‘দান চোখে দেখা যায়, কিন্তু আদান হৃদয়ের ভিতরে লুকানো’
– নৌকাডুবি (১৯০৬)
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত কিংবা সমালোচিত ব্যক্তিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সুদীর্ঘ জীবনে প্রায় আড়াই হাজার গান, আনুমানিক দুই হাজার ছবি, অজস্র কবিতা, ছোটগল্প লিখলেও উপন্যাসের সংখ্যা সে তুলনায় কম, মোট ১৩টি। ১৯০৬ সালে নৌকাডুবি প্রকাশিত হবার আগেই প্রকাশ পেয়েছে বউ ঠাকুরানীর হাট, রাজর্ষি ও চোখের বালি।
জটিল মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস ‘চোখের বালি’ প্রকাশিত হবার ৩ বছর পর ‘নৌকাডুবি’ প্রকাশিত হয়। আশ্চর্য কিন্তু সুন্দর, নিরুত্তাপ কিন্তু সতেজ একটি উপন্যাস। এক কালবৈশাখী ঝড়ে সব কিছু ওলট-পালট হওয়ার গল্প, ভাগ্যের হাতে চারটি মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রিত হবার গল্প।
কাহিনী-সংক্ষেপ
কাহিনীর শুরুতেই রমেশের বাবা ব্রজমোহন আকস্মিক কলকাতায় এসে উপস্থিত হন। বাবার বন্ধুর মেয়েকে বিয়ে করতে প্রথমে দোনোমনা করলেও ব্রজমোহনের প্রবল ব্যক্তিত্বের কাছে রমেশ পরাজিত হয়। ফেরার পথে ‘একটা ঘূর্ণা হাওয়া একটি সংকীর্ণ পথমাত্র আশ্রয় করিয়া প্রবলবেগে সমস্ত উন্মীলিত বিপর্যস্ত করিয়া দিয়া নৌকা কয়টাকে কোথায় কী করিল তাহার কোনো উদ্দেশ্য পাওয়া গেল না।’ মূলত এই ঘটনার জন্যই উপন্যাসের নাম দেয়া হয়েছে নৌকাডুবি।
রমেশ ও বধূ বেশে থাকা কমলার সংসার কোনো ধরনের নাটকীয়তা ছাড়াই শুরু হতে পারত। কিন্তু এখানেই যে লেখক রবীন্দ্রনাথের বিশেষত্ব! রমেশ যখন বুঝতে পারে কমলার সঙ্গে তার নয় বরং কোনো এক শ্রীমান নলিনাক্ষের বিবাহ হয়েছিল, তখনই অবস্থা জটিল আকার ধারণ করে। সমাজ সংস্কার কর্তব্য সব যেন একাকার হয়ে যায়।
ওদিকে হেমনলিনীর সঙ্গে রমেশের যে হৃদয়ের সম্পর্ক তাতে বিশ্বাস ও মর্যাদার কোনো অভাব ছিল না। তবুও কমলার কথা জানার পর স্বাভাবিকভাবেই হেমের পরিবার রমেশের সঙ্গে বিয়ে দিতে অসম্মতি জানায়। এদিকে হেমের জীবন জড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মসমাজের সুবক্তা নলিনাক্ষের সাথে। সেই নলিনাক্ষ, জলের তোড়ে যে ভেসে গিয়েছিল কমলার জীবন থেকে। শেষ পর্যন্ত সেই জলই কমলাকে নিয়ে আসে নলিনাক্ষের কাছাকাছি।
চরিত্রসমূহ
চরিত্রপ্রধান এই উপন্যাসে রমেশ, হেমনলিনী, কমলা ও নলিনাক্ষ- চারজনকেই ঔপন্যাসিক যত্ন করে নির্মাণ করেছেন। ‘পশ্চিমের চক্রবর্তী খুড়ো’ এই উপন্যাসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এছাড়াও আছে হেমের গুণমুগ্ধ অক্ষয়, মেয়ের প্রতি অনুভূতিশীল অন্নদাবাবু, কমলার স্নেহধন্য উমেশ, মমতার প্রতিমূর্তি ক্ষেমংকরী, যোগেন্দ্র ও শৈলজা।
রমেশ
রমেশের চরিত্রে দ্বিধার অংশই প্রধান। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করে যে সমস্যার সূত্রপাত সে করেছিল, সেখান থেকেই এগিয়েছে নৌকাডুবির কাহিনীচিত্র। কমলার জীবনের সত্যিটা জানার পরও কমলাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলার মতো দৃঢ়তা তার ছিল না। নিজের জীবনের এই অদ্ভুত অসহায়ত্ব নিজের সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে ভরসার জায়গা হেমের কাছেও সে খুলে বলতে পারেনি। ঘটনাপ্রবাহ তাকে যেভাবে টেনে নিয়ে গেছে, যেদিকে নিয়ে গেছে রমেশও সেই দিকেই গেছে। শেষ পর্যন্ত যখন কমলাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে চাইল, ততক্ষণে কমলা হারিয়ে গেছে নদীর স্রোতধারায়।
হেমনলিনী
বিংশ শতাব্দীর কলকাতা শহর আর সেই শহরের একটি শিক্ষিত রুচিশীল অবস্থাপন্ন ব্রাহ্মণ পরিবার এবং সেই পরিবারের সবার আদরের একমাত্র মেয়ে- এই হলো হেমনলিনী। একদিকে যেমন পরীক্ষায় পাস করতেও তার জুড়ি নেই, তেমনি আপনজনের জন্য রেশমের সেলাই শিখতেও তার আপত্তি নেই। গান বাজনায়, কবিতায়, সভা সমিতিতে আর বক্তৃতা শোনায়- সবখানে তার পদচারণা। আবার নলিনাক্ষের মায়ের সেবার ভারও সে গ্রহণ করেছিল অসাধারণ পটুতায়। শুধু রমেশের প্রণয়িনী কিংবা অন্নদাবাবুর আদরের হেম নয়, নিজের যোগ্যতায় সে এই উপন্যাসের এক আশ্চর্য সংবেদনশীল চরিত্র।
কমলা
কমলার মতো ভাগ্য বিড়ম্বিত চরিত্র এই উপন্যাসে তো নয়ই, রবি ঠাকুরের অন্যান্য উপন্যাসেও বিরল। পদ্মার উন্মুক্ত জনহীন দ্বীপে রমেশকে স্বামী হিসেবে ভেবে নিতে এক মুহূর্তও দেরি হয়নি তার। রমেশকে নিয়েই তার নিস্তরঙ্গ নিরুপদ্রব জীবন কেটে যেতে পারত। ভজকট করে দিল একটা চিঠি। তা-ও পুরোটা নয়। শুধু একটা নাম- ‘নলিনাক্ষ চট্টোপাধ্যায়’- এটুকু সম্বল করে সে রমেশের দেয়া মিথ্যে সংসার ফেলে বেরিয়ে পড়েছিল। তার সে নিরুদ্দেশ যাত্রা ব্যর্থ হয়নি। এদিক-ওদিক ঠোকর খেতে খেতে অবশেষে সে তার পরমার্থের দেখা পেয়েছিল বৈকি !
নলিনাক্ষ
রমেশের সাথে তুলনা করলে নলিনাক্ষের চরিত্রের ব্যাপ্তি ছোট, উপন্যাসের মাঝামাঝি এসে অক্ষয়ের মাধ্যমে আমরা নলিনাক্ষের সাথে পরিচিত হই। কাশী প্রবাসী বাঙালি এই ডাক্তারবাবু একদিকে যেমন বড় বড় সভায় আধ্যাত্মিক বক্তৃতা দিতে পারেন, তেমনি চায়ের টেবিলে সহাস্য উপস্থিতিতেও তাকে পাওয়া যায়। মায়ের প্রতি আশ্চর্য শ্রদ্ধাবোধ, নিজের পেশার প্রতি নিষ্ঠা, অদেখা অচেনা স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা- সব মিলিয়ে নলিনাক্ষ চট্টোপাধ্যায় চরিত্রটি সহজেই মনে দাগ কেটে যায়।
সেলুলয়েডে নৌকাডুবি
ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালনায় বাংলা সিনেমা নৌকাডুবি এই উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত। কাহিনীর মূলভাব ও প্রধান চরিত্রগুলোর নাম ঠিক রেখে নির্মিত এই ছবি রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। রমেশ চরিত্রে যীশু সেনগুপ্ত, নলিনাক্ষ চরিত্রে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, হেমনলিনী চরিত্রে রাইমা সেন এবং কমলা চরিত্রে অভিনয় করেছেন রিয়া সেন। প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন। যদিও আগে থেকে উপন্যাস পড়া থাকলে অনেক ক্ষেত্রেই আপনার কাছে সিনেমার কাহিনী অসম্পূর্ণ মনে হতে পারে।
চক্রবর্তী খুড়োর মতো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এই সিনেমায় অনুপস্থিত। কমলার স্নেহধন্য উমেশকেও দেখতে পাওয়া যায়নি। রমেশ-কমলার স্টিমার যাত্রা, গাজিপুরে রমেশ ও কমলার সংসার শুরু করার যে প্রয়াস উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে তার কোনোটাই সিনেমায় দেখানো হয়নি। কিন্তু আলাদাভাবে দেখতে গেলে সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যে অভিনেতা অভিনেত্রীরা নিজেদের মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। মাস্টারপিস তৈরি করার ক্ষেত্রে ঋতুপর্ণ ঘোষ বরাবরই একজন এক্সপার্ট, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
‘আমরা যাহা পাইয়াছি তাহা কখনোই হারাইতে পারি না, যাহা যথার্থ পাই নাই তাহাই হারাই।’
হয়তো এই একটি লাইনেই কবিগুরু পুরো উপন্যাসটিকে তুলে এনেছেন। রোমান্টিক ধারার এই উপন্যাস পড়ার সময় কখনো আপনার চোখে ভেসে উঠবে উন্মত্ত পদ্মা, পদ্মার ঢেউ, ঢেউয়ের তালে খেই হারানো ডিঙি নৌকা, আবার কখনো প্রাকৃতিক দৃশ্য হারিয়ে রমেশের হতবুদ্ধি চেহারা, কখনো হয়তো কমলার ভীত, সংক্ষিপ্ত চাহ্নি। একইসাথে গ্রামবাংলার চিরায়ত প্রকৃতি, বিংশ শতাব্দীর ক্রমবর্ধমান কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, আবার এর সাথে পশ্চিম ভারতে প্রবাসী বাঙালি জীবন- সবকিছুর এক আশ্চর্য মেলবন্ধন ‘নৌকাডুবি’।
অনলাইনে কিনুন- নৌকাডুবি