বইয়ের নামটি দেখে আপনি হয়তো প্রথমে ধরতে পারবেন না, এটি আসলে কোন ঘরানার বই। আঞ্চলিক ভাষায় লেখা সংলাপে পরিপূর্ণ ‘বিষণ্ণ জোছনা’ বইটি আমাদের জীবনের গল্প বলে। সম্পূর্ণ উপন্যাসটি একটি নির্দিষ্ট আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হয়েছে। গল্পের শুরুটা একদমই সাদামাটা হলেও ক্রমেই আপনি পাঠে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। একবার পড়া শুরু করলে বইয়ের পরতে পরতে থাকা ভাবধারা আপনাকে ঘিরে ধরবে। আপনি আবিষ্ট হয়ে পড়বেন বিষণ্ন জোছনার মায়াজালে। উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে অনেকগুলো চরিত্রকে ঘিরে। বইটি পড়া শুরু করলে একে একে দেখা মিলবে সিরাজ, মিরাজ, জোনাকি, সোনিয়া, মুনিয়া, বায়েজিদ, রত্না, জামান, সায়রা, আম্বিয়া, তারা বিবি, তৌফিক, ইমরান ইত্যাদি চরিত্রের।
চরিত্র তৈরি এবং কাহিনীর শাখা-প্রশাখা বিস্তার
উপন্যাসটির শুরু হয়েছে সিরাজ ও মিরাজ দুই ভাইয়ের সম্পত্তি সংক্রান্ত সালিশ-বিচরের মধ্য দিয়ে। এই সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে কাহিনী উত্তরোত্তর শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। শুরুটা দেখে মনে হয়, খুবই সাধারণ সাদামাটা। বর্তমান সমাজের বাস্তব চিত্রের প্রতিফলন। ঘরে ঘরে এখন সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া, বিবাদ, মারামারি খুনোখুনি লেগেই আছে। গ্রামীণ সমাজের এই অতি বাস্তব জীবনধারাকে তুলে এনেছেন লেখক সাঈদ আজাদ। মাটির জমি আর মাটির দেহ (মানবদেহ)-এর প্রতি মানুষের কী মোহ! কী অকৃত্রিম চাহিদা! উপন্যাসের শাখা বিস্তার করেছে এই মানুষ আর মাটির মোহকে ঘিরে। উপন্যাসের চিত্রপটে এসব চিত্র চিত্রিত হয়েছে লেখকের কলম কৌশলে। যৌনতা এবং যৌবন যে মানবজীবনের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ, তা লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন সমৃদ্ধ ভাষাশৈলীর মাধ্যমে।
চরিত্র বিশ্লেষণ
“জীবনের জোছনারা কেন স্থায়ী হয় না?”
বাক্যটার মাঝে এক বুক হাহাকার। জোনাকির হাহাকার। জোনাকি এ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র। গল্পে জোনাকির মধ্য দিয়ে এক সরল প্রেমিকার চরিত্রকে চিত্রিত করা হয়েছে। জোনাকিই মূলত এ উপন্যাসের নামের আড়ালে থাকা বিষণ্ন জোছনা, যার জন্য হাহাকার করে পাঠকের হৃদয়ও তার প্রেমিক তৌফিকের জন্য বলে উঠবে,
যাকে খুব সহজেই পাওয়া যেত তাকেই দুর্লভ করে ফেলেছে জীবন।
নিঃসন্তান আম্বিয়া উপন্যাসের অন্যতম এক চরিত্র। স্বামী-সন্তানের ভালোবাসা পায়নি সে। স্বামীর মৃত্যুর পরেও অমানবিক অত্যাচার সহ্য করে স্বামীর বাড়িতে স্বামীর কবরকে আঁকড়ে শুধু স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকে সে।
মানুষ মরে গেলে
একেবারে হারাইয়া যায় না।
কারো না কারো মনে ঠিকই
থাইক্যা যায়।
অপমান আর লজ্জার মধ্যেও জীবিকার তাগিদে এগিয়ে যায় জীবন। কিন্তু বৃদ্ধার মন যে অপমান, লজ্জাকে তোয়াক্কা করে না, সে ফিরে আসে তার চিরচেনা সেই গ্রামে, ঘটনাক্রমে পায় নতুন পরিচয়। ঔপন্যাসিক উপন্যাসের প্রয়োজনে চরিত্রের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটান। কিন্তু এ যেন এক বাস্তব চিরচেনা চরিত্র। আমাদের আশেপাশেই ছড়িয়ে আছে আম্বিয়ার মতো এমন হাজারও অসহায় নারী।
আছে বায়েজিদ, জামানের মতো সমকামী চরিত্র, যাদের আবির্ভাব ঘটিয়ে লেখক নিঃসন্দেহে কিছুটা সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। আছে সায়রার মতো দুঃখিনী গায়ের বধূর গল্প, যার আশ্রয় কেউ হতে পারে না।
বায়েজিদ, জামান, সায়রা, জোনাকি, তৌফিক, আম্বিয়ার মতো গ্রামীণ জীবনের সহজ-সরল মানুষগুলোর জীবনের জটিল দুঃখগুলো জানা যায় এ বইয়ে। মেলে গ্রামীণ পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীবনের স্পর্শ।
বিষণ্ন জোছনা ভালোবাসার উপন্যাস, যার মূলে আছে বিষাদ। এ ভালোবাসা মানে না লিঙ্গের বিভেদ, মানে না কোনো সামাজিক নিয়ম, মানে না কোনো বিধি-নিষেধ। তবুও ভালোবাসার মানুষগুলো দিনশেষে কোথাও না কোথাও আটকে যায় সামাজিক নিয়মের বেড়াজালে। তবু ভালোবাসা এগিয়ে যায় বহতা নদী কিংবা সময়ের নিয়মে।
পরিশেষে
লেখক তার এ বইটি নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তার আত্মবিশ্বাস অহেতুক ছিল না। তবে পুরো বই জুড়ে এত বেশি বানান ভুল সত্যিই দৃষ্টিকটু। কিছু জায়গায় চরিত্রের নাম পাল্টে গেছে। এ বিষয়ে লেখকের আরো সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত ছিল। হয়তো এসব দিকে আরও বেশি সময় দিলে বইটি আরো সফল ও জনপ্রিয় হতে পারত।
তবে উপন্যাসের ধরন, চরিত্র, পরিবেশ বর্ণনা, শব্দচয়ন, বাক্য গঠন প্রশংসনীয় ছিল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম। কাহিনীর শেষটুকুও অভাবনীয় ছিল। ঘটনাক্রমগুলো এমনভাবে সাজানো যাতে পাঠকের কাছে উপন্যাস বাস্তবের কাছাকাছি বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে অত্যুক্তিও মনে হয় একসাথে এত ট্র্যাজিক উপাদান, তবে বিষণ্নতাই যে এ উপন্যাসের মূল খুঁটি।
“সকল পূর্ণিমা এক নয়। কোনো পূর্ণিমায় মানুষ সব হারায়। কোনো পূর্ণিমায় মানুষ সব পায়। চাঁদের তাতে কিছু আসে যায় না। সে নিরাসক্ত থেকে নিজেকে নিঃশেষ করতে থাকে। পূর্ণিমা থেকে।”
[অনলাইনে বিষণ্ণ জোছনা কিনতে ক্লিক করুন]