ব্রংক্স, নিউ ইয়র্কের বৃহত্তর এই প্রদেশ নিজের ভেতরে নিজেই যেন একটি পৃথিবী। ভিন্ন ভিন্ন সব দেশের ভিন্ন সকল সংস্কৃতি একই ধমনী দিয়ে প্রবাহিত হয় এই ব্রংক্সে। এই গল্প ব্রংক্সের গল্প। না, একথা বলতে গিয়ে ব্রংক্সের কোনো নির্দিষ্ট ভাগ কিংবা নির্দিষ্ট গোত্রের কথা কেন্দ্রীয় চরিত্রটি বলেনি। ব্রংক্সের প্রতি মোড়েই হয়তো ছড়িয়ে আছে এমন সব গল্প। তাই সে বলেছে,
“যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই সে বলে উঠবে, এটি ব্রংক্সের আরেকটি গল্প শুধুমাত্র।”
কেন্দ্রীয় এই চরিত্রের ভয়েসওভার ন্যারেশানই দর্শকের গল্পবর্ণনাকারী। সময়টা ১৯৬০। জায়গাটি ব্রংক্সের কেন্দ্রীয় অভিমুখ। চার্চের ঘণ্টা বেজে ওঠার সে শব্দ প্রতি ভোরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে গোটা প্রতিবেশীকূলে। ব্রংক্সের রাস্তাগুলোতে গাড়িঘোড়ার শব্দের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে ভেসে আসত তখন ‘ডু-ওপ’ এর শব্দ (‘রিদম অ্যান্ড ব্লুজ’ গানের একটি সাবজঁনরা এই ডু-ওপ)। প্রতি মোড়েই যেন জন্ম হতো তখন একটি করে ডু-ওপ গ্রুপের। ‘নিউ ইয়র্ক ইয়াঙ্কি’র তখন জয়জয়কার। ‘ম্যাকি ম্যান্টল’ তো কেন্দ্রীয় এই চরিত্রটির কাছে ভগবানতুল্য তখন। এসব বলতে বলতে বড় স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে চরিত্রটি।
তবে গল্প থামে না। ইটালিয়ানদের এই পাড়ায় গ্রীষ্মের ঘর্মাক্ত সেই অসহনীয় রাতগুলোতে স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের বুকে স্বস্তি খুঁজে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। কেন্দ্রীয় চরিত্র তার তেতলার সেই বাসাটির কথা বলে। বিল্ডিংয়ের নিচের ওই সিঁড়ি তার প্রিয় বসার জায়গা। ওখানটায় বসে সে গোটা প্রতিবেশীকূল দেখতে পেতো। তবে দেখত সে বিশেষ একজনকেই। ল্যাম্পপোস্টের নিচে ব্যাকব্রাশ করা চুল আর কোনরকম ভাঁজ না পড়া স্যুটের ‘সনি’কে দেখতো সে। গোটা পাড়া সনিকে ভালোবাসত। ভগবান মানত। ল্যাম্পপোস্টের ঠিক নিচে দাঁড়িয়েই সনি তার ব্যবসা সামলাত। তবে সেই দিনটির আগে সনি কখনো কেন্দ্রীয় চরিত্রটির দিকে ফিরেও তাকায়নি। সেই দিনটির গল্প বলতে গিয়েই ন্যারেটর এবার একটু দম নেয়। নাটকীয়তার ছলে যেন বলছে, “রোসো, গোড়া থেকেই বলি”।
সিনেমার প্রারম্ভিক দৃশ্যটি ভয়েসওভার ন্যারেশানের সাথে শুধু একাত্ম করে না দর্শককে, বরং গোটা আমেজটায় টেনে নেয়। ব্রংক্সের ওই মোড়গুলোতে বাঁক নিতে গিয়ে দর্শকও যেন দাঁড়ায় তার শৈশবের সামনে। ন্যারেটরের বয়ানভঙ্গিমা স্মৃতিকাতরতা জাগায় দর্শকমনে। এবং সিনেমার বাকি সময়ে অনেকবার অনেক দৃশ্যে জাপ্টে ধরে সেই কাতরতা। ব্রংক্সের পরিবেশটাকে ছোঁয়া যায় যেন রীতিমতো। তীব্রভাবে অনুভব করা যায়।
সিনেমার এই ন্যারেটরের নাম কলোজেরো। ন’ বছর বয়সী কলোজেরো বাসার সামনের দাওয়ার মতন জায়গাটায় বসে বন্ধুদের সাথে হুল্লোড়ে মাতে আর সনিকে লক্ষ করে। সনি তার কাছে আদর্শের আরেক নাম। কিন্তু তার বাসচালক পিতার কড়া বারণ, সনির কাছেপিঠে না ঘেঁষার। কারণ সনি যে গ্যাংস্টার। কলোজেরোর বাবা বলে, সনিকে কেউ ভালোবাসে না, সবাই ভয় পায়। তাই মানিয়ে চলে। কিন্তু কলোজেরো অতকিছুর ধার ধারে না। কিশোর বয়সে পাড়া/মহল্লায় খানিকটা ভারিক্কি চালে ক্ষমতা নিয়ে হাঁটা বড় ভাইয়ের ব্যক্তিত্বের প্রতি আলাদা যে আকর্ষণ তৈরি হয়, সে আকর্ষণই এটি। তবে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকা সনি কখনো ফিরে চায়নি সেই কিশোরের দিকে।
যেদিন চাইল, সেদিন একদম সামনাসামনি, একদৃষ্টে। পার্কিং লটে সেদিন গুলি চালানোর পর যখন সনি গাড়িতে উঠে যাচ্ছিল, তখন তার চোখাচোখি হয় কলোজেরোর সাথে। স্বাভাবিকভাবেই কলোজেরোর ভীত হওয়ার কথা। কিন্তু না। ঘটনার আকস্মিকতা কলোজেরো টের পায়নি। তার ওপর তার প্রিয় মানুষটি অবশেষে যখন তার দিকে তাকাল, তখন উৎকণ্ঠা আর আনন্দের অদ্ভুত এক অনুভূতি কিশোর কলোজেরোর মনে খেলে যায়। সাথে সনির সেই ঠাণ্ডা, হিমশীতল দৃষ্টি এ-ও বুঝিয়ে দেয়, যেচেপড়ে লাগতে আসাটা সনির একদমই অপছন্দের।
ভেতরের সেই বার্তাটুকু হয়তো কিশোর কলোজেরো সেদিন বুঝতে পেরেছিল কিংবা তার শ্রদ্ধার মানুষটির কাছে ঘেঁষতে চেয়েছিল, দু’টির কোনো একটি কিংবা দু’টির কারণেই পুলিশের কাছে ঘটনাটি প্রকাশ করা থেকে চেপে গেলো সে। আর চেপে যাওয়াতেই সেদিন সনির চোখ এড়ায়নি ওই কিশোরটি। গ্যাংস্টার সনি আর কিশোর কলোজেরোর মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সময়ের সাথে সাথে যা আরো বেশি হৃদ্যতায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সনির গ্যাংস্টার জেল্লার কাছে ফিকে হয় কলোজেরোর বাবার বারণ। তবে বাবার নীতিকেও জলাঞ্জলি দেয় না সে। বাবা যখন বলে, রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দিনভর পেট চালানোর তাগিদে ছুটে বেড়ানো মানুষটিই খাঁটি মানুষ, তা কলোজেরো কানে নেয়। আবার সনি যখন সৎ হতে গিয়ে গরীবি বেছে নেওয়া মানুষদের উদ্দেশ করে নাট সিঁটকানি উপহার দেয়, তাতেও কলোজেরো মৌন সম্মতি জানায়। উভয়কে পাশে রেখেই পূর্ণ কৈশোরে পা বাড়ায় সে।
১৯৬৮ সাল তখন। ব্রংক্সের হাওয়ায় তখন পরিবর্তনের বেগ। বদলে যাচ্ছে সবকিছু। ‘বিটলস’ কাঁপাচ্ছে গোটা পৃথিবী। কৃষ্ণাঙ্গদের আলাদা পাড়া হয়েছে ব্রংক্সে। ব্রংক্সের মতোই পরিবর্তন আসে সিনেমার দৃশ্যপটে। নতুন চরিত্র আর ঘটনার মোড় আসে কলোজেরোর জীবনে। অনেককিছুই আর আগের মতো নেই। সময়টা এগিয়েছে যেন শুধু নতুন জটিলতার উত্থান ঘটাবে বলে। বাবার নীতিবোধ আর সনির রূঢ় বাস্তববোধ সাথে নিয়ে নতুন এই ক্যানভাসে কলোজেরো চাইলেই আর পারছে না সবকিছুকে শৈশবের মতো সরলীকরণ করতে। “নষ্ট হয়ে যাওয়া মেধার চেয়ে হতাশাজনক কিছু নেই”– বাবার সেই বাণী তখন আরো মর্মভেদী হয়ে উঠতে থাকে তার জীবনে।
অভিনেতা ‘রবার্ট ডি-নিরো’, এই (‘অ্যা ব্রংক্স টেল’) সিনেমাটি দিয়েই প্রথমবারের মতো ক্যামেরার সামনে থাকার পাশাপাশি ক্যামেরার পেছনে পরিচালকের ভূমিকা পালন করেছেন আর বেছে নিয়েছেন ‘চ্যাজ পালমিন্তেরি’র মঞ্চনাটককে। ৬০ দশকে ব্রংক্সে বেড়ে উঠার স্বীয় অভিজ্ঞতাকেই নাট্যরূপ দিয়েছিলেন পালমিন্তেরি। আর সে নাট্যরূপকে সিনেমায় রূপ দিতে গিয়ে পালমিন্তেরিকে পাশে রেখেই গুরু এবং বন্ধু ‘মার্টিন স্করসেজি’র পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন ডি নিরো। ৬০ দশকের স্মৃতিকথায় ব্যাকুলতা প্রকাশ করা ‘অ্যা ব্রংক্স টেল’কে বলা যায়, ‘গুডফেলাস’ উইদ হার্ট !
শহুরে ল্যান্ডস্কেপ আর পিরিয়ডিক্যাল সেটিং নিয়ে গুডফেলাসের পরিচিত ভূমিতে দাঁড়িয়েছে ‘অ্যা ব্রংক্স টেল’। তবে স্মৃতিকাতরতা’তেই আবদ্ধ থাকেনি ব্রংক্স টেল। ইতালিয়ান-আমেরিকান এই যুবকের বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতাতে ভিন্ন কোণও এনেছে। ৯ বছর বয়সী কলোজেরোর দৃষ্টিভঙ্গি ধরে বর্ণিত হতে গিয়ে খুব স্বল্প সময়েই নিজস্ব ছন্দ আর পটভূমি খুঁজে পেয়েছে, অ্যা ব্রংক্স টেল।
অ্যা ব্রংক্স টেলের সর্বোচ্চ চমৎকারিত্ব উঠে আসে এর বিবরণে। প্রতিবেশীকূলের ঝকঝকে বাড়িঘর, পরিষ্কার সড়ক, ফোর্ড মাস্টাং, শেভি ক্যামারো’র মতো ষাটের বিখ্যাত সব গাড়ি, সামাজিক ক্লাবগুলো, হাই হিল আর আঁটোসাঁটো পোশাক পরিহিতা তরুণীরা- এ সবকিছু গোটা ষাটের আমেরিকাকে এত নিখুঁত আর সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে তুলে আনে, অতীতের জানালাটা খুলে যে কেউই বেরিয়ে পড়তে চাইবে।
তবে পালমিন্তেরির চিত্রনাট্য শুধু বিবরণীয় হয়ে উঠতে চায়নি, ধরতে চেয়েছে সেই সময়টার সামগ্রিকতাও। তা বলেই তো, অনেক অনেক চরিত্র আর জীবনবোধের শিক্ষার ভেতরে ওই সময়টার বর্ণবিদ্বেষ, তখনকার গ্যাংস্টার জীবনধারার প্রতি তরুণদের সচেতন আগ্রহ, ইতালিয়ান পরিচিতির দ্বন্দ্বের মতো গভীর এবং নিগূঢ় বিষয়গুলোকে স্থান দিয়েছে। সাথে কৈশোরে পদার্পণের উচ্ছলতা, প্রথম প্রেমের সুমিষ্ট অনুভূতি ও অস্থির সময়গুলোকে তুলে ধরে দর্শক হৃদয়ে জাগাতে চেয়েছে অনুনাদ।
পালমিন্তেরি শুধু চিত্রনাট্যকার হিসেবেই নয়, সিনেমার অভিনেতা হিসেবেও ছিলেন। নিজের মঞ্চনাটকে গল্পের সবক’টি চরিত্র তিনি নিজে রূপায়ন করলেও সিনেমায় শুধুমাত্র গ্যাংস্টার সনির চরিত্রটিই রূপায়ন করেছেন। তবে প্রথাগত গ্যাংস্টার চরিত্র নয় এই ‘সনি’। গ্যাংস্টার চরিত্রের সবক’টি ক্লিশেকে পাশ কাটিয়ে ভারি সেয়ানা, রসিক, চিন্তাশীল এবং তুলনামূলক মানবিক একটি চরিত্র হিসেবে সনিকে চিত্রায়িত করেছেন পালমিন্তেরি। এবং পালমিন্তেরি তার অভিনয় দিয়ে নিরলসভাবেই সিনেমার প্রথম থেকে শেষ অব্দি প্রভাব বিস্তার করে গেছেন। কলোজেরোর বাবার চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন রবার্ট ডি নিরো।
বর্ণবাদ আর প্রতিহিংসার অযৌক্তিক ধারণা এই চরিত্র পোষণ করলেও ডি-নিরোর সংবেদনশীল অভিনয় সেটুকুকে ঢালাও হয়ে উঠতে দেয়নি। আর সবক’টি চরিত্র পালমিন্তেরির সৃষ্ট হওয়ায় চরিত্রদের মাঝে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মুহূর্তগুলো তিনি ঠিকঠাক তৈরি করতে পেরেছেন। সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র কলোজেরোর দুটি বয়সে অভিনয় করেছেন দুই অভিনেতা। ৯ বছর বয়সে ‘ফ্রান্সিস ক্যাপরা’ এবং ১৭ বছর বয়সে ‘লিলো ব্র্যাংকাতো’, দুজনের অভিনয়ই পরিমিত। বিশেষ করে শৈশবের চরিত্রটিতে ফ্রান্সিস ক্যাপরার অভিনয় সরলতা আর বিশুদ্ধতায় ভরা।
সিনেমায় নারী চরিত্রগুলোর গঠন অবশ্য অপরিপুষ্ট। তাছাড়া কলোজেরো এবং জেইনের প্রেমময় সাবপ্লট সিনেমার বর্ণবিদ্বেষের বক্তব্যকে আরো শক্তিশালী করে তুলতেই শুধু সৃষ্ট কি না, তেমন প্রশ্ন জাগলেও ডি-নিরোর দক্ষ পরিচালনায় সেসব জোরালো হয়ে উঠেনি।
গুরু ও বন্ধু স্করসেজিকে অনুসরণ করতে গিয়ে স্করসেজির ‘র’ প্রকৃতি তুলে আনায় খানিক ভাঁটা পড়লেও অ্যাকশন আর হাস্যরসের মাঝে ক্লাসিক ক্রাইম, ড্রামার সেই তীব্র গন্ধটা ঠিকই নাকে এসে ধাক্কা দেয়। একইসাথে আবার মানবিক অন্তরঙ্গতায় উদ্বেলিত হয়েছে, অ্যা ব্রংক্স টেল। কলোজেরোর দৃষ্টিকোণ থেকেই যেহেতু সিনেমার ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠিত, তাই এই গ্যাংস্টার জীবনধারা, বর্ণবিদ্বেষের চিত্র দর্শক ততটুকুই দেখতে ও জানতে পায়, যতটুকু কলোজেরো দেখছে এবং জানছে। এই ন্যারেটিভে ক্রাইম আর টিন-ড্রামার সমতাটাও নিরো করেছেন দক্ষতার সাথে।
সিনেমাটোগ্রাফার ‘রেনাল্ডো ভিলালোবস’-এর সহায়তায় অন-লোকেশন শ্যুটিং করে সিনেমার আমেজকে একদম জীবন্ত করে তুলেছেন ডি নিরো। পরিচালক হিসেবে ডি নিরো বিচক্ষণ। চটকদারিতা থেকে নির্মেঘ দূরত্ব রেখেছেন। গল্প এবং চরিত্রে, মোদ্দাকথা ভাবের দিকটিতে গুরুত্ব দিয়েছেন কারিগরি দিকে চটকদার হয়ে ওঠার চেয়ে। তবে আলাদা করে উল্লেখ্য হওয়ার দাবি করে সিনেমার আবহসঙ্গীত। একেবারে নিখুঁত সঙ্গীতায়োজন। সময়ের সাথে মিল রেখে প্রতিটি সঙ্গীত নির্বাচন করা হয়েছে। স্করসেজির সিনেমার মতো প্রতিটি সঙ্গীতই সিনেমায় চলমান ঘটনাবলীর উপর সূক্ষ্ম বক্তব্য রেখেছে রীতিমতো।
‘অ্যা ব্রংক্স টেল’ একইসাথে ভ্রূ নাচিয়ে হেসে ওঠার মতো এবং হৃদয় ভারি করে তোলার মতো সিনেমা। পরিচালক রবার্ট ডি নিরো, দর্শকের মাঝে হাসি, কান্না, রাগের মতো একদম খাঁটি মানবিক আবেগগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সঠিক নোটেই হিট করেছেন। সামাজিক এবং নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়ে যায় অ্যা ব্রংক্স টেল, আরোপিত হয়ে ওঠা ছাড়াই।