রাত দশটা, সাড়ে দশটা, এগারটা এরকম করে ঘড়ির কাঁটা সেই সন্ধ্যা ৬টা থেকে পাঁচ বার ঘন্টার ঘরটি বদল করলো। কিন্তু বাড়ির মেয়েটি এখনো বাড়ি ফেরেনি। অপেক্ষায়, অস্থিরতায়, দুশ্চিন্তায় বাবা ঘরময় পায়চারি করছেন। আর মা বারবার মেয়ের বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের ফোন দিয়েই চলেছেন। এক সময় মেয়েটি বাড়ি ফিরে এলে স্নেহবৎসল ভর্ৎসনা জোটে তার কপালে। নিয়মিত এই দুশ্চিন্তা সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হয়েই মেয়েটিকে তার ক্যারিয়ারের ইতি টানতে হয়।
প্রতিকূল পরিবেশে নিজের মানসম্মান, ক্যারিয়ার ও পরিবারের সাথে মানিয়ে চলার ঝক্কি পোহাতে হয় না এমন কর্মজীবী নারী বেশ দুর্লভ। আরও রয়েছে সমাজের বাঁকা দৃষ্টি ও তাক করে থাকা আঙ্গুল। ঠিক এমনই একটি সাধারণ অথচ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯) নামক ভিন্নধর্মী বাংলা চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র নির্মাতা মৃণাল সেন।
ব্যক্তিগত জীবন
তৎকালীন পশ্চিম বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) অন্তর্গত ফরিদপুর জেলায় ১৯২৩ সালের ১৪ মে মৃণাল সেন জন্মগ্রহণ করেন। আর মৃত্যুবরণ করেন ৯৫ বছর বয়সে, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর কলকাতায় নিজ বাড়িতে। ‘ইন্ডিয়ান পিপলস্ থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন’ এর সাথে কাজ করার সময় তার পরিচয় ঘটে, ব্যক্তিগত জীবনের সবচেয়ে নির্ভরশীল এবং পেশাগত জীবনের কঠোর বিশ্লেষক ও সমালোচক অভিনেত্রী গীতা সোমের সাথে। ৭ বছরের প্রণয়ের পরে ১৯৫৩ সালে তারা বিয়ে করেন। কুণাল সেন তাদের একমাত্র সন্তান। গীতা, মৃণালের বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন।
বাংলা চলচ্চিত্রে সমসাময়িক সমাজের বাস্তবতাকে নির্ভীক ও স্বচ্ছভাবে তুলে ধরে তৎকালীন চলচ্চিত্র বিপ্লবের তিন কান্ডারী হলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেন। সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটক অনেক আগেই এই পৃথিবীকে চিরবিদায় জানিয়েছেন। আর মৃণাল সেনও এখন যোগ দিয়েছেন তার এক সময়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ও প্রতিদ্বন্দ্বী তথা সমালোচকদের দলে।
প্রারম্ভিক পেশাগত জীবন
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পড়া শেষ না করেই মৃণাল তৎকালীন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। একই সাথে ‘ইন্ডিয়ান পিপলস্ থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন’ এর সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন। পেশাগত জীবনের শুরুতে বিভিন্ন সময়ে তিনি সাংবাদিক, ওষুধ বিক্রেতা এবং চলচ্চিত্রের সাউন্ড টেকনিশিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আমার কাজ ছিল শুধু ক্যাপাসিটর ও কন্ডেন্সার জোড়া লাগানো। কাজটা আমার মোটেও ভাল লাগতো না বলে আমি তা ছেড়ে দিই। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যে সাউন্ড রেকর্ডিং এর কৌশল সম্বন্ধে আমার জানা থাকা উচিত। তাই আমি সে ব্যাপারে পড়াশোনা শুরু করি।
– মৃণাল সেন (১৯৭০ সালের গোড়ার দিকে সিনেয়্যাস্ট ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা গ্যারি ক্রাউডাসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের অংশ)
কোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলে এবং সে সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার জন্য ব্যক্তিগতভাবে পড়াশোনা করার এই বৈশিষ্ট্যই তাকে চলচ্চিত্র জগতে টেনে আনে। ১৯৪৩ সালে আর্নস্ট হেম এর রচিত ‘ফিল্ম অ্যাজ আর্ট’ বইটি পড়ার পরই চলচ্চিত্রের ব্যাপারে এতটাই আগ্রহী হয়ে পড়েন যে, এ বিষয়ে তিনি যতগুলো বই পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, তার সবগুলোই পড়ে শেষ করেন। এভাবেই চলচ্চিত্র বিষয়ে একজন সাংবাদিক হিসেবে তিনি কিছুদিন লেখালেখিও করেন। তবে সেসব লেখা থেকে অর্থ উপার্জন ছিল নিতান্তই নগণ্য। ৪০ এর দশকের কলকাতায় চলচ্চিত্র জগতে বিপ্লব ঘটেছিল। এরই একটি অংশ ছিল সত্যজিৎ রায়ের প্রতিষ্ঠিত ‘কলকাতা চ্যাপ্টার’ নামক একটি সংঘ। কিন্তু এর সদস্য হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সেসময় মৃণালের ছিল না।
চলচ্চিত্র নির্মাণে বিপ্লবী কান্ডারী
আমি দুর্ঘটনাবশত চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করি, আর বাধ্য হয়েই লেখালেখি করি।
লেখালেখিতে বোধ হয় বেশ হতাশ হয়েই তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কারণ লেখার মাধ্যমে তার বক্তব্য বা মনের ভাব কোনোটাই যথাযথভাবে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। ১৯৫৬ সালে নির্মিত রাত ভোর ছিল তার প্রথম চলচ্চিত্র। আর এটি নিয়ে পরবর্তীকালে তিনি বেশ হতাশ ছিলেন। এরপর ১৯৫৯ সালে এলো নীল আকাশের নিচে আর বাইশে শ্রাবণ। ‘রাত ভোর’ এর নির্মাণ সম্পর্কে মি. ক্রাউডাস কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মৃণাল সেন বলেন –
অত্যন্ত বাজে একটি কাজ ছিল।
মৃণাল সেন বরাবরই রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তার চলচ্চিত্রের মূল বিষয়ই ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়। মানুষের তথা দর্শকদের দৈনন্দিন হাঁফ ধরা জীবনে একটুখানি বিনোদনের ব্যবস্থা করা তার চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দ্যেশ্য ছিল না, বরং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরে বিবেককে জাগ্রত করাই ছিল তার মূল লক্ষ্য।
তার চলচ্চিত্রে মার্ক্সিয় প্রভাব সর্বত্র বিরাজমান। কিন্তু তার গল্প প্রকাশের মূল প্রক্রিয়াটি বুঝতে হলে গল্পের বিভিন্ন পর্যায় একে একে অতিক্রম করতে হবে। এতে তৎকালীন বঞ্চিত শ্রেণীর প্রতি তার সহানুভূতি ও মধ্যবিত্ত সমাজের মিথ্যা জীবনযাপন পদ্ধতির প্রতি কটাক্ষ, সহজেই নজরে পড়বে। তার নির্মাণ কৌশলে তৎকালীন বামপন্থি সরকার ব্যবস্থা ও শ্রেণী বৈষম্য দূরীকরণে এর ব্যর্থতার প্রতি তীব্র সমালোচনা লক্ষ্যণীয়।
আমার উদ্দ্যেশ্য যথাসম্ভব সরাসরি ও স্বচ্ছভাবে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দর্শকদের উদ্দীপ্ত করা। একজন নির্মাতাকে একজন ‘উসকানিদাতা’ হয়েই দর্শকদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করতে হবে, যেন তারা প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
– মৃণাল সেন (২০০৩ সালে সোমা এ. চ্যাটার্জী রচিত প্রকাশনার ৩১ নং পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত)
১৯৬৫ সালে আকাশ কুসুম নির্মাণের মাধ্যমে একজন মধ্যবিত্তের উচ্চাভিলাষ ও তা প্রাপ্তির জন্য যেকোনো পন্থা অবলম্বনের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রতিটি মধ্যবিত্তের মনে সুপ্ত রয়েছে তাকেই তুলে ধরেন। কারো কারো মতে, এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তিনি নিজের মধ্যবিত্ত ব্যক্তিসত্ত্বা ও এক সময়ের অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা দূরীকরণের অভিপ্রায়ও প্রকাশ করেছিলেন। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তৈরি সত্যজিৎ রায় আর মৃণাল সেন এর মধ্যকার বাক-বিতণ্ডা আলোচনার ঝড় তুলেছিল।
তৎকালীন চলচ্চিত্র জগতের প্রথাগত গল্পের বাইরে গিয়ে সমাজের বাস্তবতার গল্প এবং স্বকীয় নির্মাণ শৈলীর কারণেই মৃণাল নির্মিত ভুবন সোম (১৯৬৯) তথাকথিত বিনোদনমূলক চলচ্চিত্রের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ছিল। এই চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক সাফল্যের মাধ্যমেই ‘নিউ ইন্ডিয়ান সিনেমা’ নামে সমসাময়িক ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে বিপ্লব ঘটেছিল। এই বিপ্লবের অনুসারী নির্মাতাদের সকলের চলচ্চিত্র ভিন্নধর্মী হলেও, প্রকাশ্যে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত নির্মাণ শৈলীর কারণে মৃণাল তাদের মাঝেও স্বকীয়তা বজায় রেখেছিলেন।
তৎকালীন কলকাতার রাজনৈতিক পরিবেশ বিভিন্নভাবে সমাজের শ্রেণী বৈষম্যকে আরও প্রকট করে তুলেছিল, যার বহিঃপ্রকাশ মহাদেবী বর্মা, কালিন্দী চরণ পাণিগ্রাহী, প্রেমচাঁদ ও সমরেশ বসুর মতো লেখকদের সাহিত্যে ফুটে উঠেছিল এবং এসবই মৃণালের চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। এর ফলস্বরূপ দর্শকদের সামনে উপস্থাপিত হয় কলকাতা ৭১ (১৯৭১), ইন্টারভিউ (১৯৭১) ও পদাতিক (১৯৭৩); মৃণাল সেন নির্মিত তিন পর্বের চলচ্চিত্র সমগ্র, যেখানে কলকাতার আবেগময় পরিবেশের পাশাপাশি তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যাভিচারকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই সাথে এর প্রেক্ষিতে নির্মাতার ব্যক্তিগত অবস্থানও স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছিল।
তবে সামাজিক বাস্তবতা নির্ভর চলচ্চিত্রে মৃণালের সবচেয়ে স্মরণীয় ও আলোচিত সৃষ্টি ছিল ১৯৭৯ সালে নির্মিত একদিন প্রতিদিন। এই গল্পের বিষয়বস্তু ছিল তৎকালীন মধ্যবিত্ত সমাজের এক কর্মজীবী নারীর বাড়ি না ফেরার আকস্মিক দুর্ঘটনা এবং তার পরিবার ও অন্যান্যদের উপর এই দুর্ঘটনার প্রভাব। গল্পে মেয়েটি ঐ নির্দিষ্ট দিনে ঠিক কোথায় গিয়েছিল তা স্পষ্ট জানা ছিল না। কিন্তু সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব ও আমাদের আশেপাশের ‘শত্রুদের’ প্রতি ছিল সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। মৃণাল সেন নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে এটিই প্রথম কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়।
(‘একদিন প্রতিদিন’ নির্মাণের মাধ্যমে) আমি আমাদের আশেপাশে থাকা শত্রুদের দিকেই আঙ্গুল তুলেছিলাম। কিন্তু এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমার মাঝে আত্মোনুসন্ধান শুরু হয়। আর এই অনুসন্ধানই আমাকে আমার শত্রুদের মোকাবেলা করতে শেখায়।
– মৃণাল সেন (২০০০ সালে রেডিফ.কম নামক ভারতীয় ওয়েবসাইটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের অংশ)
১৯৮০ সালে আকালের সন্ধানে চলচ্চিত্রটি সেসময়ের বাংলার দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়। এতে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে গ্রামে দুর্ভিক্ষের প্রভাব খুঁজতে আসা একদল কলাকুশলীদের অভিজ্ঞতা ও মনোভাবকে তুলে ধরার মাধ্যমে মৃণাল নিজেকেই ব্যঙ্গ করেছিলেন। ১৯৮১ সালে এটি ‘বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ এ ‘সিলভার বিয়ার’ (বিশেষ জুরি পুরস্কার) লাভ করে।
১৯৮২ সালে নির্মিত খারিজ এর মাধ্যমে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চারিত্রিক বৈচিত্র্য ও শ্রেণী বৈষম্যকে তিনি আরও প্রকট করে তুলে ধরেছিলেন বাড়িতে কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়ায় এক ভৃত্য বালকের মৃত্যু ও তার শেষকৃত্য যাত্রার গল্পের মাধ্যমে। এই চলচ্চিত্রটি ১৯৮৩ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘বিশেষ জুরি পুরস্কার’ এ ভূষিত হয়। ১৯৮৪ সালে এটি নিউ ইয়র্কের ফিল্ম ফোরাম এ প্রদর্শিত হয়।
১৯৮৬ সালে নির্মিত জেনেসিস ছিল মৃণাল সেনের আরেক অমর কীর্তি। এতে একজন তাঁতী ও কৃষকের স্বকীয়ভাবে যাপিত শান্ত জীবনে একজন নারীর আগমনে তৈরি অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা কে প্রকাশ্যে তুলে ধরার মাধ্যমে, তিনি মানব চরিত্রের এক অদ্ভুত কিন্তু সদা বিরাজমান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছিলেন। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রখ্যাত অভিনেতা নাসির উদ্দীন শাহ দ্বিতীয় ও শেষবারের জন্য মৃণালের সাথে কাজ করেন। মৃণালের আপোষহীন নির্মাণ কৌশল ও বাস্তবতা নির্ভর গল্প অনেকাংশেই অভিনেতাদের বিরাগের কারণও হয়েছিল।
তিনি (মৃণাল সেন) ছিলেন সেসকল মুষ্টিমেয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন, যারা কাজের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত কোনোরকম আপোষ করতেন না। তার সাথে আমার দুইবার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। খান্ডার এর অভিজ্ঞতা বেশ আনন্দময় ছিল, কিন্তু জেনেসিস এর বেলায় তেমনটা হয়নি।
– অভিনেতা নাসির উদ্দীন শাহ্ (মৃণাল সেন এর মৃত্যুতে অনুভূতি প্রকাশে টাইমসনাউনিউজ.কম কে প্রেরিত মুঠোফোন বার্তার অংশ)
১৯৮৯ সালে নির্মিত একদিন আচানক এ এমন একজন অধ্যাপকের গল্প তুলে ধরা হয়েছে যিনি এক বৃষ্টির দিনে ঘর থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেননি। মৃণাল সেন নির্মিত মহাপৃথিবী (১৯৯২) তে অভিনেতা ভিক্টর ব্যানার্জী তার সাথে কাজ করেন। পরবর্তী চলচ্চিত্র ছিল অন্তরীণ (১৯৯৪)। আর মৃণাল সেন নির্মিত শেষ চলচ্চিত্র ছিল আমার ভুবন (২০০২)।
মৃণালদা’র মৃত্যুতে আমরা একই সাথে একজন কীর্তিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা ও একজন ভাল মানুষকে হারিয়েছি। জীবনে চলার পথে বিভিন্ন আঁকাবাঁকা পথ, শঠতা ও প্রতারণার মধ্য দিয়েই এরকম একজন প্রশংসনীয় মানুষের সাথে আমার পরিচয় ঘটে।
– অভিনেতা ভিক্টর ব্যানার্জি (মৃণাল সেন এর মৃত্যুতে অনুভূতি প্রকাশে টাইমসনাউনিউজ.কম কে করা মন্তব্যের অংশ)
মৃণাল, সত্যজিৎ ও ঋত্বিক
বাংলা চলচ্চিত্রে বিপ্লবের প্রবর্তক ও ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের কান্ডারী এই ত্রয়ী একই সময়কালে চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথে জড়িত ছিলেন। সমসাময়িক সমাজে মানুষের নীতিগত অবক্ষয় ও রাজনৈতিক দুর্নীতিই ছিল এই তিন জনের নির্মিত চলচ্চিত্রের মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু তাদের নির্মাণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল স্বকীয়তা।
আর এই স্বকীয়তা এতটাই প্রকট ছিল যে তাদের নির্মিত চলচ্চিত্রকে অটেয়ো ফিল্ম অর্থাৎ নির্মাতার ব্যক্তিসত্ত্বার পরিচায়ক হিসেবে নির্মিত চলচ্চিত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। সত্যজিৎ এর চলচ্চিত্রে মানবতাবাদের আদর্শে সংগীতের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সমাজের যে বাস্তব রূপ দেখা যায়, সে কারণে তাকে ইউরোপীয় নির্মাতাদের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে।
অন্যদিকে সমাজ ও বাস্তবতার নিজস্বতার মধ্য দিয়ে সংগীতের সাহায্যে ঋত্বিক তার মতামত প্রকাশ করতেন। সংগীত তার চলচ্চিত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান ছিল। এই দুই জনের থেকেই মৃণাল ভিন্ন ছিলেন তার প্রত্যক্ষ বক্তব্য প্রকাশের কারণে।
একজন মানুষের মৃত্যুতে তাকে নিয়ে পর্যালোচনা করার জন্য যখন তার ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে কর্মজীবনটাই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখনি হয়তো মানব জীবন পূর্ণতা লাভ করে। কিন্তু প্রতিটি সৃজনশীল মানুষের মতো মৃণাল সেনও ছিলেন অতৃপ্ত।
আমার ইচ্ছা হয় আবারো শুরু থেকে শুরু করি। চলচ্চিত্রটির (একদিন আচানক) একটি চরিত্রের সংলাপ ছিল ‘জীবনের সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এই যে, মানুষের জীবন মাত্র একটিই।
– মৃণাল সেন
সিনেমা সম্পর্কে আরও জানতে আজই পড়ুন এই বইগুলো