চলচ্চিত্র নির্বাক থেকে সবাক হতে শুরু করে ১৯২০ দশকের শেষভাগে। ত্রিশ দশকের একেবারে গোড়ার দিকেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে সবাক চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র সমালোচকরা চলচ্চিত্রের এই সবাক হওয়া নিয়ে প্রথমদিকে হায় হায় রব তুললেও পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র মাধ্যমটি আরো শিল্পমণ্ডিত হয়ে উঠতে থাকে সবাক হওয়ার মাধ্যমেই। নির্বাক থেকে সবাক হওয়ার এ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু চলচ্চিত্রের মাঝে একটি হলো ‘গ্রেট পরিচালক’ আলফ্রেড হিচককের এই ‘ব্ল্যাকমেইল’ (১৯২৯) সিনেমাটি। ‘সাসপেন্সের মাস্টার’ হিসেবে খ্যাত এই পরিচালকের পরবর্তী ক্যারিয়ারকে একটা নির্দিষ্ট কাঠামোতে আনতে ভূমিকা রেখেছে এ সিনেমা। হিচককের ক্যারিয়ারের প্রথম সবাক সিনেমা হওয়ার পাশাপাশি, ব্রিটিশ চলচ্চিত্র ইতিহাসেও ‘প্রথম সবাক সিনেমা’ এটি। সে হিসেবে আলাদা গুরুত্ব তো এর রয়েছেই।
তো এই প্রথম ব্রিটিশ সবাক সিনেমার শুরু হয়, একজন অপরাধীকে ধরে থানায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়াটি দিয়ে। গাড়ির চাকার এক্সট্রিম ক্লোজআপ শট দিয়েই শুরু হয় সিনেমা। তারপর মিড অ্যাঙ্গেলে গাড়ির গোটা শরীর আর ছুটে চলার গতি দেখানো হয়। ব্যাকগ্রাউন্ডে উত্তেজনাপূর্ণ মিউজিক বেজে চলে। মিউজিকটা শুনে মনে হয়, পুলিশ আর অপরাধীর ভাগদৌড়ের দৃশ্যেই এমন মিউজিক যথাযথ হবে। এক্ষেত্রে অবশ্য অপরাধী স্থির আর দুই গোয়েন্দা ছুটে যাচ্ছে তাকে পাকড়াও করতে। হাতে লেখা একটা নোটের ক্লোজআপ শটও ব্যবহার করা হয় এই দৃশ্যে। এরকম হাতে লেখা নোট আর সেটার ক্লোজআপ শট হিচকক তার পরবর্তীর অনেক সিনেমায়ও ব্যবহার করেছেন। অপরাধীকে পাকড়াও করে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া, দোষ স্বীকার করাতে চাওয়া, আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে অপরাধী চিহ্নিত করা এবং গারদে ঢোকানো অব্দি বিস্তৃতি; সিনেমার এই প্রস্তাবনা দৃশ্যের। এ দৃশ্যেই সিনেমার অন্যতম প্রধান একটি চরিত্র এবং তার প্রকৃতি সম্বন্ধে ধারণা দেয় দর্শককে।
মনে হতে পারে, পুলিশ কীভাবে অপরাধী ধরে, সেটার রুটিন প্রক্রিয়াটাই শুধুমাত্র এই দৃশ্যে দেখানো হয়েছে। কিন্তু আদতে তেমনটি নয়। এই দৃশ্যে দুই গোয়েন্দার একজন ফ্র্যাংক ওয়েবার, সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রের একটি। ফ্র্যাংকের পেশার সাথে পরিচয় করানোর পাশাপাশি দায়িত্বটা তার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং কতটুকু নৈতিকতাবান সে, তার পরিচয় পাওয়া যায় এই দৃশ্যে। এবং এখানেই ছোট্ট করে ‘ফোরশ্যাডোয়িং’ টেকনিক বা পূর্বাভাসের ব্যবহার করেন হিচকক। পরবর্তীকালে এ দায়িত্ববোধই যে ফ্র্যাংককে দ্বন্দ্বে ফেলবে এবং তাকে দ্বিখণ্ডিত করবে, সেই পরিস্থিতির আভাস এ দৃশ্যেই দেওয়া হয়।
মূল গল্প শুরু হয়, একটি রেস্তোরাঁ থেকে। গোয়েন্দা ফ্র্যাংক তার প্রেমিকা অ্যালিসকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় যান। লোকজনের গিজগিজের মাঝে একটা খালি টেবিলও মিলে যায়। ফ্র্যাংকের আসতে দেরি হওয়ায় প্রেমিকার মুখ থমথমে হয়েই ছিল। তবে রেস্তোরাঁয় আরেক পুরুষের প্রবেশে ভাবভঙ্গি বদলে যায় অ্যালিসের। ইশারায় ওই পুরুষ আর অ্যালিসের মাঝে কিছু কথা হয়ে গেল যেন। ওই পুরুষের সাথে সময় কাটাবে বলেই যেন অ্যালিস রাগের সুর তুলে ফ্র্যাংকের সাথে ঝগড়া বাঁধাল। কাজ হলো এতে, ফ্র্যাংক উঠে চলে গেল। এদিকে অ্যালিস ওই পুরুষের হাত ধরে রেস্তোরাঁ থেকে বের হওয়ার জন্য তৈরি হলো।
ঠিক সে সময়েই ফ্র্যাংক এল অ্যালিসকে মানানোর জন্য। কিন্তু প্রেয়সী ততক্ষণে আরেকজনের বাহুতে। সামনে এসে কিছু না বলে নীরবে আড়াল থেকে দেখে গেল সে। দ্বিতীয় এই পুরুষের নাম ক্রোয়ি। পেশায় একজন চিত্রশিল্পী। অ্যালিসের সাথে কিছুটা সময় কাটানোর পর বিদায়বেলায় অ্যালিসকে তার বাসায় নিয়ে যেতে চাইলো মিস্টার ক্রোয়ি। অ্যালিস রাজি না হলেও জোরাজুরিতে সম্মত হলো।
অ্যালিস ঘুরে ঘুরে তার চিত্রশিল্পের প্রশংসা করলো। নিজেও কাঁচা হাতে একটা মুখাবয়ব আঁকার চেষ্টা করল। ক্রোয়ি পিয়ানোতে সুর তুলে গান গাইল, অ্যালিস নাচল। এক পর্যায়ে ক্রোয়ি জোরপূর্বক অ্যালিসকে চুম্বন করতে চাইলো অ্যালিস বাধা দিয়ে বিদায় নিতে চাইল। কিন্তু পোশাক বদলানোর সময় অ্যালিসের পরনের পোশাকটা লুকিয়ে তাকে উত্যক্ত করে ধর্ষণের চেষ্টা করলো ক্রোয়ি। নিজেকে রক্ষার চেষ্টায় হাতড়ে হাতড়ে একটা পাউরুটি কাটার ছুরি পেয়ে সেটা দিয়েই ক্রোয়িকে খুন করল অ্যালিস। তারপর তড়িঘড়ি করে তার এই বাসায় আসার সব প্রমাণ মুছে বেরিয়ে গেল। কিন্তু ভুল করে ফেলে গেল হাতের গ্লোভস। এই খুনের তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় ফ্র্যাংককে। বাসা তল্লাশি করে সে অ্যালিসের ওই গ্লোভ খুঁজে পায়। তবে সেটা গোপন করে তার বসের কাছে। কিন্তু সে গ্লোভ পেয়েছে একটা। আরেকটা কোথায়? শীঘ্রই বেনামি কলে শুরু হয় অ্যালিস আর ফ্র্যাংককে ব্ল্যাকমেইল করা। আর এদিকে ফ্র্যাংকও দ্বন্দ্বে পড়ে তার দায়িত্ববোধ আর প্রেমিকাকে বাঁচানোর মাঝে।
হিচকক তার এ সিনেমা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কথায় সবাক করলেও তখনকার অনুন্নত আর সীমাবদ্ধ প্রযুক্তির কথা মাথায় রেখে নির্বাক রাখার দিকটাও দেখেন। তাইতো সবাক, নির্বাক দু’ভাবেই মুক্তি দেওয়া হয় সিনেমাটিকে। তাছাড়া মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, পুরোপুরি সবাক এই সিনেমা না, আবার নির্বাকও না। একটা সূক্ষ্ম সমতা তিনি তৈরি করেছেন এখানে। প্রারম্ভিক দৃশ্যটিই দেখা যাক, এ দৃশ্য সবাক নয়। কোনরকম ‘ইন্টারটাইটেল’ও ব্যবহার করা হয়নি। সিনক্রোনাইজড ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের উপর নির্ভর করে নির্বাক রাখা হয়েছে। গোটা সিনেমায় আরো বেশ কয়েকটি দৃশ্য আছে এমন। আর এই কাজটা এতটা সূক্ষ্মভাবে হিচকক করেছেন মনে হয় যেন, নির্বাক হিসেবেই গোটা সিনেমা শ্যুট করেছেন এবং পরে কথা যোগ করতে হলে সেটা যাতে সহজে এবং সামঞ্জস্যের সাথে করা যায়, সে পথটা রেখেছেন।
আবার নির্বাক হয়ে ওঠার যথাযথ উপাদানও রেখেছেন হিচকক। তবে একমাত্র ঝামেলাটা বেঁধেছে সিনেমার কেন্দ্রীয় অভিনেত্রী অ্যানি ওন্ড্রার ক্ষেত্রে। তার ইংরেজি টানটা পোল্যান্ডিয় হওয়ায় ব্রিটিশ অভিনেত্রী জোয়ান বেরিকে দিয়ে তার সংলাপগুলো ডাব করানো হয়। কিন্তু ডাবিং প্রযুক্তি তখন অত উন্নত না হওয়ায়, শ্যুটিং স্পটে ক্যামেরার পাশে মাইক্রোফোন ধরে বেরি সংলাপ বলেছে আর ওদিকে ক্যামেরার সামনে অ্যানি ঠোঁট মিলিয়েছে। এতে একটা অসঙ্গতি হওয়াই স্বাভাবিক এবং সেটা বেশ চোখে লাগার মতো। এদিকটায় ‘ব্ল্যাকমেইল’ পিছিয়ে পড়েছে কিছুটা।
ব্ল্যাকমেইলের আগে ‘দ্য লজার’ (১৯২৭) দিয়ে হিচকক ‘থ্রিলারধর্মী পরিচালক’ হিসেবে নিজেকে পরিচয় করালেও, সে পরিচয় শক্ত আর প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করেছে এ সিনেমা। হিচককের পরবর্তী সিনেমাগুলোর অনেক ট্রেডমার্ক স্টাইলের দেখা পাওয়া যায় এ সিনেমাতেই। শুরুতেই ধরা যাক, মার্ডার প্লট বা খুনকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া গল্পের বিষয়টি। ‘সাইকো’ (১৯৬০), ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’ (১৯৫৪), ‘রোপ’ (১৯৪৮), ‘স্ট্রেঞ্জার্স অন আ ট্রেইন’ (১৯৫১)-এর মতো হিচককের পরবর্তীকালের সুপরিচিত কাজগুলোতে খুননির্ভর গল্পের ভিত গড়ে উঠেছে এই সিনেমাতে। তারপরই আছে ‘ব্লন্ড ভিক্টিম।’ সাইকো, দ্য বার্ডস, ডায়াল এম ফর মার্ডারের মতো হিচককের ক্যারিয়ারের পরবর্তীর সিনেমাগুলোর মতো এ সিনেমায়ও বলি হতে দেখা যায় স্বর্ণকেশী নায়িকাকে। খুনের গল্প, ব্লন্ড ভিক্টিম আর সাথে কড়া সাসপেন্স যুক্ত করে হিচকক তার সিনেমার গল্প দাঁড় করান।
সাসপেন্স তৈরিতে হিচককের মাস্টারি ভালোরকম চোখে পড়ে ব্ল্যাকমেইলে, যা পরের সিনেমাগুলো দিয়ে ধীরে ধীরে অনন্য এক উচ্চতা ছুঁয়েছে। ব্ল্যাকমেইলের অতি সাধারণ গল্পও টানটান উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠে তার মাস্টারিতে। কারণ সাসপেন্স তৈরির ক্ষেত্রে হিচকক সবসময় দর্শককে পর্যাপ্ত তথ্য দেওয়ার দিকে নজর দেন। কোনো তথ্য খোলাসা না করে শক দেওয়ার চাইতে, তথ্য দিয়ে সাসপেন্সের চরমে নিয়ে যাওয়াটাই তার লক্ষ্য। দর্শককে ম্যানুপুলেশনের শ্রেষ্ঠ উদাহারণ তো এক ‘ভার্টিগো’ (১৯৫৮) দিয়েই দেওয়া যায়। ব্ল্যাকমেইলের প্রথম দৃশ্যটিতেই সাসপেন্সের একটা উদাহারণ দেওয়া যাক, দুই গোয়েন্দা যখন নিঃশব্দে অপরাধীর অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকল, অপরাধী তখন পত্রিকায় মুখ গুঁজে বসে আছে। পত্রিকা না নামিয়ে ঘরের অন্যপাশে রাখা ছোট আয়নায় তাকিয়ে সে গোয়েন্দাদের প্রবেশের ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়। ঠিক তখনই ইনসার্ট শটে দেখানো হয়, তার বেডসাইড টেবিলে রাখা পিস্তলটি। হিচকক চাইলেই এখানে আগে থেকে পিস্তলের ব্যাপারটি না দেখিয়ে শকের উপাদান তৈরি করতে পারতেন।
কিন্তু পিস্তলটা দেখিয়ে দুই ফুট দূরত্বে দাঁড়ানো পিস্তলধারী দুই গোয়েন্দা আর অপরাধীর মাঝে একটা সাসপেন্সের মুহূর্ত তৈরি করেন। গোয়েন্দা আর অপরাধীর চোখের ক্লোজআপ আর ওদিকে ইনসার্ট শটে অপরাধীর হাত খুবই ধীরে ধীরে পিস্তলের দিকে বাড়ানো দেখিয়ে হিচকক জমজমাট একটা সাসপেন্সের মুহূর্ত এই স্বল্প জায়গা আর উপাদান দিয়েই তৈরি করেছেন। চরিত্ররা যতটা না জানে, তারচেয়ে বেশি দর্শককে জানিয়েই সত্যিকারের সাসপেন্সটা তৈরি করেন তিনি। আর এই সাসপেন্সের আবহ তৈরিতে বরাবরের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে আবহসঙ্গীত। আবহসঙ্গীত/শব্দ হিচককের সিনেমায় শুধু একটি উপাদান হয়েই নয়, বরং একটি বিষয় হয়ে অবস্থান করে। নাটকীয়তা তৈরিতে যেভাবে তিনি শব্দ ব্যবহার করতেন এবং করেছেন, এ সিনেমায় তা এখনো অভিভূত করে।
চিত্রনাট্যের বিষয়াদিতে; অ্যালিস চরিত্রটি দিয়ে অপরাধবোধ এবং তা থেকে তৈরী উদ্বিগ্নতার পাশাপাশি ফ্র্যাংক চরিত্রটি দিয়ে কর্তব্য আর ভালোবাসার মাঝে একটা দ্বিখণ্ডন করেছেন হিচকক। তিনি পরীক্ষা করেছেন এই দুটি বিষয়ের সহাবস্থানের ফলে সৃষ্ট দ্বান্দ্বিক প্রকৃতিকে, চরিত্রদের মনস্তত্ত্বকে। সেইসাথে আইনে দুর্নীতির অনুপ্রবেশের বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন।
হিচকক সন্দেহাতীতভাবেই একজন ভিজ্যুয়াল ফিল্মমেকার। ভিজ্যুয়াল গল্পকথক তিনি। ভিজ্যুয়াল মোটিফের ক্ষেত্রে রূপকের ব্যবহার সচরাচরই তিনি তার সিনেমাগুলোয় করতেন। এ সিনেমার দীর্ঘ প্রারম্ভিক দৃশ্যটি ছাড়া, ক্রোয়ির অ্যালিসকে ঘরে নেওয়ার দৃশ্যে রূপকের আরেকটি দারুণ ব্যবহার তিনি করেছেন। অ্যালিস যখন ক্যানভাসে একটি মাথা আঁকে, ক্রোয়ি তার হাত থেকে ব্রাশ নিয়ে সেই অর্ধেক চিত্রটাকে পূর্ণাঙ্গ করে নারীর নগ্ন শরীর এঁকে। তার আসল উদ্দেশ্যটা কী, তা প্রতীকীভাবে এই নগ্ন চিত্র আঁকাতেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
সংলাপ দিয়ে নয়, বরং ইমেজারি দিয়ে গল্প এগিয়ে নেন হিচকক। আর সেক্ষেত্রে মিজ-অঁ-সেন অহরহই ব্যবহার করেছেন তিনি। প্রচুর বিবরণ ছড়িয়ে রাখেন এ প্রক্রিয়ায়। এই বিবরণগুলো নিখুঁতভাবে দর্শকের চোখে তুলে ধরতেই মিজ-অঁ-সেন ব্যবহার করতেন। ব্ল্যাকমেইলে সাসপেন্সটা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে কিছু কিছু অংশের রিয়েল লোকেশনে শ্যুট। হিচককের আগের, বিশেষত নির্বাক সিনেমাগুলোয় ‘জার্মান এক্সপ্রেশনিজম’ দ্বারা প্রচণ্ড প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। এ সিনেমায় আলোছায়া নিয়ে খেলা করার ক্ষেত্রে এক্সপ্রেশনিজমের ব্যবহার থাকলেও তুলনামূলক কম এবং তা অনেক সূক্ষ্ম আর পরিণত উপায়ে ব্যবহার করেছেন।
সিঁড়ির একটি শট এই সিনেমায় আছে, যে শট পরবর্তীকালে তার ট্রেডমার্ক স্টাইল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার সিনেমায় সিঁড়িগুলোও যেন আগাম বিপদ সম্বন্ধে জানে, একটা বাঁকানো রহস্য ধরে রাখে। অ্যালিসকে নিয়ে ক্রোয়ির সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠার দৃশ্যে একদম শুরুতেই লো-অ্যাঙ্গেলে অ্যালিসকে সামনে আর পেছনে সিঁড়িকে তারচেয়েও বিশাল অবস্থানে রেখে আসন্ন বিপদের সংকেত দেওয়া হয়। তারপর সিঁড়ি দিয়ে তাদের ওঠার সাথে সাথে ক্রেনে করে ক্যামেরাও ওঠে, সাসপেন্সের মাত্রাটাও চড়ে।
‘নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট,’ ‘স্যাবাটার,’ ‘ভার্টিগো’ এই সিনেমাগুলোর ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, একটা বিশাল আয়োজনের বা গ্র্যান্ড ক্লাইম্যাক্স দৃশ্য রাখেন হিচকক, যার শুরু এই সিনেমা দিয়ে। ব্ল্যাকমেইলের ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে পুলিশ আর অপরাধীর শ্বাসরুদ্ধকর ভাগদৌড়ের দৃশ্যটি ধারণ করেছেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। দৃশ্যটির গ্র্যান্ডনেসের কারণেই এটি শ্বাসরুদ্ধকর। সাথে গোটা সিনেমায় রিয়েল লোকেশনের চমকপ্রদ ব্যবহার এই ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যেই করেছেন।
আর তার প্রায় সিনেমার মতো এই সিনেমায়ও একটি ক্যামিও তিনি দিয়েছেন। হাস্যরসের খোরাক জাগায় তার ক্যামিও। সেদিক থেকে এটা বেশ শীর্ষেই থাকবে। পাতাল ট্রেনে বসে পত্রিকা পড়ার সময় এক পিচ্চি ছেলের বারবার তার টুপি টেনে নিতে চাওয়ার দৃশ্যটি ভীষণ হাস্যরসাত্মক।
শেষত, ‘ব্ল্যাকমেইল’ হিচককের সর্বাধিক পরিচিত কাজ এবং সেগুলোর মতো সমাদৃত না হলেও একজন ভিজ্যুয়াল নির্ভর গল্পকথক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা, সাসপেন্সের মাস্টারিতে হাত পাকানো, নতুন নতুন ফিল্মমেকিং টেকনিক নিয়ে নিরীক্ষার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। আর ব্রিটিশ সিনেমার সবাক হয়ে ওঠায় এটি একটি মাইলফলক তো অবশ্যই।