গত দশকের শুরুর দিকে উন্নয়নশীল কিংবা স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তেমন জনপ্রিয়তা ছিল না, কারণ হালের স্মার্টফোন তখনও সবার হাতে পৌঁছেনি। কিন্তু প্রযুক্তিগত অগ্রসরতার কারণে ফেসবুক কিংবা টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো উন্নত দেশগুলোতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ২০১২ সালের দিকে আমেরিকা ও ইউরোপের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসমূহে একটি ডকুমেন্টারি রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায়, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই কয়েক কোটিবার দেখা হয় সেই ডকুমেন্টারিটি। ‘কোনি ২০১২‘ নামের সেই আধা ঘন্টার ডকুমেন্টারিতে আফ্রিকার একটি দেশ উগান্ডায় লর্ডস রেজিস্টেন্স আর্মি বা এলআরএ নামের একটি মিলিশিয়া কীভাবে সেই দেশের শিশুদের পাচার করে ভয়ংকর যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলে, অল্পবয়সী মেয়েদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে ও যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হয়– সেসব বিষয় দেখানো হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই ডকুমেন্টারি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেও যে কয়েক হাজার মাইল দূরের কোনো দেশে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায়, শত শত মানুষ একত্রিত হয়ে নিপীড়িত মানুষদের সাথে সংহতি জানানো যায়– এই বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তো বটেই, বাস্তবেও আমেরিকাতে উগান্ডায় ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসী কার্যক্রমের প্রতিবাদে ক্যাম্পেইন শুরু হয়। বিল গেটস ও অপরাহ্ উইনফ্রের মতো ব্যক্তিত্বরা এই ক্যাম্পেইনের সাথে একাত্মতা পোষণ করেন। লর্ডস রেজিস্ট্যান্স আর্মি বা এলআরএ নামের সেই মিলিশিয়া সংগঠনটি থেকে পালিয়ে আসা শিশুদের সহযোগিতা করতে তহবিল গঠন করা শুরু হয় এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বড় বেশ বড় অংকের তহবিল সংগ্রহও করা হয়। আমেরিকা কিংবা ইউরোপের দেশগুলোতে অনেক মানুষ এই ডকুমেন্টারির মাধ্যমে প্রথমবারের মতো উগান্ডা নামের দেশটির আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারে।
ডকুমেন্টারিটি তৈরি করে ‘ইনভিসিবল চিলড্রেন’ নামের একটি বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা। আমেরিকার এই মানবাধিকার সংস্থাটি তিনজন শিক্ষার্থীর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ সুদানের দারফুর অঞ্চল নিয়ে তারা একটি চলচ্চিত্র তৈরি করতে চেয়েছিল, কিন্তু সেখানে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হলে তারা পিছিয়ে আসেন এবং শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ সুদানের প্রতিবেশী দেশ উগান্ডার সশস্ত্র সংঘাত ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এই ডকুমেন্টারিটি লর্ডস রেজিস্ট্যান্স আর্মির নেতা জোসেফ কোনির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তুলতে বেশ বড় ভূমিকা রাখবে। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #stopKony হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ জোসেফ কোনির বিরুদ্ধে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শক্তিধর দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
সরকারি বৈষম্যের প্রতিবাদে উত্তর উগান্ডায় লর্ড রেজিস্ট্যান্স আর্মির গোড়াপত্তন হয়। উত্তর উগান্ডায় আখোলি নামের একটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর উপর বহু বছর ধরে চলমান বৈষম্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই মিলিশিয়া সংগঠনটি গড়ে ওঠে। লর্ড রেজিস্ট্যান্স আর্মির বর্তমান নেতা জোসেফ কোনিও এই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীরই সদস্য। এই সশস্ত্র সংগঠনটি ধর্মীয় আদর্শকে সামনে রেখে পরিচালিত হয়।
প্রথমদিকে এই সংগঠনটি ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করলেও পরবর্তীতে নিরীহ জনগণের উপর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য এর জনসমর্থন কমে যায় এবং স্বয়ং আখোলি গোষ্ঠীর সদস্যরাই এর বিরোধিতা শুরু করে। ধর্ষণ, অপহরণ, পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা, লুট– প্রায় সব ধরনের ঘৃণিত অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে এই মিলিশিয়া সংগঠনের বিরুদ্ধে। বর্তমানে সংগঠনটি দুর্বল হয়ে পড়লেও একেবারে হারিয়ে যায়নি, বরং প্রায়ই ভয়াবহ সন্ত্রাসী আক্রমণের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়।
লর্ড রেজিস্ট্যান্স আর্মির বর্তমান নেতা জোসেফ কোনি সম্পর্কে জানা যাক। আফ্রিকায় তার ‘আধ্যাত্মিক নেতা’ হিসেবে পরিচিতি আছে। উগান্ডার নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে উৎখাত করে তিনি বাইবেলের নির্দেশনা অনুযায়ী আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। ধারণা করা হয়, তিনি এক জায়গায় বেশিদিন থাকেন না, কারণ এতে উগান্ডার সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বর্তমানে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে অবস্থান করছেন তিনি।
লর্ডস রেজিস্ট্যান্স আর্মির বর্তমান নেতা হিসেবে সংগঠনের সমস্ত অপরাধের পেছনে তাকে দায়ী করা হয়। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি তাকে নিন্দিত করেছে তা হলো হাজার হাজার নিরপরাধ শিশুকে অপহরণ করে তাদের মগজ ধোলাই করা এবং পরবর্তীতে সশস্ত্র যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলা। এমনভাবে শিশুদের মগজ ধোলাই করা হয় যে পরবর্তীতে এই শিশুরা অস্ত্র হাতে তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে বাবা-মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যা করে। এছাড়া যেসব অল্পবয়সী মেয়েদের ধরে আনা হয়, তাদের পরবর্তীতে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
কোনির বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন শুরু হওয়ার পর তাকে ধরতে, তার সন্ত্রাসী বাহিনী নির্মূল করার দাবি উঠেছিল বেশ জোরেশোরেই। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ও বারাক ওবামা– দুজনই কোনিকে ধরতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেন। উগান্ডা ও দক্ষিণ সুদানের সরকারকে অভিযান পরিচালনার জন্য মার্কিন প্রশাসন অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে সহায়তা করেছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আফ্রিকান দেশগুলোর সরকারকে সহায়তার জন্য প্রায় ৮০টি স্পেশাল অপারেশন ফোর্স পাঠান। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাকে ২০০৫ সালেই অভিযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ডকুমেন্টারি বানানোর আগেই থেকেই তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু তিনি যেহেতু একস্থানে বেশিদিন থাকেন না, তাই তাকে ধরা একেবারে সহজ নয়। এজন্য আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবস্থা নেয়ার পরও তাকে ধরা সম্ভব হয়নি।
তবে এই ডকুমেন্টারির বিরুদ্ধে অনেক আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক বড় ধরনের অভিযোগ এনেছেন। তাদের মতে, কোনি অবশ্যই একজন সন্ত্রাসবাদী নেতা ও তার সশস্ত্র সংগঠন আফ্রিকায় ভয়াবহ নির্মমতার সাথে বেসামরিক নাগরিকদের উপর অত্যাচার চালিয়েছে। কিন্তু ডকুমেন্টারিতে যেভাবে দেখানো হয়েছে, তা বাস্তবতাবিবর্জিত। কোনির উত্থান, জনপ্রিয়তা, ভয়াবহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা– সবকিছুর পেছনে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট তা বেমালুম চেপে যাওয়া হয়েছে। উগান্ডার ইতিহাস যেভাবে দেখানো হয়েছে, আদতে তা এত সহজ নয়। উগান্ডান সমাজে উগ্রবাদের উত্থানের পেছনে অনেক ‘ফ্যাক্টর’ আছে, যা ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয়নি, ইতিহাসের অতিসরলীকরণ করা হয়েছে।
অনেকে আবার অভিযোগ করেছেন, কোনির বিরুদ্ধে যেভাবে একতরফা অভিযোগ আনা হয়েছে তা অতিরঞ্জিত। কোনির সন্ত্রাসী বাহিনী অবশ্যই নির্মমতা চালিয়েছে, কিন্তু যেভাবে দেখানো হয়েছে, ঠিক ততটা নয়। ডকুমেন্টারিতে যেভাবে কোনিকে শক্তিশালী হিসেবে দেখানো হয়েছে, বাস্তবে লর্ডস রেজিস্ট্যান্স আর্মি বর্তমানে অর্ধমৃত একটি মিলিশিয়া সংগঠন। উগান্ডা থেকে বিতাড়িত হয়ে বর্তমানে তারা সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে অবস্থান করছে এবং ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে যেসব অভিযান তারা পরিচালনা করে, তা মূলত বেসামরিক নাগরিকদের উপর সহিংসতার জন্য নয়, বরং সংগঠন টিকিয়ে রাখার জন্য যে অর্থ দরকার, তার জন্য। তাই কোনির দিকে আলোকপাত না করে অ্যাক্টিভিস্টদের সিরিয়া বা ইয়েমেনের মতো দেশগুলো উপর নজর দেয়া উচিত, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু অপুষ্টির শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে– এমনও মনে করেন অনেকে।
‘কোনি ২০১২’ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও পাশ্চাত্যে আফ্রিকার দেশগুলোতে যে সমস্যা, তা নিয়ে কিছুটা হলেও আলোচনার দ্বার খুলে দিয়েছিল এই ডকুমেন্টারি। যে উদ্দেশ্যে এটি বানানো হয়েছিল, তা পুরোপুরি সফল হয়। ক্যাম্পেইন পরিচালনার মাধ্যমে লাখ লাখ ডলার সংগ্রহ করা হয়, যেগুলো পরবর্তীতে লর্ডস রেজিস্ট্যান্স আর্মির হাত থেকে পালিয়ে আসা শিশুদের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, সেটা পৃথিবীবাসীকে খুব ভালো করেই দেখায় এই ডকুমেন্টারি।