কাল পতঙ্গ
উপন্যাসের নামে, প্রচ্ছদে কাফকার ‘মেটামরফোসিস’-এর ভাইব পাওয়া যায়। গল্পের একটা অংশে, সেটা অবশ্য সরাসরিই স্বীকার করা হয়েছে। মূল চরিত্র সহিদের যে মনস্তাত্ত্বিক রোগ, সেটাকে বলা হয়েছে ‘গ্রেগর সামসা সিনড্রোম’। তবে এই গল্পকে মেটামরফোসিসের মতো নিগূঢ় ভাবার অবকাশ নেই। ওই ভাইবের কথা বাদ দিলে গল্পের প্রকৃতি আর চরিত্রের আর্ক অনুযায়ী বরং স্টিফেন কিংয়ের ‘থিনার’ গল্পের ছায়াই বেশি চোখে পড়ে। ‘থিনার’ও তার বডি-হররের ব্যাপারে মেটামরফোসিসের অনুপ্রেরণা ব্যবহার করেছে। যাক, সেটা অন্য কথা। এই বইয়ের মূল চরিত্র সহীদ যেভাবে তার নিজের শরীরের পরিবর্তন অবলোকন করে, আর তাতে চরম ভীত হয় এবং শেষে (গলপা) আদিবাসীদের কাছে যেভাবে পরিত্রাণ পেতে যায়- এই গোটা গ্যামাটেই স্টিফেন কিংয়ের ‘থিনার’ উপন্যাসের ছায়া/অনুপ্রেরণা আছে।
থ্রিলার লেখক রবিন জামান খান ‘কাল পতঙ্গ’ উপন্যাস দিয়ে আরেকটি নতুন সিরিজের অবতারণা করলেন। তার ‘সপ্তরিপু’, ‘ব্ল্যাক বুদ্ধা’, ‘মগরাজ’ এগুলো যেমন ‘সময়’ সিরিজের অন্তর্ভুক্ত, তেমনি এই বই ‘পাপ সিরিজ’-এর প্রথম দান। জনরায় সাইকোলজিক্যাল ফ্যান্টাসি, যে গল্পের নায়ক সহিদ উদ্দিন। একজীবনে সৎ ছিল। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার আদর্শ ভুলে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে সে। চাকরিতে আরো একধাপ উন্নতি করতে সম্প্রতি সে ‘গলপা’ নামের একটা ছোট্ট আদিবাসীদের পৈতৃক জায়গা, মন্ত্রীর ছেলেকে হস্তগত করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। কোটি কোটি টাকার বিনিময় যেখানে জড়িত। সহিদ উদ্দিন তার বাবার আদর্শ থেকে সরে আসলেও একটা সূক্ষ্ম অনুশোচনাবোধ আর দ্বন্দ্ব তাকে ঘিরে রাখে। এদিকে, হাজার হাজার মানুষকে ভূমিছাড়া করে ঘুষের টাকায় তৈরি নতুন বাড়িতে উঠবার পর পরই তার শরীরে কেমন জানি একটা পরিবর্তন আসতে থাকে। অস্বস্তিকর সুড়সুড়ি দিয়েই এসবের শুরু। ধীরে ধীরে যেটা আরো ভয়ানক ব্যথার রূপ নেয়।
পায়ের আঙুল ফেটে আস্তে আস্তে এক পতঙ্গের শুঁড় বের হবার ঘটনা দিয়েই তার ভয়ংকর অস্থিরতার শুরু। এই পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই সে দেখতে পায় শুধু। কারণ পাপের আঁধারে যে সে-ই আছে। যতই সহিদ গলপাদের উৎখাতের এই প্রজেক্টের দ্বারপ্রান্তে যায়, ততই তার শরীরের বেদনা, মনোজগতের ভয় আর পতঙ্গে রূপান্তর আরো দ্রুত চরমে উঠতে থাকে। এসবের শেষ কোথায়, সেই প্রশ্ন আর শান্তশিষ্ট গলপাদের নিজস্ব এক তমসাচ্ছন্ন ইতিহাস নিয়েই গল্প এগোয়।
অভিনব কোনো গল্প নয়। চেনাজানা অলঙ্কার আর সাধারণ প্রকৃতির গল্প। না, বলছি না ভাবনাতীত কোনো আরোপিত টুইস্ট; নাছোড়বান্দার মতো ক্ষণেক্ষণে গল্পবাঁক বদলানোর মতো উপাদানে ভারী হতে হবে এই গল্পকে। কিন্তু নৈতিক চেতনা, আদর্শ আর অনুশোচনার মতো বিষয়াদিগুলো যে গল্পে বাঁধা হলো, সেটা আরেকটু সতেজ এবং গভীর ও চিন্তার উদ্রেককারী হতে পারতো। গল্পটি লেখক চরিত্রনির্ভর গল্পের ঢঙে সাজিয়েছেন। সহিদ উদ্দিনের মনোজগত বিশ্লেষণ এবং ধীরে ধীরে তার জীবনে যে প্রবল ধস নামে সেটার নকশার ভেতর দিয়েই বাকি গল্প। বয়ানভঙ্গিমা আর ভাষাশৈলী মাঝারি গোছের হলেও বয়ানে গতিময়তা আছে। স্বতঃস্ফূর্ত ভাব থাকবার কারণেই গতি পাওয়া যায়। আরেকটি সুবিধা হলো লেখক রবিন জামান খানের গদ্যভাষায় বাহুল্য কম থাকে। মেদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। তবে গল্পের শুরুটা করতে, সেটিং আর আবহটা তৈরি করতে তিনি ক্লিশের আশ্রয় নিয়েছেন একটু। সেখানেই মূলত মেদটা চোখে পড়ে। এছাড়া বিরক্তির উদ্রেক হয় না কখনো।
পরের দান আনবেন বলে সমাপ্তিতে করেছেন একটু তাড়াহুড়ো। আর কিছু ব্যাখ্যা বোধকরি এই সিরিজের পরের বইয়ে পাওয়া যাবে। তবে তার সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার সিরিজের শুরুটা যেমন ‘শব্দজাল’ এর মতো একটা ভালো বই দিয়ে হয়েছে, এই পাপ সিরিজের সূচনাও আরেকটু ভালো করে বোনা কোনো গল্প দিয়ে হতে পারতো।
অদ্ভুত আঁধার এক
মনোয়ারুল ইসলামের এই সুপারন্যাচারাল হরর উপন্যাস, ভাবগতিকে ‘লাভক্রাফটিয়ান হরর’। লাভক্রাফটের গল্পের মতো অদ্ভুত দানব/প্রাণী/আকৃতির অস্তিত্ব এখানে আছে। ব্যাখ্যার দিক থেকে উন্মুক্ত আর নুন্যোক্ত থাকার ব্যাপারও আছে। তার মাঝ দিয়ে যে গল্প, তা রতনের। জন্মের পরই তার বাবা তাকে ছুঁড়ে ফেলে বলে, “এ মানুষের বাচ্চা নয়। দানব!” কারণ রতনের কোমর থেকে নীচের অংশটি নেই। সেই জায়গায় রয়েছে বিকটদর্শন লেজ! পিলে চমকে যাবে যে কারো। কিন্তু পেটে ধরার খাতিরে মতিয়ারা এই ছেলেকে ফেলে দেয়নি। বড় করেছে। রতনের জন্মের পেছনেও রয়েছে ভয়ানক রহস্য। জংগলের ওই ছাতিম গাছের তলায় যে রহস্যের সূত্রপাত। সেই জায়গাটা গ্রামের, পৃথিবীর। কিন্তু সেই জায়গা যাদের দখলে তাদের অস্তিত্ব পৃথিবীর নয়! রতনের জন্মের সাথে সেই জায়গার কী সম্পর্ক? কেন রতন যায় সেখানে? ওই জায়গার অন্ধকার ধীরে ধীরে রতনের মাঝে প্রবেশ করে তাকে আরো বিকৃত করে তোলে। ওই আদিম অন্ধকার আর ব্যাখ্যাতীত রহস্য নিয়েই গল্প এগোয়।
লাভক্রাফটের গল্পের উপাদান এতে ভালোভাবেই বিদ্যমান। ব্যাখ্যাতীত ভয়, যা সরাসরি শরীরের সাথে সম্পর্কিত হয়ে ওঠে একসময়, বডি-হররের মতো। এই সবকিছুই এতে আছে। আকর্ষণীয় লেগেছে লাভক্রাফটিয়ান নকশাকে লেখক যেভাবে গ্রামীণ সেটিংয়ে ফেলেছেন। মূল গল্প রতনকে ঘিরে। রতনের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে, যদিও সেটা অত নিগূঢ় হয়নি। তবে তার যৌনক্ষুধার বয়ান যেভাবে করা হয়েছে তাতে পরিপক্বতা আছে। মতিয়ারা আর রতন, মা-ছেলের ডায়নামিক বেশ ভালো। লাভক্রাফটিয়ান হওয়ায় বডি-হররের গা গুলানো রিনরিনে বর্ণনা তো থাকবেই, এবং সেটা মনোয়ারুল ইসলাম ভালোভাবেই আয়ত্ত করতে পেরেছেন। তাছাড়া, সাধারণ গ্রামীণ পরিবেশ ও তার মাঝেই একটা আলাদা জগত তৈরি করে দুটোকে সমান্তরালে নিয়ে যাওয়ার কাজ মসৃণভাবেই করতে পেরেছেন। আবহে ক্রিপি ভাবটা আছে যথাযথভাবে।
তবে সেসব ছাড়া বাকি গদ্যভাষা অতটা সৌকর্যময় হতে পারেনি। ডিটেইলের ব্যবহারে আরেকটু ব্যঞ্জনাময় তিনি হয়ে উঠতে পারতেন। তেমনটা না হয়ে ভাষাটা গৎবাঁধা আঙ্গিকে ছিল। টিনা এবং তার বরের সাবপ্লট কিছু পাতা বাড়ানো ছাড়া তেমন কোনো জরুরি উপাদান গল্পে যোগ করেনি। না থাকলেও গল্পের গতিপথে কোনো বিঘ্ন ঘটতো না। পড়তে খারাপ লাগেনি। তবে দক্ষতার সাথে আরো গুরুত্ববহ করে তোলা যেত এই সাবপ্লট। সমাপ্তিতে তাড়াহুড়ো আছে। অনেক রহস্য তাৎক্ষণিক ভয় জাগানো ছাড়া কোনো মাত্রা পায়নি। সেটা দেখা দরকার ছিল। তবে সেসব ছাড়া, মন্দ হয়নি। আর শেষে, মতিয়ারার যে পরিকল্পনা, সেটার উপস্থাপনে এমন সূক্ষ্মতা আর স্বল্পভাষী থাকার ব্যাপারটি দারুণ কাজ করেছে। ওটা বেশ চিন্তাশীল একটা চাল।
সবমিলিয়ে, ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ এর ধীরগতির আবহ আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পেরেছে। অতি ভালো গল্প নয়, তবে আগ্রহ জাগানিয়া। পড়তে মন্দ নয়। পরের কিস্তি আসলে লেখক যেন আরেকটু বিস্তৃত হোন প্রেক্ষাপটে, এবং সতর্ক হোন রহস্যের জাল গোটানোতে, সেটাই প্রত্যাশা থাকবে।
দরিয়া-ই-নুর
মোহাম্মদ নাজিমউদ্দিনের নতুন এই উপন্যাসিকাকে তিনি এক লাইনে বিশেষায়িত করতে চেয়েছেন, “সিনেমার জীবন, জীবনের সিনেমা” এই বলে। সেটা উল্লেখ করার কারণ হলো, কিছু ইন্ডালজেন্স এবং গড়পড়তা অলংকার ব্যবহারের উদ্দেশ্য ওতেই পাওয়া যায়। তবে সেসব ছাড়াও, এই গল্প ভালো কিছু নয়। নতুনও কিছু নয়।
মির্জা আশেক জেলখানা থেকে ১৫ বছর পর ছাড়া পায়। সিনেমার নায়ক হবার ইচ্ছা ছিল। হয়েছিল স্টান্টম্যান। দারিদ্র্যের বেড়াজালে আটকে, ফাইটমাস্টার দুদু আর পাতিনেতা বন্ধু পাভেলকে নিয়ে এক দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তার বাসায় ডাকাতির পরিকল্পনা করে। মূল হোতা দুদু মাস্টার। ডাকাতি সফল হয়। কিন্তু ঘটনাচক্রে মির্জা আশেক ঠিকই ধরা খায়। জেল হয়। জেলে বসে প্রতিশোধের এক পরিকল্পনা সাজায়। ছাড়া পায়। মিলিত হয় নেতাবন্ধু পাভেলের সাথে। লক্ষ্য এবার কোহিনূরেরর মতো দামি হীরা দরিয়া-ই-নূর হাত করা, যার উপর চকচক করছে প্রতিশোধের স্পৃহা।
পুরোদমে সিনেম্যাটিক গল্প। তবে ক্লিশেতে মোড়া। যেসব গল্প নানা ভাষার নানা সিনেমাতেই আরো ভালো অলংকারের সমন্বয়ে দেখতে পাওয়া গিয়েছে। শুরু থেকে শেষ অব্দি ভীষণ অনুমেয় গল্প। নতুন কোনো বাঁক নেই। দর্শকের অনুমানকে মিথ্যা প্রমাণ করবার দায়ও গল্পের কোনো জায়গায় চোখে পড়ে না। যেসব ড্রামাটিক আয়রনির ব্যবহার আছে, তা যদিও মন্দ নয়, তবে বহু পুরনো। চাইলেই শুধু কথায় কথায় গল্প শেষ না করে দরিয়া-ই-নূরের হাত ধরে যে একছটাক ইতিহাস এসেছে, যে পরিকল্পনা একে ঘিরে করা হয়েছে, সেসবের আরেকটু বিশদ বয়ান দেওয়া যেত।
না করায় বরং অতিরঞ্জন আর সিনেম্যাটিক কড়চার উপস্থিতি একটু বেশিই হয়ে গেছে। নাজিমউদ্দিনের লেখায়, বর্ণনায় গতি আছে; তা ঠিক। ও কারণেই পড়ে যাওয়া যায়। কিন্তু গতির কথা বাদ দিলে এই গদ্যে আলাদা কোনো আকর্ষণ নেই। একই ভঙ্গীতে, একই ভাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়া একপেশে গদ্য। নতুন কোনো ইনসাইট এতে নেই। ডিটেলিং দেখে চমকাতে হয় না, থমকাতে হয় না, প্রফুল্ল হতে হয় না। পরিবেশ ছোঁয়াও যায় না। অথচ থ্রিলারে তো সেটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। এবং সেটা অর্জন করাটা দক্ষতার সাথেই সম্পর্কিত। সেই সবকিছুর অনুপস্থিতিতে ‘দরিয়া-ই-নুর’ হীরাটা আকর্ষণীয় হলেও, এই গল্প অনাকর্ষণীয়।