২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। সিরিয়ার অবরুদ্ধ হোমস শহরের মাইলের পর মাইল ধ্বংস্তুপের উপর দিয়ে নিভৃতে উড়ে চলছে সরকারী বাহিনীর একটি ড্রোন। ঈগলের তীক্ষ দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে একটি নির্দিষ্ট স্যাটেলাইট ফোনের অবস্থান, যে ফোন দিয়ে গত কয়দিন ধরে সানডে টাইমসের সমর প্রতিবেদক ম্যারি কোলভিন যোগাযোগ করছিলেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাথে; বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিচ্ছিলেন বেসামরিক জনগণের উপর আসাদ বাহিনীর তীব্র আক্রমণের কথা, নির্বাচার হত্যাকাণ্ডের কথা।
বাশার আল-আসাদ বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত ব্রিটেনের সানডে টাইমস পত্রিকার সমর প্রতিবেদক ম্যারি কোলভিনের উপর নির্মিত A Private War চলচ্চিত্রের শুরুর দৃশ্য এটি। এর পরপরই চলচ্চিত্রটি আমাদেরকে নিয়ে যায় প্রায় এক দশক পেছনে। ফ্ল্যাশব্যাকে একের পর এক দেখানো হতে থাকে ম্যারি কোলভিনের সাংবাদিক জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো। চলচ্চিত্রটির একেবারে শেষের দিকে শুরুর দৃশ্যটি আবারও ফিরে আসে, যখন দেখানো হয় কীভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে সত্য তুলে ধরতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন ম্যারি কোলভিন।
ম্যারি কোলভিন ছিলেন এমন একজন সাংবাদিক, যিনি মৃত্যুকে পরোয়া করতেন না। তার পুরো জীবন কেটেছে যুদ্ধের ময়দানে ঘুরে ঘুরে। লেবানন, ফিলিস্তিন, চেচনিয়া, কসোভো, সিয়েরা লিওন, জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কা, পূর্ব তিমুর, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া- বিশ্বের খুব কম যুদ্ধক্ষেত্র আছে, যেখান থেকে তার সময়ে তিনি রিপোর্ট করেননি। যুদ্ধের বিকট শব্দ, ছিন্নভিন্ন শরীরের রক্তাক্ত দৃশ্য, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস তাকে তাড়া করে ফিরেছে সারা জীবন। তারপরেও তিনি বারবার ছুটে গেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে, কোনো কোনো সময় তার সম্পাদকদের নির্দেশ অমান্য করেই।
সানডে টাইমসের হয়ে ম্যারি কোলভিন কাজ শুরু করেন ১৯৮৫ সালে। ১৯৮৬ সালে রিগ্যান প্রশাসন যখন লিবীয় নেতা মোয়াম্মার আল-গাদ্দাফিকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার বাসভবনের উপর বিমান হামলা পরিচালনা করে, তখন ম্যারিই ছিলেন প্রথম সাংবাদিক, যিনি গাদ্দাফির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরুর পরেও গাদ্দাফির প্রথম সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তিনি। ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাতের মোট ২৪টি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ম্যারি। আরাফাতের উপর বিবিসির একটি প্রামাণ্যচিত্র রচনা এবং প্রযোজনাও করেছেন তিনি।
১৯৮৭ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধে সিরিয়া সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীর স্নাইপারের গুলিতে নিহত এক ফিলিস্তিনি বৃদ্ধার উপর করা তার রিপোর্ট বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। এ রিপোর্ট করার জন্য তিনি প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্য দিয়ে মিলিশিয়াদের বাধা এড়িয়ে ২০০ গজ পেরিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন অবরুদ্ধ এলাকায়। পুরো সময়টা তিনি তার ফটোগ্রাফারের হাত ধরে রেখেছিলেন এই আশায় যে, যেকোনো একজন গুলি খেলেও অন্যজন তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারবে।
১৯৯৯ সালে পূর্ব তিমুর ছেড়ে অন্য সবাই যখন পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন ম্যারি কোলভিনের অনড় অবস্থানের কারণেই প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল প্রায় ১,৫০০ নারী এবং শিশু। ২০০৩ সালে মার্কিন সেনারা ইরাকের ফাল্লুজাতে পৌঁছানোর আগেই সেখানে প্রবেশ করেন ম্যারি। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে লেক হাবানিয়ার এক পরিত্যক্ত বধ্যভূমির মাটি খুঁড়ে ৯ ফুট নিচ থেকে তিনিই বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত করেন ৬০০ কুয়েতি যুদ্ধবন্দীর এক গণকবর, ১৯৯১ সালে সাদ্দাম হোসেনের বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর থেকেই যারা নিখোঁজ ছিল।
ম্যারি কোলভিনের সাংবাদিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি ঘটে ২০০১ সালে, যখন তিনি সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগারদের নিয়ন্ত্রণে থাকা গহীন জঙ্গলে যান এক বিদ্রোহী নেতার সাক্ষাৎকার নিতে। সেখান থেকে ফিরে আসার সময় সরকারি বাহিনী যখন তাদের উপর আক্রমণ করে, তখন নিজের সাংবাদিক পরিচয় জানানোর পরেও রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেডের আঘাতে ছিটকে পড়েন এবং গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ভাগ্যক্রমে ঠিকই বেঁচে যান, কিন্তু তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায় চিরতরে।
চোখ হারালেও দমে যাননি সে সময়ের ৪৪ বছর বয়সী ম্যারি কোলভিন। কালো রংয়ের একটি আইপ্যাচে চোখ ঢেকে এক চোখ নিয়েই তিনি ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন যুদ্ধের ময়দানে। তার সাংবাদিক জীবনের বড় বড় অর্জনগুলোর অনেকগুলোই এসেছিল চোখ হারানোর পর। এমনকি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে গুরুতর আহত অবস্থায়ও তিনি তার দায়িত্ব থেকে বিরতি নেননি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিনি লিখে শেষ করেছিলেন তামিল টাইগারদের উপর ৩,০০০ শব্দের একটি প্রতিবেদন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তা প্রকাশিত হয়েছিল সানডে টাইমসের পাতায়।
অ্যা প্রাইভেট ওয়ার চলচ্চিত্রটি শুরু হয়েছে ম্যারির শ্রীলঙ্কা মিশন দেখানোর মধ্য দিয়েই। সিনেমাটির কাহিনী রচিত হয়েছে ম্যারির মৃত্যুর পর ভ্যানিটি ফেয়ার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘MARIE COLVIN’S PRIVATE WAR’ শিরোনামে ম্যারি ব্রেনারের একটি স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধের উপর ভিত্তি করে। তবে প্রবন্ধটিতে ম্যারির সাংবাদিক জীবনের অনেকগুলো ঘটনা উঠে এলেও চলচ্চিত্রের সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে সেখানে সবগুলো ঘটনা স্থান পায়নি। শ্রীলঙ্কার পর ইরাক, আফাগানিস্তান এবং লিবিয়ার একটি করে ঘটনা দেখানোর পর চলচ্চিত্রের সর্বশেষ দৃশ্যে তুলে ধরা হয়েছে তার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো। আর এর ফাঁকে ফাঁকে ছিল তার অনেকটা নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের চিত্র, যুদ্ধের ভয়াবহতাকে ভুলে থাকার জন্য ধূমপান, মদ্যপান আর যৌনতায় ডুবে থাকার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার টুকরো টুকরো দৃশ্য।
চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন ম্যাথিউ হাইনম্যান, যিনি এর আগে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তের মাদক পাচার সমস্যা নিয়ে নির্মিত কার্টেল ল্যান্ড নামক ডকুমেন্টারির জন্য অস্কার মনোনয়ন পেয়েছিলেন। এছাড়াও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের উপর নির্মিত তার ডুকেমেন্টারি সিটি অব ঘোস্টসও বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। অ্যা প্রাইভেট ওয়ার চলচ্চিত্রটিও তিনি অনেকটাই ডকুমেন্টারি স্টাইলে নির্মাণ করেছেন। এখানে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, গল্প কিংবা আবেগের চেয়ে পরস্পরের সাথে আপাত সম্পর্কহীন যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর টুকরো টুকরো দৃশ্য এবং সেগুলোর ভয়াবহতাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
চলচ্চিত্রে ম্যারি কোলভিনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাম্প্রতিক সময়ের সাড়া জাগানো গন গার্ল চলচ্চিত্রের আলোচিত অভিনেত্রী রোজামুন্ড পাইক। অনিন্দ্য সুন্দরী রোজামুন্ড পাইক এ চলচ্চিত্রের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলেছিলেন। তার মেকআপ নেওয়া রুক্ষ চেহারা, উস্কখুষ্ক চুল, ভারী গলার স্বর এবং সর্বোপরি অকৃত্রিম অভিনয় যেন আসল ম্যারিকেই জীবন্ত করে তুলেছিল রূপালি পর্দায়। এ সিনেমায় অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি সেরা অভিনেত্রী হিসেবে গোল্ডেন গ্লোব মনোনয়নও পেয়েছিলেন।
অ্যা প্রাইভেট ওয়ার সিনেমাটি সমালোচকদের কাছে মোটামুটি ভালো হিসেবেই সমাদৃত হয়েছে। মেটাক্রিটিক্স ওয়েবসাইটে এর স্কোর ৭৬। সেখানে ২৮ জন সমালোচকের মধ্যে ২৪ জনই একে পজিটিভ হিসেবে স্কোর দিয়েছেন। বাকি ৪ জন দিয়েছেন মিক্সড স্কোর। অন্যদিকে রট্যান টমাটোজ ওয়েবসাইটে ৯১ জন সমালোচকের রায়ে সিনেমাটি ৮৯% ফ্রেশ এবং এর রেটিং ৭.৩। তবে সমালোচকদের বাইরে সাধারণ দর্শকরা এটিকে তুলনামূলকভাবে কম ভালো হিসেবে রায় দিয়েছে। রটেন টমাটোজে ৬৬% সাধারণ দর্শক এটি পছন্দ করেছে। অন্যদিকে আইএমডিবিতে এর রেটিং ৬.৮।
হলিউড সবসময়ই যুদ্ধকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রগুলোতে নিজেদের সৈন্যদের বীরত্ব তুলে ধরতে পছন্দ করে। সিরিয়া যুদ্ধে যেহেতু আমেরিকানরা সরাসরি যুদ্ধ করেনি, তাই এক্ষেত্রে সে ধরনের চলচ্চিত্র এখনও নির্মিত হয়নি। এক্ষেত্রে তাই সাংবাদিকদের বীরত্বই তাদের একমাত্র ভরসা। অ্যা প্রাইভেট ওয়ারেও সেই ফর্মুলা অনুযায়ী শুধু ম্যারি কোলভিনের গল্পই উঠে এসেছে।
তিনি যাদের সাথে কাজ করেছেন, কিংবা যাদের গল্পগুলো বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য তিনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে ছুটে গিয়েছিলেন, তাদের গল্প এই সিনেমায় একেবারেই স্থান পায়নি।
তারপরেও একজন সমর প্রতিবেদকের জীবন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার পরেও তা কীভাবে তার জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে, সেগুলো বোঝার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা।