আইরিশ এই হরর-কমেডি একেবারে শুরুর মুহূর্ত থেকেই তার টোনটা সেট করে দেয়। আবেদন কেমন হবে, তা পরিষ্কার জানিয়ে দেয় দর্শককে। ডকুমেন্টারির স্টাইলে শুরুটা হয়। ভয়েসওভারে একজন বলে ওঠে,
কেন ভূতদের আমরা সবসময় দেখি না? সত্যিটা হলো, ভূতেরা সারাক্ষণই আমাদের সাথে থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ ভূতই আকারে এত ক্ষুদ্র জিনিসের ভেতরে থাকে যে, সেগুলোতে ভ্রুক্ষেপ করি না আমরা। এই যেমন- হঠাৎ হঠাৎ নড়ে ওঠা কলম, একা একা গড়াগড়ি খাওয়া নুড়ি পাথর, শূন্যে বাউন্স করতে থাকা বল!
এরপরই দর্শক পরিচিত হয় এই তথ্যের প্রবক্তা ভিনসেন্ট ডুলির সাথে। এমন অদ্ভুত সব ভুতেদের খুঁজে বের করেন তিনি। এটা তার “এক্সট্রা অর্ডিনারি ট্যালেন্ট,” তারই ভাষ্যে। নানারকম ভূত আর নানান কিছুতে থাকা ভূতেদের নিয়ে তিনি ভিডিওটেপের সিরিজ বের করেছেন। ওই ডকুমেন্টারির ফুটেজ তারই এক ভিডিও ক্যাসেটের।
এরপরই খুব মসৃণভাবে সিনেমা ওয়াইড রেশিওতে বদলে গিয়ে ফ্রেমে আনে সমাধিসৌধকে। ঠিক পাশে দাঁড়ানো তার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে আফসোস করে ভূত তাড়ানো বাবাকে তার জন্য মরতে হলো বলে। তখনই ক্যামেরা টিল্ট আপ করে উপরে বৈদ্যুতিক পিলারের তারে বসা কাককে দেখায় (যেটা পরবর্তীর উদ্দেশ্যে একটা ফোরশ্যাডোয়িং), আবার টিল্ট ডাউন করে ফোকাস করে দুই মেয়ের উপর। এই দৃশ্য বর্ণনার কারণ হলো, কী দারুণভাবে ভিজ্যুয়াল কমেডি/ ভিজ্যুয়াল গ্যাগের উদাহারণ দেবার মতো দৃশ্য হয়েছে এটি তা বলতে। কমেডি সিনেমা ভিজ্যুয়াল গ্যাগ ছাড়া কমেডি হয় কীভাবে! যে কমেডি সিনেমা শুধুমাত্র সংলাপে হাসাতে চায়, সেগুলো লেইজি কমেডি বা স্থূল কমেডি নির্দ্বিধায়। সেই বাস্টার কিটন, চ্যাপলিনদের সাইলেন্ট সিনেমাগুলোই দেখুন না!
সেকাল থেকে একালের টারান্টিনো, কোয়েন ব্রাদার্স, ওয়েস এন্ডারসনরাও কোনো একটা দৃশ্যকে রসাত্মক করে তুলতে সংলাপের সাথে এই ভিজুয়্যাল গ্যাগের উপর অনেক বেশি জোর দিয়েছেন। হরর কমেডিতে এই ভিজ্যুয়াল গ্যাগ অবিশ্রান্তভাবে ব্যবহার করছেন এখনকার মাঝে এডগার রাইট। নতুন অনেকেই করছেন, করার চেষ্টা করছেন। হররে কমেডি মিশিয়ে ‘ভালো’ বের করে আনাটা বরাবরই কষ্টসাধ্য ব্যাপার, কারণ দুটোই পুরোপুরি বিপরীত। কোথায় ভয়ের থরথরানি, আর কোথায় রসে কুটিকুটি! তা যাক। ধান ভানতে একটু শীবের গীত হলো আর কী। কিন্তু নিখুঁত ভারসাম্য রাখতে পারা এই হরর-কমেডি ওটুকুর প্রাপ্যই।
তো যা বলছিলাম, ওই দুই মেয়ের মাঝে এক মেয়ে বাবার সাথে থেকে থেকে এক্সরসিজম শিখলেও অঘটনে বাবা মারা যাবার পর সেই পেশা বাদ দিয়ে ক্যাব ড্রাইভার হয়েছে। কিন্তু তাকে সেই পেশায় ফিরে আসতেই হয়, যখন তাদের ছোট্ট শহরেরই পরিচিত একজনের মেয়েকে খুব খারাপ ভূতে ধরে। ওই বাড়িতে মধ্যবয়স্ক বাবার সাথে আবার তার গত হওয়া স্ত্রীও থাকে, ভূত হয়ে, হাওয়ায় ভেসে!
এদিকে ব্লাড মুনের সময় আগত। চন্দ্রগ্রহণ শেষ হবার আগেই তরুণীকে ভূতের কবল থেকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু মামলা এত সোজা হলে সিনেমা হবে কী করে! ৮টা ভুত দিয়ে কাবু করতে হবে একে। আর মাধ্যম হবে তরুণীর বাবা, যার সাথে ভূত তাড়ানো মহিলার একটা ‘হবে হবে’ ব্যাপার চলছে খুব সূক্ষ্মভাবে। তো এই মাধ্যম হবার পর ভূতেরা তরুণীর বাবা অর্থাৎ মার্টিনের শরীরে প্রবেশ করে। তখন রোজ অর্থাৎ ভূত তাড়ানো মাসি ভূতগুলোকে মানাতে লেগে পড়ে, যাতে সেগুলো কাচের বয়ামে ঢুকে যায়। রাজি হলে মার্টিনের নাড়িভুঁড়ি উগলানো মুখ থেকে নির্গত তরলের রূপেই ভূতেরা বয়ামে ঢোকে। এই তরলে গোসল করিয়েই ওই তরুণীকে ঠিক করা হবে!
কিন্তু ঘটনা হলো, তরুণীকে ‘ভূতাক্রান্ত’ (!) করেছে ওই শহরেই বাস করা এক ফ্লপ মিউজিশিয়ান। সবে ১/২টা গান কিছু শ্রোতাপ্রিয় হবার পর পরই তার অবস্থান বিলবোর্ড চার্টের তলানিতে ঠেকে। আবার সফল হবার জন্য সে সন্ধি করে শয়তানের সাথে। দিতে হবে কুমারি বিসর্জন। তো সেই মিউজিশিয়ানই বাধালো এই কান্ড।
চন্দ্রগ্রহণ চলছে। রিচুয়ালে বসেছে গায়ক মহাশয়। ওদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে ভূত তাড়ানো মাসি, ভূত সংগ্রহ করতে। আর এই দুয়ের সংঘর্ষে ঘটে চলেছে অদ্ভুত, হাস্যরসাত্মক, প্রায় সুরিয়ালিস্টিক ভাইব দেওয়া সব ঘটনা! সকল পাগলামিকে চূড়ান্ত রূপ দিতে অমন হঠকারি ক্লাইম্যাক্সও কিন্তু আছে!
‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’ গত কয়েক বছরের মাঝে সন্দেহাতীতভাবেই অন্যতম দারুণ হরর-কমেডি। সিনেমার নামের মতোই জনরার ক্ষেত্রে এ আসলেই এক্সট্রা অর্ডিনারি সিনেমা। সবকিছুতেই এত আমুদে আর চমৎকার ভারসাম্য করেছে এই সিনেমা যে, খুব শীঘ্রই এই জনরার ক্ষেত্রে একটা ভালো উদাহারণ হতে চলেছে। ‘কাল্ট’ স্ট্যাটাস লেখা আছে এর সর্বত্রই। এই সিনেমা ঘোস্টবাস্টিং থেকে শুরু করে কাল্ট রিচুয়াল, এক্সরসিজম, কালো জাদু, অতৃপ্ত আত্মার গপ্পো; সবকিছুকে একসাথে করে তুখোড় বিদ্রুপ করেছে, আবার একইসাথে শ্রদ্ধাও জানিয়েছে রসের হাঁড়ি উল্টে দেয়া অবস্থাতেই। আবার একইসাথে একটু কামিং অফ এইজ ভাইব, একটু রোমান্টিকতার জন্যও কর্নার রেখেছে। এত কিছু একসাথে মিশিয়ে এমন এক ককটেল এই সিনেমা তৈরি করেছে যা রীতিমতো বিস্ফোরক! (অবশ্যই ভালো অর্থে)
এন্ডা লাফম্যানের লেখা চিত্রনাট্যের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অপ্রত্যাশিত সব উপাদান। এবং এত এত উপাদান মেশানোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই যেটা হয় যে, বিজড়িত হয়ে পড়ে। সবকিছু একসাথে দলা পাকিয়ে কিম্ভুতকিমাকার রূপ ধারণ করে। এবং সেই ভয় তুড়ি মেরে জয় করার মতো কাজ লাফম্যান তার চিত্রনাট্যে করেছেন। সবকিছু আলাদা আলাদা স্তরে রেখেছেন ঠিকই, আবার সিনের ডিজাইন করতে গিয়ে এত বুদ্ধিদীপ্তভাবে উপাদানগুলো বাছাই করেছেন, যা প্রশংসার দাবীদার। হাস্যরসে টইটম্বুর হয়ে থাকা সরস সব সংলাপ। প্রতিটি দৃশ্যেই অপ্রত্যাশিত কিছু না কিছু রেখেছেন। ভয়ের আবহ আর হেসে ওঠার মতো কর্মকান্ড একই দৃশ্যে সমানভাবে রেখেছেন এবং ব্যবহারও করেছেন একইসময়ে। সেটাই এতটা প্রভাবশালী করে তুলেছে গোটা চিত্রনাট্যকে।
চিত্রনাট্য লেখার পাশাপাশি মাইক অ্যাহার্নের সাথে যুগ্মভাবে সিনেমাটি পরিচালনাও করেছেন এন্ডা লাফম্যান। দুই বন্ধুর যুগ্ম পরিচালনা এক হয়ে সিনেমাকে আরো শক্তিশালী করেছে। টোনে কোনো রকম বিচ্যুতি দেখা যায়নি। প্রতিটি শটের কম্পোজিশনই ভয় আর হাসির ভিজ্যুয়াল ফ্লেয়ারকে যথার্থভাবে তুলে ধরেছে। স্প্লিট স্ক্রিন, হুইপ প্যান, ম্যাচ কাটে সমৃদ্ধ এর সিনেম্যাটিক ট্রিটমেন্ট। কিন্তু কখনোই শোয়ি হয়নি, বরং কোথাও উচ্চকিত হয়ে উঠলে তার মাঝেও একটা কমনীয়তা প্রদান করেছে এর ভিজুয়্যাল ভাষা। প্রতিটি সংলাপকে, প্রতিটি শট, গতিময় সম্পাদনার প্রতিটি কাট একই ছন্দ প্রদান করেছে।
সাথে এর মিজঁ-অ-সেনের ব্যবহারের কথাও উল্লেখ করতে হয়। হরর-কমেডির মতো জনরায়ও মিজঁ-অ-সেন টেকনিকের যথাযোগ্যভাবে ব্যবহার করেছে এই সিনেমা। ক্লাইম্যাক্সে তো চূড়ান্ত রকমের ম্যাডনেস বা উন্মত্ততার পারদে পৌঁছেছে এই সিনেমা। এবং ওই অংশই আসলে এককভাবে এই সিনেমাকে ‘কাল্ট’ বানিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘লাফ রায়ট’। হ্যাঁ, ওই অবস্থানেই পৌঁছেছে। ম্যাভ হিগিনস, ব্যারি ওয়ার্ড, উইল ফর্তে সকলের দুর্দান্ত ফিজিক্যাল কমেডির সাথে সাথে সংলাপ প্রদান করায়ও ছিল পূর্ণ তেজোদ্দীপ্ততা। কমিক সব কর্মকান্ড আর চনমনে, ক্ষিপ্র ভিজুয়্যাল সবকিছু একসাথে মিলেই ওই প্রবল উন্মত্ততাকে ধরেছে ক্লাইম্যাক্সে।
এমনভাবে প্রেম আর প্যাশনকে আষ্টেপৃষ্ঠে গেথেছেন এই সিনেমার ফিল্মমেকারদ্বয়, ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’ তো হতেই হয়। নামটাও সমান্তরালে তাদের আত্মবিশ্বাসকেই প্রদর্শন করে।