ডার্ক ট্যুরিস্ট: যে ডকু শো রোমহর্ষক সব বাস্তব ঘটনায় চমকে দেবে দর্শককে

‘ডার্ক ট্যুরিজম’ কী? সোজাভাবে বললে, ডার্ক ট্যুরিজম হলো সেই সকল জায়গায় ভ্রমণ, যে জায়গাগুলোকে আলোড়িত করেছে মৃত্যুর ইতিহাস, কিংবা কোনো ঐতিহাসিক ট্র‍্যাজেডি বা অদ্ভুত ঘটনাবলি। ঐতিহাসিক মূল্যই মূলত জায়গাগুলোর আকর্ষণ। মৃত্যু কিংবা যাতনার ঘটনাই শুধু নয়। যেমন ধরুন ইউক্রেনের চেরনোবিল। মৃত্যু, যন্ত্রণার ইতিহাসই একে ডার্ক ট্যুরিজমের আওতাভুক্ত স্থান হিসেবে বহির্বিশ্বে পরিচিত করেছে। তা ডার্ক ট্যুরিজম নিয়ে কেন এত কথা? কারণ, নেটফ্লিক্সের এই ডকুমেন্টারি সিরিজ যে এগিয়েছে ডার্ক ট্যুরিজম নিয়ে। 

নিউজিল্যান্ডের সাংবাদিক ডেভিড ফ্যারিয়ার, জীবনের অদ্ভুত ব্যাপারগুলো তাকে বরাবরই খুব বেশি টানে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন ডার্ক ট্যুরিস্ট হবার। কোনো চমৎকার সৈকত কিংবা মনোরম রিসোর্টে নয়; বরং মৃত্যু, বিষাদগ্রস্ত ঘটনাবলী জড়িত আছে এমন জায়গাগুলোতেই তার ভ্রমণ। ঘটনাগুলোকে সামনে আনার উদ্দেশ্যেই তার এই ভ্রমণ। ফ্যারিয়ারের বিভিন্ন দেশে ডার্ক ট্যুরিজমের বিভিন্ন ঘটনা সম্বলিত ৮ এপিসোডের এই ডকুমেন্টারি সিরিজ। প্রতিটি এপিসোডে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ডার্ক ঘটনা আবর্তিত হয়েছে। 

ল্যাটিন আমেরিকা

সিরিজের ১ম এপিসোডে ফ্যারিয়ার যাত্রা করেন ল্যাটিন আমেরিকায়। কলম্বিয়ার মেডেলিন শহরে যাত্রা শুরু করেন তিনি, পাবলো এস্কোবার সম্বন্ধে জানতে। এস্কোবার বিশ্বের চোখে কলম্বিয়াকে প্রতিষ্ঠা করে ‘খুনে রাজধানী’ হিসেবে। তো মেডেলিনের রাস্তায় তিনি দেখা পেয়ে যান পাবলো এস্কোবারের মতোই দেখতে একজনের!

এস্কোবারের লুক এলাইক; Image Source: NetFlix

তার সাথে টুকরো কথামালা শেষে ফ্যারিয়ার আরো এগিয়ে যান। এই শহরের এক বিশাল জনগোষ্ঠী এস্কোবারকে মান্য করে রবিন হুড হিসেবে। পাবলো এস্কোবারের নাম বিকিয়ে এখনও লাখো লোকের ধান্ধা চলে এখানে। ফ্যারিয়ার আরো যাত্রা করেন পাবলো এস্কোবার যেখানে ৫ বছর বন্দিদশা কাটিয়েছিল, সেই জেলে। এস্কোবারের নিজের তৈরি জেল ছিল সেটি। বিশাল বিলাসবহুল এক বাংলো মূলত। এরপর ফ্যারিয়ার যাযন এস্কোবারের বিশ্বাসী হিটম্যান পপাইয়ের কাছে। ২৫০ খুনের সংখ্যা শোভা পায় তার নামের পাশে। এস্কোবারের জন্য নিজের প্রেমিকাকেও হত্যা করতে পিছপা হয়নি সে।

চলতে চলতে ফ্যারিয়ারের যান মেক্সিকো সিটির দিকে। মৃত্যুদেবতার পূজোয় অংশ নেন তিনি। মূলধারার চার্চ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হলেও একটি বড় অংশ এই অর্চনায় সংযুক্ত। লাটিন আমেরিকা ভ্রমণের শেষ অংশে, ফ্যারিয়ার অবৈধ উপায়ে বর্ডার পার হওয়ার বাস্তব চিত্র অনেকটা বিদ্রূপের ছলে তুলে ধরেন এই কাজ থেকে নিরুৎসাহিত করতে। এই অংশ খুব বেশি আবেদন রাখতে পারেনি অবশ্য। এবং কিছু প্রশ্নের জবাব দেওয়ার তোয়াক্কা না করে আচমকা ইতি টেনেছে।

জাপান

সিরিজের ২য় এপিসোডে ফ্যারিয়ার তার ভ্রমণকে আরো সমৃদ্ধ করতে রওনা হযন জাপানের ফুকুশিমার উদ্দেশ্যে। ২০১১ সালের সুনামিতে ফুকুশিমার নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট ধ্বংস হয়ে কেড়ে নেয় ১৫ হাজারেরও বেশি জীবন। পুরো নগরী দেখে মনে হয়, বাস্তবের কোনো অ্যাপোক্যালিপ্টিক সিনেমার দুনিয়া। রেডিয়েশনের মাত্রা এখনও ভয়াবহ। ফ্যারিয়ারের এই যাত্রায় আরো জানতে পারা যায় ‘সুইসাইডাল ফরেস্ট’ নিয়ে। যে বন দেখলেই অদ্ভুত এক বিষণ্নতা জাগে। এই এপিসোডে আরো আছে ব্যাটলশিপ আইল্যান্ডের গল্প। একসময় বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ছিল সেটি, বর্তমানে যেখানে কাকপক্ষীরও দেখা মেলে না। ডকু সিরিজটির দ্বিতীয় এই এপিসোডে, ফ্যারিয়ারের বলার ধরনে ঘটনাগুলো কিছুটা বিক্ষিপ্ত মনে হয়েছে, এবং যে সামগ্রিক অ্যাপ্রোচ দরকার ছিল এর বিষয়াদি মাথায় রেখে- সেটা পুরোপুরি আসেনি।

আমেরিকা

৩য় এই এপিসোডের প্রথমভাগে ফ্যারিয়ারকে পাওয়া যায় জেফরি ড্যামার নামক এক ভয়ানক সিরিয়াল কিলারের ইতিবৃত্ত খুঁজতে। এই সিরিয়াল কিলারের অন্য নাম মিলাউকি ক্যানিবাল। ১৯৭৮ থেকে ‘৯১ সালের মাঝে সে ১৭ জন পুরুষকে খুন করেছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো- এই সিরিয়াল কিলার ব্যাপক নারীভক্ত জুটিয়ে গেছে মৃত্যুর পর! এপিসোডের দ্বিতীয়ভাগে ফ্যারিয়ার যান টেক্সাসের সেই স্থানে, যেখানে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে হত্যা করা হয়েছিল। প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে এখানে। দুজন গাইড আছে যাদের মুখ থেকে কেনেডি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দুরকম করে শোনা যায়।

শেষভাগে, ফ্যারিয়ার নিউ অরল্যান্সে পা রাখেন সত্যিকারের ভ্যাম্পায়ারের খোঁজে! ভ্যাম্পায়ারদের একটা ছোটখাট গোষ্ঠী আছে এখানে। তবে তারা ভয়ংকর নয়। স্বাভাবিকই বাকি মানুষদের মতো। নিজেদের গোষ্ঠীর মানুষের রক্তই তারা খায়। ডার্ক ট্যুরিস্টের এই এপিসোড বেশ নিগূঢ়, থ্রিলিং, এবং একইসাথে অদ্ভুতও। 

নিউ অরল্যান্সের ভ্যাম্পায়ার; Image Source: NetFlix

কাজাখস্তান

আমেরিকানদের কাছে কাজাখস্তান পরিচিত ‘বোরাট’ সিনেমার কল্যাণে। মজা করেই এটি উল্লেখ করেন ডেভিড ফ্যারিয়ার। এই কাজাখস্তানের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের পুরনো সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৪৯ এবং ১৯৮৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়মিত পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা করার জন্য কাজাখস্তানকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। আশেপাশের এলাকাগুলোতে এর বিরূপ প্রভাব দর্শন, এবং যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে ঢুঁ মারাসহ ‘অ্যাটমিক লেক’ ভ্রমণে দেখা যায় ফ্যারিয়ারকে। ১৯৬৫ সালে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এই লেক বানানো হয়। এর পানি সাধারণ পানির তুলনায় ১০০ গুণ বেশি তেজস্ক্রিয়!

এপিসোডের শেষাংশে ফ্যারিয়ারের ভ্রমণ থিতু হয় তুর্কমেনিস্তানে। পৃথিবীর সবচেয়ে কড়া শাসন চলে এখানে। ফ্যারিয়ার এই শহরকে বিশেষায়িত করেন ‘নর্থ কোরিয়া মিটস লাস ভেগাস’ বলে। সাদা মার্বেল পাথরের প্রতি এখানকার প্রেসিডেন্টের অদ্ভুত মোহ কাজ করে। শহরের বড় বড় বিল্ডিংগুলো সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি, এমনকি মূর্তিগুলোও। সাংবাদিকতা এখানে নিষিদ্ধ। প্রেসিডেন্ট সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না তাই। শহরের উঁচু উঁচু ইমারতের ছবি তোলা যাবে, কিন্তু কোনো মানুষের ছবি তোলা যাবেই না!

সিরিজের দারুণ এপিসোডগুলোর মাঝে এটি একটি। ডার্ক টোনের সাথে সাথে একটা সূক্ষ্ম কমেডিক টোনও বহন করেছে এই এপিসোড। সিরিজের মূল বিষয়ের কথা ভাবলে যে সামগ্রিক ধারণা সৃষ্টি হয় সিরিজ নিয়ে, তার ভাইব অনেকখানিই দিয়েছে এই এপিসোড।

ইউরোপ

এই এপিসোডে ফ্যারিয়ার পাড়ি জমান ইউরোপে, যেখানে তার ভ্রমণ থেকে দর্শক জানতে পারে ইংল্যান্ডে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত এক মিউজিয়াম সম্বন্ধে, যেখানে মাইকেল জ্যাকসনের প্রতিকৃতিকে দেখা যায় নাৎসি ক্যাম্পে প্রতিনিধিত্ব করতে! এই এপিসোড চাইলেই যতখানি নিগূঢ় হতে পারত, তার অনেকখানিই ঠিকঠাক তৈরি হয়নি। বিস্তারিত বর্ণনা কম থাকায় ঘটনাবলী বর্ণনার ধরনে পুরোটা একসাথে আসেনি কখনোই।

দক্ষিণ এশিয়া

ইউরোপ ঘুরে ফ্যারিয়ার সোজা চলে আসেন দক্ষিণ এশিয়ায়। সফর শুরু হয় কম্বোডিয়ায়, যেখানে ডাকসাইটে অর্থ দিয়ে চাইলে যেকোনো পশু হত্যা করা যায়, তা-ও আবার একে ৪৭ কিংবা মেশিনগান দিয়ে!

চলছে শিকার, চলছে প্রস্তুতি; Image Source: NetFlix

সফর এগোয় মায়ানমারে, যেখানে দর্শনার্থী টানতে আর বিশ্বকে জানান দিতে নতুন শহর গড়ে তোলা হচ্ছে। সাংবাদিকদের জন্য নিষেধাজ্ঞা বহাল, একরকম জনমানবশূন্য শহর। ফ্যারিয়ারের দক্ষিণ এশিয়া যাত্রা শেষ হয় ইন্দোনেশিয়া দিয়ে। যেখানে তিনি পরিচিত হন এমন এক গোষ্ঠীর সাথে যারা বিশ্বাস করে- মানুষ মরে না, বরং কিছু সময়ের বিশ্রামে যায়। কবর থেকে উঠিয়ে কঙ্কালের কাপড়চোপড় বদলে দেয়া পর্যন্ত হয় তাদের রীতিতে। এই এপিসোড মজার বেশ। বুদ্ধিদীপ্ত, তথ্যবহুল, এবং কিছুটা ভায়োলেন্টও বটে। 

আফ্রিকা

ভুডুর কথা উঠলেই যে দেশের নাম সেকেন্ডেই মাথায় আঘাত করে, সেটি আফ্রিকা। দক্ষিণ বেনিন হলো ভুডুর জন্মস্থান। ফ্যারিয়ার হাজির হন এখানে, ভুডু এবং এই গোত্র সম্পর্কে জানতে। পরের অংশে সামনে আসে জোহানেসবার্গ নিয়ে অতিরঞ্জিত কথাবার্তার স্বরূপ। শেষের অংশে, আলেক্সান্ডার শহরে চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গদের গোষ্ঠীতে হানা দেন ফ্যারিয়ার। যারা কৃষ্ণাঙ্গদের জাতশত্রু মনে করে। তারকাঁটার বেড়া দিয়ে নিজেদের নিরাপদ রাখে আর সর্বদা প্রস্তুত থাকে রেসিয়াল ডুমসডে-র! এই এপিসোডের প্রধান আকর্ষণ ভুডু। কিন্তু ভুডু নিয়ে কৌতূহল মেটানোর তথ্য ছিল কম। পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার একটা চেষ্টা এই এপিসোডে ছিল। আরো তথ্যবহুল হওয়ার সুযোগ এতে ছিল। 

ভুডু জনগোষ্ঠীর মাঝে ফ্যারিয়ার; Image Source: NetFlix

ব্যাক ইন আমেরিকা

শেষ এপিসোডে ফ্যারিয়ার ফিরে আসেন আমেরিকায়। ম্যানসন মার্ডারের পেছনের গল্প, কুখ্যাত চার্লস ম্যানসনকে নিয়ে তার ভক্তগণের অবসেশনের অদ্ভুত চিত্র, হযরত নূহ (আ)-এর সেই নৌকার রেপ্লিকাসহ নানা কিছু উঠে এসেছে। এপিসোডের শেষ অংশে আছে ‘ম্যাকমি ম্যানর’ নামক একটি হন্টেড হাউসের গা শিরশির করা ভয়ানক চিত্র। বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর হন্টেড হাউস বলা হয় একে। কোনো এক্সট্রিমই এখানে এক্সট্রিম নয়! এখানের প্রধান আকর্ষণ ম্যাকমির নানা টর্চার থেরাপির আয়োজন, যা মানুষের ধৈর্যশক্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। গোটা সিরিজের সবচেয়ে ভূতুড়ে, প্রগাঢ়, এবং দারুণ এপিসোড বলা চলে একে। তবে যে নায়েলিস্টিক টোন মাঝের সেগমেন্ট বহন করেছে, সেটাকে আরো স্পষ্ট করা উচিত ছিল যুক্তি-তর্কের জায়গা থেকে।

ম্যাকমি ম্যানরের চিত্র; Image Source: NetFlix

নেটফ্লিক্সের এই ডকু শো যে কনসেপ্ট নিয়ে গড়ে উঠেছে, সেটার প্রশংসা করতে হয়। তবে শো-র হোস্ট হিসেবে ডেভিড ফ্যারিয়ার খুব একটা ভাল করতে পারেননি। তার দুর্বল উপস্থাপনা অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে এই শো-কে দারুণ হওয়ার হাত থেকে। তার উপস্থাপনার ধরন কিছুটা একমাত্রিক। আর বেশ কয়েকটি ঘটনায় ইচ্ছে করেই তিনি যেন আরেকটু গভীরে চাননি। যদি কারেক্টনেস রক্ষার্থে হয়, তবে পুরো শো-র মূল বিষয়ের সাথে সেটা কিছুটা সাংঘর্ষিক ঠেকে।

প্রতিটি এপিসোডের লাইটিং, কালার গ্রেডিং মানানসই। ভিজ্যুয়ালি স্টানিং প্রতিটি এপিসোডই। ডকু শো হিসেবে তথ্যবহুল যেমনটা হওয়া দরকার ছিল, কিছু কিছু অংশে তেমনটি হয়েছে, কিছু অংশে হয়নি। বিষয়গুলোই ছিল এত ইন্টারেস্টিং, সেখানে কারেক্টনেসকে ঝেড়ে আরো সাহসী হওয়া উচিত ছিল। সাহস যে নেই, তেমনটিও নয় কিন্তু। ফ্যারিয়ার মূলত একে সিনেম্যাটিক বয়ানভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। সেই দিকটার কারণে, ‘ডার্ক ট্যুরিস্ট’ শুধুমাত্র একটি ডকুমেন্টারি সিরিজ হয়ে থাকেনি। এবং ফলাফল যে কৌতূহলোদ্দীপক হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নেটফ্লিক্সের একটি ভিন্ন স্বাদের শো নিউজিল্যান্ডের এই ডকু সিরিজ।

This bengali article is a review of the docu series 'Dark Tourist' (2018). It's a show by NETFLIX. It has 1 season, contains 8 episodes. Dark Tourist is about DARK TOURISM. It's full of surprises. It will blow the audience minds for sure. It's more than, just a docu show. It's intense, thrilling and shocking.

Feature Image- NETFLIX

Related Articles

Exit mobile version