং পদোন্নতির কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছিল না।

১৯৯৯ সালে বিমানবাহিনী থেকে তাকে ইউরোপে পোস্টিংয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু পারিবারিক কারণে তার পক্ষে তখন ইউরোপ যাওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি পোস্টিং বাতিলের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু প্রত্যুত্তরে তাকে জানানো হয়, বিদেশে না গেলে ২০০০ সালের আগস্টের ৩১ তারিখে, তার চাকরিজীবনের ২০ তম বছর পূর্ণ হওয়ার পর তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে হবে।

বাল্যকালে ব্রায়ান রিগ্যান; Image Source: FBI

রিগ্যান পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি জানতেন বিমানবাহিনীতে তার সুনির্দিষ্ট কাজের যে অভিজ্ঞতা ছিল, তা দিয়ে সামরিক জগতের বাইরে তার পক্ষে ভালো কোনো চাকরি জোগাড় করা সম্ভব হবে না। রিগ্যানের স্ত্রী ছিলেন অতিরিক্ত খরুচে স্বভাবের। স্ত্রীর বিভিন্ন শখ আর চার ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে গিয়ে রিগ্যান তার একাধিক ক্রেডিট কার্ডে সব মিলিয়ে ১ লাখ ১৬ হাজার ডলার ঋণ করে ফেলেছিলেন। মাত্র ৩৯ বছর বয়সেই অবসরে গেলে বাকি জীবন কীভাবে কাটাবেন, সেটা ভেবে রিগ্যান উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে শুরু করেন।

একইসাথে রিগ্যানের মনের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভেরও সৃষ্টি হতে থাকে। তাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করা তার সহকর্মীদের প্রতি, তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রতি এবং তার নিজের প্রতিও। এরকম সময়ই তার মাথায় প্রথমবারের মতো গুপ্তচরবৃত্তির ধারণা আসে। তার কাছে মনে হতে থাকে, রাষ্ট্রের গোপন তথ্য বিক্রি করে হলেও বাড়তি কিছু টাকা পাওয়াটা তার ন্যায্য অধিকার। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে তিনি তার প্রাপ্য আদায় করে নিবেন। আর নিজের কাছে হলেও প্রমাণ করে ছাড়বেন, সবাই তাকে সারাজীবন ধরে যেরকম অযোগ্য মনে করে এসেছে, তিনি মোটেও সেরকম অযোগ্য নন!

গুপ্তচরবৃত্তির কাজটা তার জন্য মোটেও কঠিন হবে না। এনআরওতে তার কাজই ছিল আমেরিকার স্পাই স্যাটেলাইটগুলো দিয়ে তোলা বিভিন্ন ছবি বিশ্লেষণ করা এবং ইন্টেলিঙ্কে তার বিভাগের ওয়েবপেজ দেখাশোনা করা। নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকেই তিনি টপ সিক্রেট ক্লিয়ারেন্স ব্যবহার করে গোপন সব তথ্য এবং ছবি হাতিয়ে নিতে পারবেন।

তার ডিসলেক্সিয়াও এক্ষেত্রে চমৎকার কভার হিসেবে কাজ করবে। সবাই তাকে সারা জীবন ধরে মাথামোটা বলে অবজ্ঞা করে এসেছে। কাজেই ভবিষ্যতে যদি কখনও তথ্য পাচারের ঘটনা ফাঁসও হয়ে যায়, তবুও কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। তিনি যে গুপ্তচরবৃত্তি করার মতো যোগ্যতা এবং বুদ্ধিমত্তা রাখেন, এটাই কারো মাথায় আসবে না। সবার চোখের সামনে দিয়েই আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম সেরা গুপ্তচরবৃত্তির কাজটি সম্পন্ন করবেন তিনি!

এরপর কী ঘটেছিল? জানতে হলে পরবর্তী পর্ব পড়ুন এখান থেকে। আর সবগুলো পর্ব পড়ুন এখান থেকে: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব

যদি সত্য ঘটনা অবলম্বনে এরকম আরও গোয়েন্দা কাহিনি জানতে চান, তাহলে পড়তে পারেন এই লেখকের “স্পাই স্টোরিজ” বইটি। বইটি পাওয়া যাচ্ছে বইমেলায় ঐতিহ্যের (১৪ নম্বর) স্টলে। রকমারি ডট কম থেকে বইটি কিনতে ক্লিক করুন এখানে

This is a true spy story from the book "Spy Stories" by Mozammel Hossain Toha, one of the staff writers of Roar Bangla. This is the 1st part of a three-part series.

Related Articles

Exit mobile version