জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেকুব চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷
– পরানের গহীর ভিতর (সৈয়দ শামসুল হক)
ক্রিকেটের মাঠের বাজিকর নিয়ে নয় বরং ‘বাজিকর’ নামে ভারতীয় উপমহাদেশে খোঁজ পাওয়া যায় এক যাযাবর জাতির। হিন্দু, মুসলমান কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠিত ধর্মে অন্তর্ভুক্ত ছিল না এই জাতিগোষ্ঠী, তার ভাষা-সংস্কৃতি এমনকি ধর্মীয় আচার সে সংগ্রহ করেছে পথে পথেই। নিম্নবর্গের মানুষ হওয়ার কারণে এই যাযাবর বাজিকরদের নিয়ে লিখিত ইতিহাসের বেশ সংকট, এদের উৎপত্তি আর ছড়িয়ে যাওয়া নিয়ে আছে নানা মতামত।
বৃহত্তর বাংলার উত্তরাঞ্চলে এদের পাওয়া গেছে দীর্ঘদিন, সেখানের হাটেগঞ্জে ঘুরে নানাবিধ খেলা দেখানো, দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, নানাপ্রকার শারীরিক কসরৎ, ভেলকি লাগিয়ে টাকা দ্বিগুন করে দেওয়া কিংবা ভানুমতির খেলার নানান ভোজবাজি দেখিয়ে গেছে তারা। পাশাপাশি বানর, ঘোড়াসহ নানা পশুপালনে তারা ছিল দক্ষ। দক্ষতা ছিল সেসব প্রাণীদের দিয়ে খেলা দেখাতেও। মেলা, উৎসব কিংবা সমৃদ্ধ লোকালয়ের খোঁজে তার যাত্রা ছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায়।
কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে এই বাজিকর চায় স্থায়ী হতে, এক টুকরো ভূমির সন্ধান করে। তার যেহেতু কোনো ধর্ম নেই সে আশ্রয় নিতে পারে না সেখানে, তার মাঝে কোনো জাত নেই, পথে পথে সে সংগ্রহ করেছে নানা দেবতা, তার গায়ে সবচেয়ে শক্তভাবে লেগে আছে তার পূর্বপুরুষের স্মৃতি। সমাজে অন্তর্ভুক্ত হতে চেষ্টা করে ক্লান্ত বাজিকরের স্থায়ী হওয়ার এক তীব্র বাসনার উপাখ্যান ‘রহু চণ্ডালের হাড়’।
অভিজিৎ সেনের এই উপন্যাসটির কাঠামো নির্মিত হয়েছে এক বাজিকর জাতির ইতিহাসকে কেন্দ্র করে। সামাজিক বিন্যাসের তলানিতে থাকা এই জাতির সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা আর তাদের প্রতারিত হওয়ার দীর্ঘ এক উপাখ্যান হিসেবে ধরা দিয়েছে এটি, এবং এর মাঝে লেখকের কল্পনা আছে এবং এখানেই হয়তো এই উপন্যাস ইতিহাস থেকে আলাদা।
বাজিকর কারা, কি তাদের পরিচয়?
ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস ওয়াইজ বাংলার বৈচিত্রপূর্ণ মানুষকে পর্যবেক্ষণ করে, তাদের ইতিহাস অনুসন্ধান করে ‘নোটস অন দি রেসেস, কাস্টস এন্ড ট্রেডস অফ ইস্টার্ন বেঙ্গল’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। ১৮৮৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত এই বইয়ে বাংলার ‘বেদে’ বা ‘বাদিয়া’ জনগোষ্ঠীকে সাতভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই সাতটি ভাগ যথাক্রমে ‘বেবাজীয়’, ‘বাজিকর’, ‘মাল’, ‘মিরশ্চিকার’, ‘সাপুড়িয়া’, ‘সান্দার’ এবং ‘রসিয়া’। তার মতে বেদে শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত ‘ব্যাধ’ থেকে, যারা পশুপাখি শিকার করে। বিভিন্ন পশুর চামড়া, হাড়, দাঁত কিংবা অংশ ব্যবহার করে চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করে তারা।
১৬৩৮ সালে আরাকান থেকে বল্লাল রাজ নামের এক রাজা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে আসেন। ধারণা করা হয়ে থাকে তার সাথেই বাংলার প্রবেশ করেছিল বৈদ্যরা। কালক্রমে তারা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে নদী বিধৌত পূর্ববঙ্গে সাপের আক্রমণ থেকে বাঁচতে টোটকা সংগ্রহে তাদের দ্বারস্থ হতে হয় বলে তাদের খ্যাতি ছিল বেশি। সময়ের পরিক্রমায় বৈদ্য বা বেদে সমাজের মাঝে নানা পেশার সূত্রপাত ঘটতে থাকে। আবার ছোটখাটো গোষ্ঠীভিত্তিক যাযাবর তাদের সাথে মিলে গেছে, বাজিকরদের ক্ষেত্রে এমনটি হয়ে থাকার সম্ভাবনা আছে।
তবে শুধু জেমস ওয়াইজই নয়, ব্রিটিশ আমলে বিভিন্ন আদমশুমারি কিংবা জনসংখ্যা গণনার সময়ে এই যাযাবরদেরকে শ্রেণিবিন্যাস করার চেষ্টা করা হয়েছে। কাগজে কলমের গবেষণায় দেখা গিয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই যাযাবর জাতিগুলো নিজেদের মধ্যে বিভিন্নভাবে যুক্ত, কিন্তু এদের প্রত্যেকের আলাদা হয়ে উঠার গল্প উপাখ্যান আছে।
প্রতিটি আলাদা পেশাবিন্যাসের পেছনে আছে স্বতন্ত্র কাহিনী। নিজেদের মধ্যে চালু আছে পুরাকথা, যেমন বাজিকরদের মধ্যে চালু আছে এক প্রত্যাশিত ভূমির স্বপ্ন। এদের পুরাকথা আর কাহিনীতে মিশে আছে এদের পূর্বপুরুষের বাণী, অনেকটা পয়গম্বরের মতোই। আদমশুমারি হোক কিংবা জনসংখ্যা গণনা, তাতে উঠে আসে না একটি জাতির গল্প আর উপাখ্যান, তারা চাপা পড়ে থাকে সবার অগোচরে।
বাজিকরের আদিপাপ
‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাসের কথক লুবিনি নামের এক বৃদ্ধা, তার মুখে উঠে আসে যাযাবর বাজিকরের দেড়শো বছরের দীর্ঘ পরিক্রমা। নাতি শারিবাকে সে বাজিকরের দিনযাপনের মৌখিক ইতিহাস বলে যায়, কীভাবে তারা গোরখপুর, রাজমহল, মালদা, নমনকুড়ি, রাজশাহী, আমুনাড়া, পাঁচবিবি সহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। এর কিছু লুবিনির চোখে দেখা, কিছু শুধুই মুখে মুখে বেঁচে থাকা ইতিহাস।
বাজিকরের নতুন প্রজন্ম যখন জানতে চায় কেন তাদের এই ঘুরে বেড়ানো তাদেরকে কেন দুর্ভাগ্য তাড়া করে বেড়ায়? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সে নিয়ে আসে আদিপাপের ধারণাও। তাদের এক নেতা ও আদিপুরুষ পালি, সে পুরা নামের এক নর্তকীকে বিয়ে করায় তাদের গোত্রে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কারণ পুরার বিরুদ্ধে থাকা একদলের ধারণা পালি তার বোন। এই বিয়েকে কেন্দ্র করে পালির সমর্থক এবং তার বিরোধীদের মাঝে কলহে প্রচুর রক্তপাতের শুরু হয়, এই ঘটনায় দেবতারা রুষ্ট হয়। নেমে আসে দেবতার অভিশাপ, সে এক মৃত্তিকায় দুইবার পা দিতে পারবে না, একই জলাধারের পানি দ্বিতীয়বার তার জন্য বিষাক্ত হয়ে যাবে।
এই আদিপাপের কল্পিত বোঝা তার মাথায় বদ্ধমূল, এবং প্রতিটি জায়গায় তার সাথে হয়ে যাওয়া অন্যায়কে সে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই মোকাবেলা করে, তার পশু কেড়ে নিলে কিংবা তার দলের নারীকে ছিনিয়ে নিলে তার আপোষ করে লোকালয় ছাড়তে হয়, আদিপাপের দায় নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায়।
কেন থিতু হতে চায় যাযাবর?
আদিপাপের বোঝা নিয়ে মানুষ চলতে থাকলেও তাকে থামতে হয় বাস্তবতার সামনে এসে, যেখানে তার রোজগার করতে হয়। দলপতি পীতেম বাজিকরকে তার পূর্বপুরুষ দনু জানায় এবার তাকে স্থির হতে হবে, পথে বাড়ছে অশান্তি। সামনে কোথাও একটু জমি মিলবে, যেখানে ঘর তুলতে পারবে বাজিকর, এই আশা মনে নিয়ে পথে পাড়ি দেয় দলটি এবং প্রতিটি নতুন এলাকায় যাবার সাথে সাথেই তার সামান্য রোজগারে ভাগ বসায় দারোগা, সেই এলাকার প্রভাবশালী লোকেরা।
ইতিহাসের পরিক্রমায় লেখক এই সম্প্রদায়কে ভারতবর্ষের অনেকগুলো অস্থির সময়ে এনে হাজির করেছেন। সাঁওতালদের সাথে বন্ধুত্বের সুবাদে সে বুঝতে পারে জমির ধান যখন ঘরে উঠে, তার পাকা গন্ধে চারদিকে মৌতাত শুরু হয়, তাকে কেন্দ্র করে এই নেশার সৃষ্টি হয়।
পৃথিবীর আদি মানুষেরা ঠিক এই কৃষিকাজের মধ্যে দিয়েই, ফসলের বুকভরা গন্ধেই স্থায়ী হয়েছিলেন, তবে যাযাবর বাজিকর মনে করে, “গেরস্থ হওয়ার মানে বাঁধা জানোয়ার”। তবে তার মনে আশা দানা বাঁধে রহু হয়তো তাদেরকে এক প্রত্যাশিত ভূমিতে নিয়ে যাবে যেখানে তারা স্থায়ী হতে পারবে, সমাজ তাদেরকে মেনে নেবে। আশা ছিল সাঁওতালদের সাথে ভাতৃত্বের সুবাদে হয়তো তাদের পাশে ঠাই গাড়তে পারবে, কিন্তু সাঁওতাল বিদ্রোহের পর সাঁওতাল এলাকা ছেড়ে পালাতে হয় তাকে। তার সামনে বিপদও বাড়তে থাকে।
তবে গঞ্জের বাজারে খেলা দেখিয়ে বেড়ানো বাজিকরের সামনে ঘনিয়ে আসতে শুরু করে বিপদ। তার দলের বাইরে সে ছেলে মেয়ে বিয়ে দিতে পারে না। হিন্দু কিংবা মুসলমান সমাজের কেউ তাকে গ্রহণ করে না। দলের বাইরের কারো সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে সে তার ইতিহাসে বারবার জন্ম দিয়েছে সামাজিক সমস্যার, বাজিকরের ঘরের রমণীকে গৃহিনী করে না নিলেও তাকে ভোগের বস্তু বানিয়ে নিতে আপত্তি নেই প্রভাবশালীদের।
ধর্মের প্রশ্নে নতুন পরিচয়সংকট বাজিকরদের
দুয়েক প্রজন্ম ধরে বাজিকর চেষ্টা করেছে ভোজবাজি পাশে রেখে, ঘোড়া-বানর-ভাল্লুককে পাশ কাটিতে, রহুর হাড় ঝোলায় রেখে কৃষিকাজে নামার। জলাভূমিতে হালচাষ করে সে চেষ্টা করেছে ফসল ঘরে তোলার। তাও সামাজিক সমস্যা তার পিছু ছাড়েনি। ভারতজুড়ে শুরু হয়েছে হিন্দু আর মুসলমানের দ্বন্দ্ব। সে কোন দলের অন্তর্ভুক্ত, প্রশ্ন উঠেছে এই নিয়েও। পথে সে সংগ্রহ করেছে ‘বিগামাই, কালীমাই আর ওলামাই’। তাও এগুলো তার নিজের দেবতা হয়ে উঠতে পারেনি।
ভারতভাগের পর সেই দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হয়েছে, সমাজের নিম্নবর্গীয় এই গোষ্ঠীর এক পরিচয়সংকটে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। এই দিক থেকে ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ শুধুমাত্র একটি যাযাবর জাতির কথা নয়, বৃহত্তর ভারতবর্ষের প্রতিটি যাযাবর জাতির কথা। যারা নিজের নামে ভূমি পত্তন করিয়ে নিতে পারেনি, যারা নিজেদেরকে বৃহত্তর সমাজের সাথে যুক্ত করতে পারেনি, তাদের মাথা গোঁজার কোনো ঠাই নেই। তাদেরকে পদানত রাখতেই সমাজের স্থিতিশীল গোষ্ঠী তাদেরকে দমিয়ে রেখেছে চিরদিন। উপন্যাসের চরিত্র লুবিনির জবানিতে এই ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে এভাবেই,
“মানুষ চায়, বাউদিয়া বাউদিয়াই থাকুক, বাজিকর বাজিকরই থাকুক। তার আবার ঘর গেরস্থালী কি?”
উপন্যাসের পেছনে
ঔপন্যাসিক অভিজিৎ সেনের বাজিকরদের এই আখ্যান লিখতে আগ্রহী হয়েছিলেন তাদেরকে কাছ থেকে দেখার সুবাদে। পশ্চিম বাংলার উত্তর দিনাজপুরে কাজের সুবাদে বালুরঘাটে কয়েকটি গ্রামে টিকে থাকা বাজিকরের সাথে তার দেখা হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ হয়েছে মৌখিক আখ্যান। তাদের পূর্বপুরুষ রহু’র কথা। কোনো কোনো বিশ্লেষক এই রহুকে সেমেটিক ধর্মগুলোর পয়গম্বরের সাথে সাদৃশ্য টেনে দেখিয়েছেন, যিনি আশা দেখিয়ে যান এক প্রত্যাশিত ভূমির। যে ঈশ্বরের মতো সর্বশক্তিমান নয়, তার কাছে ভালো মন্দ সমর্পণ করতে পারে না এই বাজিকরেরা শুধু আশা করে সংকেত পাওয়ার, স্বপ্নে নির্দেশ পাওয়ার।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বেশ সাড়া ফেলে এই উপন্যাস, ১৯৯২ সালে এই উপন্যাসের ‘বঙ্কিমচন্দ্র স্মৃতি পুরষ্কার’ পাওয়ার পর আলোচনাও শুরু হয় এটি নিয়ে। বাংলাদেশের আরশিনগর থিয়েটারের চেষ্টায় দীর্ঘকায় এই উপন্যাসটিকে মঞ্চস্থও করা হয়েছে।
যাযাবর জাতির আদিপাপের মর্মবেদনা, তাদের সমাজ থেকে অচ্ছুৎ হয়ে থাকার যে বাধ্যবাধকতা, এই উপাদানগুলো তাদের ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের মুখে। বৃহত্তর সমাজের সাথে মিশতে গিয়ে নিজের অনন্য যে সাংস্কৃতিক উপাদান ছিল তার বিসর্জন দিতে হচ্ছে তাকে। এই দিকটি সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাসে। এর প্রেক্ষাপট নিয়ে অভিজিৎ সেনের নিজের মন্তব্যটি হলো,
“রহু চণ্ডালের হাড় শুধু এক শ্রেণীর যাযাবরের জীবন-সংগ্রামের কাহিনী নয়। এই যাযাবরগোষ্ঠী, আমার উপন্যাসে যার নাম বাজিকর, তাদের এক-দেড় শ বছরের ঘোরাফেরাকে কেন্দ্র করে আমি একটি বিস্তৃত এলাকার ঐ সময়ের ইতিহাস, সমাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়কে টুকরো টুকরো করে তুলে এনেছি।”