ধ্রুব আর প্রীতি; ছেলেকে নিয়ে একটা আলাদা বাড়িতে থাকে। প্রয়োজনের তাগিদেই পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে তারা ভাড়া বাড়িতে এসেছে। প্রথমে বাবা আর তিন ভাই মিলে সেই বাড়িতে থাকত। সময়ের সাথে সাথে মানুষ বাড়ে। একে একে তিন ভাই বিয়ে করে, তাদের সংসার বাড়ে। মানুষ বাড়ে। আস্তে আস্তে সব বদলে যেতে থাকে, তাই ধ্রুব বেশ নিরুপায় হয়েই এক ভাড়া বাড়িতে ওঠে।
ভাড়া নিতে এসে সে আবিষ্কার করে, বাড়িওয়ালা তাদের নিজের বাড়ির এককালের ভাড়াটিয়া। বেশ আগে ছোট্ট এক উপকার করেছিল ধ্রুব সেই ব্যক্তির। সেই উপকার তিনি আজও মনে রেখেছে। যদিও বেশ অবজ্ঞাভরেই সেই উপকার করেছিল ধ্রুব। কিন্তু, রাখালবাবু মনে রেখেছিলেন। আর তাই ধ্রুবর সাথে ভালোই সখ্য ছিল তার। এককালে তিনি ছিলেন ধ্রুবদের ভাড়াটে, আজ ধ্রুব আজ তার ভাড়াটে। এভাবেই বাড়ি বদলে যায়, মালিক বদলে যায়।
সব ভালোই চলেছিল। কিন্তু ছোট্ট এক ঘটনা বদলে দিল সব। রাখালবাবুকে একপ্রকার এড়িয়ে চলতে থাকে ধ্রুব। কিন্তু কেন? কী ঘটেছিল? এখন কী হবে? এখন কি ধ্রুব আবার ফিরে যাবে নিজের সেই পুরনো বাড়িতে? আবার বদলে যাবে বাড়ি? এদিকে নানাভাবে দালালের খপ্পরে পড়ে ধ্রুব। এর পরিণতিই বা কী?
১৯৮৬ সালে রচিত এই উপন্যাস। মধ্যবিত্তদের নিত্যদিনের এক প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি পরিবার নিজেকে প্রীতি বা ধ্রুবর সাথে মেলাতে পারবে। যেমন ধরুন, কাজ শেষে কষ্ট করে ট্রামে-বাসে বাড়ি ফেরা, দেয়ালে একটা পেরেক গাঁথতে গেলেও বাড়িওয়ালার অনুমতি নেয়া, পানি-বিদ্যুতের কষ্ট, রান্নার গ্যাসের কষ্ট। কিছু কিছু পরিবার তো আরো নানা ধরনের সমস্যায় ভোগে, যেমন- মাথার উপর মসলা বাটার শব্দ, চেয়ার টানার শব্দ, বদ্ধ ঘরে কাপড় শুকানোর কষ্ট। এগুলো আসলে লিখে বা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
এটা গেল ভাড়াটেদের পক্ষ থেকে। কিন্তু ভেবে দেখুন তো একজন বাড়িয়ালা কেন এরকম করে? নিজের কষ্টের টাকায় যত্ন করে করা বাড়িতে কেউ এসে একের পর এক পেরেক যেন মনে হয় নিজের গায়ে কেউ পেরেক পুঁতছে। অনেক কষ্টের টাকায় করা বাড়িতে একজন এসে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করলে কেমন লাগতে পারে? পলেস্তারা তুলে ফেলছে, মেঝেতে শিল-পাটা দিয়ে আঘাত করছে। নষ্ট করছে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ। নিজের সন্তানের গায়ে কেউ হাত তুলুক সেটা যেমন কেউ চায় না, সেরকম নিজের কষ্টের টাকায় করা বাড়ির বুকে কেউ আচড় কাটুক কেউ কি তা চায়?
বইটি আসলে মধ্যবিত্ত বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া দুই পক্ষের মানুষের জন্য। এত সুন্দর করে সবার পরিস্থিতি লেখক বর্ণনা করেছেন, সেটা না পড়লে বোঝানো যাবে না। খুব ছোট্ট বই, কিন্তু একজন মধ্যবিত্তের জীবনের পুরো গল্প লেখক তুলে ধরেছেন।
নিজেকে যদি আপনি রাখালবাবুর আসনে বসান, সেখান থেকে দেখবেন ধ্রুবকে। ধ্রুবর করা সেই যে ছোট্ট উপকার মনে হবে অনেক বড় কিছু। আবার অন্যদিকে যদি ধ্রুব বা প্রীতি ভাবেন, তাহলে দুনিয়া পুরো পাল্টে যাবে। এই যে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়ার এক সম্পর্ক, সেটা শুরুতে শুরুতে ভালো থাকে অনেক ক্ষেত্রে, আবার শুরু থেকেই কখনও কখনও দ্বন্দ্ব থাকে। কিন্তু সময়, পরিবেশ, পরিস্থিতি সব কিছু বদলে যায় ।
কখনও কখনও এই সম্পর্কগুলো মধুর হয়, কখনও কখনও তিক্ত। বিপদে এই প্রতিবেশিরাই কিন্তু এগিয়ে আসে আগে।
বইয়ে লেখক এত সুন্দর করে প্রতিটি পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন যে, পাঠকমাত্রই মুগ্ধ হবে। যদি আপনি বইপড়ুয়া না-ও হন, তবু এই বই আপনার পড়া উচিত। আপনি কোন বয়সের সেটা বিষয় না, আপনি ধনী না মধ্যবিত্ত সেটাও বিষয় না, বিষয় হলো নিজের একটা ছাদ, যে ছাদের জন্য কত কিছু ঘটে যায় দুনিয়ায়। সেই ছাদ কেউ পেলে তার মনের প্রশান্তি, আনন্দ কেউ বলতে পারবে না সে ছাড়া।
গল্পের নাম ‘বাড়ি বদলে যায়’, কিন্তু বাড়ি কি আসলেই বদলে যায়? বাড়ি কাকে বলে বলুন তো? চার দেয়াল আর একটা ছাদ? নাকি অন্যকিছু?
এখন হয়তো আমরা ভাবি, প্রতিবেশির সাথে দূরত্ব রেখে চলা দরকার। কিন্তু কেন বলুন তো? আগের মতো হয় না প্রতিবেশির সাথে সম্পর্ক। কিন্তু কেন জানেন? হ্যাঁ, আমি-আপনি জানি। আমরা বলতে চাই না, বলি না। কিন্তু লেখক বলেছেন। এত সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন, যেটা আমরা বলতে ভয় পাব। কেন তা জানেন তো?
অদ্ভুত এক উপন্যাস। কখন কী ঘটবে কেউ জানে না, অথচ পড়ার পর মনে হবে, “এটাই তো হবার ছিল!” এত চমক, এত সত্য কী সুন্দরভাবে লিখেছেন লেখক রমাপদ চৌধুরী!
একটা ব্যাপারে খটকা লাগে শুধু। বাবা-মায়ের জন্য কেউ কেন কিছু করে না? সন্তানের জন্য তো বাবা-মা সবই করেন। এই উপন্যাসের শেষটা নিজে যদি অন্যভাবে কল্পনা করে নিতে পারেন, তবে অন্যরকম অনুভূতি হবে।
তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, এই উপন্যাস যতটা সুন্দর, ততটাই আড়ালে রয়ে গেছে। খুব অল্প কিছু মানুষ এই বই সম্পর্কে জানে। যতদিন ‘মধ্যবিত্ত’ শব্দটি থাকবে, যতদিন মধ্যবিত্তদের জীবন থাকবে, ততদিন এই বই তাদের জীবন প্রকাশ করবে। যদি কেউ বলে- মধ্যবিত্তদের জীবন সম্পর্কে জানাতে পারে এমন একটা বইয়ের নাম বলুন, নির্দ্বিধায় এই বই পড়ার পরামর্শ দিতে পারেন।
লেখক অন্তত নিখুঁতভাবে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের জীবনকে তুলে ধরেছেন। এই কথাগুলো হয়তো আমরা বলতে চেয়েও বলি না, বরং বলা চলে- বলি না। কারণ ভয়, যদি বাড়ি বদলে যায়, যদি বাড়ি ছাড়তে হয়?
বই: বাড়ি বদলে যায়
লেখক: রমাপদ চৌধুরী
প্রকাশনী: আনন্দ পাবলিশার্স
প্রকাশকাল: ১৯৮৬