সাত রাজ্যের রাজা ভিসেরিস টারগেরিয়ান আয়রন থ্রোনে বসে আছেন। বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছে তাকে। এই বিশাল ওয়েস্টেরস নিয়ে তিনি চিন্তায় মগ্ন, তা নয়। এই সাত রাজ্য নিয়ে সমস্যার তো কমতি নেই। দাদা জ্যাহেরিস লম্বা একটা সময় ধরে এই এলাকা কৌশলের সাথে শাসন করেছেন। তার মৃত্যুর পর তার শূন্যস্থান পূরণ করেন ভিসেরিসের বাবা বেইলন। কিন্তু হুট করে তার মৃত্যুর পর রাজ্য চলে আসে তার হাতে, এরপর তিনি ভালোভাবেই সবকিছু চালিয়েছেন। পিতার কিন্তু দিন ফুরিয়ে আসছে। একসময় তাকেও ছেড়ে দিতে হবে এই সিংহাসন। কিন্তু তার অবর্তমানে কে পাবে এই রাজ্যের ভার?
বিয়ে করেছিলেন অ্যামা এরিনকে। কিন্তু তাদের ঘর আলো করে কোনো পুত্রসন্তান কখনও আসেনি। এ দম্পতির একমাত্র মেয়ে রায়েনিরা টারগেরিয়ান এখন এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাণী। কিন্তু মেয়ে হয়ে তো আয়রন থ্রোনে বসার নজির নেই, কেউ মেনেও নেবে না। সেক্ষেত্রে এই রাজ্য চলে যাবে তার ভাই ডেমন টারগেরিয়ানের কাছে। কিন্তু একজন বাবা হয়ে তিনি কীভাবে চান সন্তানের প্রাপ্য বুঝিয়ে না দিতে!
তবুও ভিসেরিস আরেকবার বিয়ে করলেন, অ্যালিস্যান্ট হাইটাওয়ারকে। এই ঘরে এলো তিনজন পুত্র ও একজন কন্যাসন্তান। কিন্তু ভিসেরিস ‘ভুল’ করলেন অন্যখানে, পুত্রসন্তান পাবার পরও এই রাজ্যের ভবিষ্যতের রাণী করে গেলেন তার প্রথন সন্তান, রায়েনিরাকে।
ভিসেরিস ও অ্যালিস্যান্টের পুত্রদের একজন এইমন্ড টারগেরিয়ান। জন্মের সময় নাকি বড় ভাই এগনের থেকে আকারে দ্বিগুণ ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই এইমন্ড দুরন্ত, নির্ভীক, হিংস্র, ও মাথা গরম স্বভাবের। কেউ ভুল করলে তাকে ক্ষমা করতে হয়, এই বিষয়কে সারাজীবন উপেক্ষা করে গেছেন। বড় হবার সাথে সাথে তিনি দুর্দান্ত অসি চালানো শিখে গেলেন। গায়ে পড়তেন যোদ্ধাদের কালো পোশাক।
১২০ এসি। এইমন্ডের বয়স তখন মাত্র ১০ বছর। সৎ বোন রায়েনিরা স্বামী লিয়েনর ভেলারিয়ন হুট করেই মারা গেলেন। বাবা মা এবং ভাইদের সাথে এইমন্ডকেও ড্রিফটমার্কে যেতে হলো লিয়েনরের শেষ বিদায়ের অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষ হবার পর ভিসেরিস এইমন্ডকে আদেশ দিলেন ড্রাগনস্টোনে যেতে। ততদিনে এইমন্ডের আর সকল ভাইরা ড্রাগন পেয়ে গেছে। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যার সাথে কোনো ড্রাগনের সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। তাই ভিসেরিস তাকে বললেন, বুকে যদি পাটা থাকে, তবে ড্রাগনস্টোনে গিয়ে ড্রাগনের ডিম সংগ্রহ করে অথবা ডিম থেকে ড্রাগনের জন্ম দেবার চেষ্টা করতে।
বাবা ভিসেরিসের এমন তাচ্ছিল্যের কথা শুনে এইমন্ডের ভীষণ রাগ হলো। ঠিক করলেন, টারগেরিয়ানদের সব থেকে প্রাচীন ড্রাগন ভ্যাগারকে বশ মানিয়েই ছাড়বেন। লায়েনা ভেলারিয়ন ততদিনে মারা গেছেন, ভ্যাগার একাকী পড়ে রয়েছে এই ড্রিফটমার্কে। কিন্তু এইমন্ড জানতেন, তিনি চাইলেই ভ্যাগারের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারবেন না। তাই যা করার, সবকিছু করতে হবে লোকচক্ষুর আড়ালে।
ভ্যাগারকে বশ করতে গিয়ে এইমন্ড ধরা পড়ে গেলেন তিন বছর বয়সী ভাগনে প্রিন্স জোফরির হাতে। তিনি কী আর ছেড়ে দেবার পাত্র! কষে এক চড় বসিয়ে জোফরিকে শাসাতে লাগলেন। এরপর ফেলে দিলেন মাটিতে। জোফরি মাটি থেকে উঠতে উঠতে এইমন্ড ভ্যাগারের পিঠে চড়ে বসেছেন। ভ্যাগারের শিকল খুলে গেছে, এইমন্ডকে পিঠে নিয়ে প্রাচীন এই ড্রাগনের ততক্ষণে দু’চক্কর মারা হয়ে গেছে। এর মাঝে জোফরি গিয়ে তার দুই ভাগ লুকায়েরিস এবং জ্যাকায়েরিসকে ডেকে এনেছে।
কাঠের তৈরি তরবারি দিয়ে চারজন লড়াই করা শুরু করে দিল। বিষয়টা তখনও গুরুত্বর পর্যায়ে যায়নি। কিন্তু হুট করে এইমন্ড তাদেরকে ‘স্ট্রংস’ বলে গালি দিতে লাগলেন। ওয়েস্টেরসে একটা গুঞ্জন আগেই ছিল; রায়েনারার এই তিন পুত্র নাকি তার স্বামী লিয়েনরের সন্তান নয়, বরং হারউইন স্ট্রং এবং রায়েনারা অবৈধ সন্তান। জ্যাকায়েরিস বয়সে বড়; এইমন্ড কী বোঝাতে চাচ্ছে, সেটা সে ঠিকই বুঝল। রাগে তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে গেলো এইমন্ডের দিকে। বয়সে একটু বড় হলেও জ্যাকায়েরিস কী আর এইমন্ডের সাথে পেরে ওঠে! তাকে নিচে ফেলে দুমাদুম ঘুষি মারতে শুরু করলেন এইমন্ড। লুকায়েরিস এই সময় অসম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল। কোমড় থেকে এক টানে বের করে আনল তার ড্যাগার। সোজা বিধিয়ে দিলো এইমন্ডের চোখে, এরপর এক টানে পুরো চোখ কোটর থেকে বের করে আনল সে।
এই ঘটনার পর জল অনেকদূর গড়িয়েছিল। কিন্তু লাভের লাভ হয়েছিল এইমন্ডের, ভেলারিয়নদের দখলে থাকা সব থেকে ভয়ঙ্কর ড্রাগন চলে এলো এইমন্ডের দখলে। প্রাচীন এক ড্রাগন ছিল ড্যাগার। ডুম অফ ভ্যালেরিয়া থেকে বেঁচে আসা তিন ড্রাগনের একটি, এবং যে ড্রাগনে চড়ে এগন টারগেরিয়ানের পাশে যুদ্ধ করেছিলেন ভিসেনিয়া। আর এইমন্ডের জন্য? চোখের বিনিময়ে ড্রাগন।
নষ্ট চোখের কোটরে তিনি বসিয়ে নিয়েছিলেন নীল রঙের পাথর। উচ্চবংশীয় নারীরা – বিশেষ করে স্ট্রমস এন্ডে থাকার সময় বোরস ব্যারাথিওনের স্ত্রী ও মেয়েরা যাতে ভয় পেয়ে না যায়, সেজন্য নীল পাথর বসানো চোখের উপর তিনি কালো পট্টি বেঁধে নিয়েছিলেন। এই নষ্ট চোখের কারণে পরবর্তীতে এইমন্ডকে ডাকা হতো ‘এইমন্ড ওয়ান-আই’ নামে। তবে এক চোখ থাকার জন্য ঘরের এককোণে চুপটি করে বসে থাকার পাত্র এইমন্ড ছিলেন না। কিংসগার্ডের লর্ড কমান্ডার স্যার ক্রিস্টন কোলের কাছে অনুশীলন নিয়ে এইমন্ড হয়ে উঠেছিলেন দুর্দান্ত একজন যোদ্ধা এবং অসিচালক। তবে চোখ হারানোর জন্য এই তিন ভাগ্নেকে কোনোদিন সহ্য করতে পারতেন না তিনি। রাজা ভিসেরিস কাছাকাছি না থাকলেই এই তিনজনকে ‘দ্য স্ট্রংস বয়েজ’ বলে গালি দিতেন। আর লুকায়েরেস? তার উপর প্রতিশোধ তো এইমন্ড নিয়েছিলেন একদম হাতেনাতে।
রাজা ভিসেরিস মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার কথা পাল্টালেন না। রায়েনারা ছিল তার উত্তরসূরী, এবং তিনিই রইলেন। কিন্তু রাজার মৃত্যুর খবর তক্ষুনি সবাইকে জানানো হলো না। ড্রাগনস্টোনে বসে থাকা রায়েনিরার কানে গিয়ে পৌছাল না বাবার মৃত্যুর সংবাদ। ভিসেরিসের হ্যান্ড অটো হাইটাওয়ার, দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যালিস্যান্ট হাইটাওয়ার এবং কমান্ডার অফ কিংস গার্ড স্যার ক্রিস্টন কোল মিলে নতুন রাজা বানালেন দ্বিতীয় এগন টারগেরিয়ানকে, যিনি এইমন্ডের আরেক ভাই। রাজা হয়ে এগন স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলেন বোন হেলায়েনাকে।
এই খবর ড্রাগনস্টোনে একটু দেরিতেই পৌছাল। দ্বিতীয় স্বামী ডেমন, রেইনিস টারগেরিয়ান আর তার ছেলেপেলেদের সামনে এই খবর পৌঁছাতেই রায়েনারা রেগেমেগে আগুন হয়ে গেলেন। এই মুহূর্ত থেকে শুরু হলো টারগেরিয়ানদের সব থেকে বড় গৃহযুদ্ধ – দ্য ড্যান্স অফ ড্রাগনস।
নতুন রাজা এগনের দলবল জানতেন, রায়েনারা বসে থাকবেন না। ওয়েস্টেরসের অনেক বড় বড় বংশ তাকে সহায়তা করবে, যুদ্ধের জন্য সৈন্য পাঠাবে। তাই তাদের ব্রেনওয়াশ করে নিজেদের দিকে টানার পরিকল্পনা করতে লাগল তারা। এজন্য এইমন্ডকে পাঠানো হলো স্ট্রম’স এন্ডে, সেখানকার লর্ড বোরস ব্যারাথিওনের কাছে। স্টোর্ম’স এন্ডের লর্ড বোরমুন্ড ব্যারাথিওন ততদিনে মারা গেছেন। তিনি বেঁচে থাকতেই রায়েনিরার পক্ষ নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সিংহাসনে তার ছেলে বোরোস। তিনি কোনদিকে যাবেন, সেটা তার মন-মর্জি।
স্টোর্ম’স এন্ডে গিয়ে এইমন্ড দেখলেন, সেখানে লুকায়েরেসও এসে হাজির। রায়েনারার হয়ে সেখানে কথা বলতে এসেছে সে। লুকায়েরেসকে দেখে এইমন্ড মেজাজ হারিয়ে বসলেন, তাকে গালাগাল শুরু করলেও লুকায়েরেস পাত্তা দিল না। চতুর লর্ড বোরস এ সময় বললেন, এসব বালখিল্যতা তার সামনে না করতে। তার লোকেরা এইমন্ডকে আটকে রাখলেন, লুকায়েরেস বের হয়ে গিয়ে চেপে বসলেন তার ড্রাগন অ্যারাক্সিসের পিঠে।
এই লুকায়েরেস এইমন্ডের চোখ তুলে নিয়েছিলেন। এজন্য বোরোসের মেয়ে মারিস ঠাট্টা করা শুরু করে দিল। এইমন্ড ফুঁসতে লাগলেন। বোরোস তখন বললেন, তোমার যা ইচ্ছা বাইরে গিয়ে করো, আমার এখানে এসব চলবে না।
এইমন্ড বের হয়ে সোজা ভ্যাগারের পিঠে চেপে বসলেন, ধাওয়া করলেন লুকায়েরেসকে। লড়াইয়ের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। কিন্তু এইমন্ড বাধ্য করল। ভ্যাগার অ্যারাক্সের থেকে আকৃতিতে পাঁচগুণ। বৃষ্টি ও মেঘময় আকাশে দানব ভ্যাগারের অতর্কিত হামলায় লুকায়েরেস বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। অ্যারাক্সের খণ্ডিত দেহের পাশে লুকায়েরেসের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় তিনদিন পর। কথিত আছে, লুকায়েরেসকে মারা পর তার মৃতদেহ খুঁজে বের করেছিলেন এইমন্ড, এরপর তার দুই চোখ তুলে নিয়েছিলেন লেডি মারিসকে দেখানোর জন্য।
টারগেরিয়ানদের পারিবারিক যুদ্ধে প্রথম নিজেদের ভেতর প্রথম রক্তপাত হয় এই ঘটনা দিয়েই। পরবর্তীতে রায়েনারা স্বামী ডেমন লুকের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন এগনের দুই ছেলেকে ভাড়াটে খুনি দিয়ে খুন করে। গৃহযুদ্ধ শুরু কিছুদিন পরই এক যুদ্ধের ময়দানে খুব বাজেভাবে আহত হন রাজা এগন আর তার ড্রাগন সানফায়ার। এগন যখন শয্যাশায়ী, তখন প্রায় এক বছর প্রিন্স রিজেন্টের দায়িত্ব পালন এই এইমন্ডই করেছিলেন। এগন দ্য ড্রাগনের মুকুট পড়তেন তিনি, আর বলে বেড়াতেন, এই মুকুট নাকি তার মাথাতেই ভালো মানায়।
প্রিন্স রিজেন্ট হিসেবে স্যার ক্রিস্টন কোলকে সাথে নিয়ে এইমন্ড গিয়েছিলেন হ্যারেনহলে। এই প্রাসাদ দখল নিতে আর প্রিন্স ডেমন টারগেরিয়ানের খোঁজ করতে।
ড্যামন এসেছিলেন হ্যারেনহলে, এইমন্ডের মৃত্যুদূত হয়ে। তার ড্রাগন ক্যারাক্সেসকে নিয়ে তিনি ১৩ দিন অপেক্ষা করেছিলেন এইমন্ডের জন্য। হ্যারেনহ্যালের প্রাসাদের পাশে তাদের দুই ড্রাগনের ভয়ানক সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। এক পর্যায়ে ডেমন তার ড্রাগন ক্যারাক্সেস থেকে লাফ দিয়ে নামেন এইমন্ডের ড্রাগন ভ্যাগারের পিঠে। তার ভ্যালেরিয়ান স্টিলের তরবারি ‘ডার্ক সিস্টার’ সরাসরি ঢুকিয়ে দেন এইমন্ডের চোখে। এইমন্ডসহ ভ্যাগারের সমাপ্তি হয় গড’স আই হ্রদের পানিতে। প্রাচীন এই ড্রাগনের রক্তে পানি রক্তিম হয়ে ওঠে। কয়েক বছর পর পানিতে ভ্যাগার ও এইমন্ডের দেহের অংশবিশেষ পাওয়া যায়। যদিও সেখানে হাড় ছাড়া কিছু বাকি ছিল না। কিন্তু আগে থেকেই অন্ধ থাকা এইমন্ডের অন্য চোখে কোটরে তখনও ডার্ক সিস্টার দৃশ্যমান।
এইচবিও এর ‘গেম অফ থোনসে’র প্রিকুয়্যাল ‘হাউজ অফ দ্য ড্রাগন’ সিরিজে দেখা যাবে প্রিন্স এইমন্ড টারগেরিয়ানকে। প্রথম সিজনে হয়তো এইমন্ডকে খুব বেশি এপিসোডে দেখা যাবে না। কিন্তু পরবর্তী সিজনে, গল্প এগোনোর সাথে সাথে এইমন্ডের বর্ণাঢ্য জীবনের গল্পও দর্শকরা দেখতে পারবেন। সিরিজে এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন ব্রিটিশ অভিনেতা ইওয়ান মিচেল।