মিশন ইম্পসিবল! হলিউডের সিনেমার সাথে পরিচিত যে কারো কাছে এই শব্দ দুটো অপরিচিত থাকার প্রশ্নই উঠে না। হলিউডের সূচনালগ্ন থেকে আজ অবধি যতগুলো ফিল্ম সিরিজ নির্মাণ হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ‘মিশন ইম্পসিবল’ নামটি ইতিহাসের পাতায় মোটা হরফে ছাপিয়ে যে রাখা হবে সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এক বছর, দুই বছর অথবা এক যুগ নয়, ‘মিশন ইম্পসিবল’ নামের এই ফিল্ম সিরিজের পথচলা শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২২ বছর পূর্বে। সেই যে শুরু! তারপর একের পর এক দুর্দান্ত সব অ্যাকশন ফিল্মের উপহার দেওয়ার মাধ্যমে সিরিজটির যাত্রাপথ ধীরে ধীরে পুরো বিশ্বের লাখো কোটি সিনেমাপ্রেমীর অন্তরের অন্তঃস্থলে আলাদা এক স্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। আজকের এই যুগে অ্যাকশনপ্রেমী কোনো সিনেমাবোদ্ধাকে শুধু “মিশন ইম্পসিবল সিরিজটা কেমন লেগেছে?” জিজ্ঞেস করেই দেখুন না। তার উত্তরের অপেক্ষা করতে হবে না, বরং চোখমুখে ফুটে ওঠা ভাব দেখেই আপনার প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন।
আর এই বছরের ২৭ জুলাই এই সিরিজের ষষ্ঠ সিনেমা ‘মিশন: ইম্পসিবল – ফল আউট’ আন্তর্জাতিক পরিসরে মুক্তি পেয়েছে। আগের পাঁচটি সিনেমা থেকে এই সিনেমাকে ঘিরে আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা মুক্তির বহু আগ থেকেই অনেক বেশি ছিল। একে তো এই বছরটাই যেন পুরো দুনিয়া জুড়ে মার্ভেল স্টুডিওর সিনেমাগুলোর জয়জয়কার ধ্বনি উচ্চারিত করার জন্য আগমন ঘটিয়েছে। আর এমন এক সময়ে মার্ভেলের সিনেমাকে ছাপিয়ে সেখানে কিছু সময়ের জন্য হলেও নিজেকে স্পটলাইটে তুলে ধরার মতো সিনেমা হিসেবে ‘মিশন: ইম্পসিবল – ফল আউট’ এর জুড়ি মেলা ভার। এ বছর অ্যাকশন জনরার সিনেমা তো আরও বেশ কয়েকটাই মুক্তি পেল, যেগুলো আশানুরূপ সাফল্য অর্জনে ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়। সেক্ষেত্রে এই সিনেমা যে সত্যিই প্রশংসা ও করতালির যোগ্য, সেই ব্যাপারে বেশ জোরালো কণ্ঠেই বলা যেতে পারে।
‘মিশন ইম্পসিবল- ফল আউট’ এর প্লট নিয়ে কথা শুরু করার আগে কয়েকটা কথা বলে নেওয়া উত্তম। এ সিরিজের সাথে যারা আগে থেকেই পরিচিত, মানে, যারা সিরিজের বাকি সিনেমাগুলো আগেই দেখেছেন, তাদের জন্য সিরিজের এই সিনেমাটি একটা বড়সড় চমক হিসেবেই থাকবে। কারণ আগের সিনেমাগুলো থেকে এটার প্লট, ঘটনাপ্রবাহ, অ্যাকশন সিকুয়েন্স, সংলাপ, টুইস্ট সবকিছুই বেশ এগিয়ে আছে। তবে যারা আগের সিনেমাগুলো দেখেননি, তাদের জন্য অনেক কিছু বেশ ঘোলাটে, কাহিনীর ধারাবাহিতা ও পূর্বের সিনেমার গল্পের সাথে এ সিনেমার যোগসূত্র ধরতে ভালোই বেগ পেতে হবে। আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, তারা হয়তো এই সিনেমার যে কাহিনীকে ঘিরে প্রবাহিত হয়েছে সেটা ও অ্যাকশন সিনগুলো উপভোগ করবেন, কিন্তু ‘মিশন ইম্পসিবল’ এর আসল স্বাদ তাদের কাছে অবান্তরই থেকে যাবে। তাই আগে বাকি সিনেমাগুলো দেখার অনুরোধ থাকবে।
এবার তাহলে প্লটের দিকে মনোযোগ দেওয়া যাক। ইম্পসিবল মিশন ফোর্সের দুর্ধর্ষ এজেন্ট ইথান হান্ট বেলফাস্টে গা ঢাকা দিয়ে শীতনিদ্রায় দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু তার অবসরে ব্যাঘাত ঘটলো যখন তার কানে বড়সড় একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের নতুন মিশনের খবর এসে পৌঁছালো। সলোমন লেন নামের একটি ক্ষমতাশালী অপরাধী চক্রের প্রাক্তন প্রধানকে দুই বছর আগে ইথান নিজের হাতে গ্রেফতার করে আইনের হাতে তুলে দেওয়ার পরই তার রেখে যাওয়া অবিচ্ছিন্ন দল নতুন করে ‘অ্যাপস্টলেস’ নামের এই সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তুলে। আর ইথান হান্ট জানতে পারে, ‘অ্যাপস্টলেস’ দলটি তাদের নতুন মক্কেল জন লার্কের জন্য তিনটি ‘প্লুটোনিয়াম কোর’ কিনে আনতে যাচ্ছে। ‘প্লুটোনিয়াম কোর’ এর মতো ভয়াবহ পারমাণবিক অস্ত্র কেনার পেছনের উদ্দেশ্য কখনোই ভালো কিছু হতে পারে না, এটা তো ইথানের মতো পারদর্শী এজেন্ট কেন, যেকোনো সাধারণ মানুষও বুঝবে। আর তাই তো, ইথানের মগজে বিপদসংকেত বেজে উঠার সাথে সাথে সেই লেনদেন যেখানে সংঘটিত হবার খবর পেয়েছে সেখানে তার দুই সহকর্মী ও বন্ধু বেঞ্জি ও লুথারকে নিয়ে উপস্থিত হয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ইথান সেই লেনদেন থামাতে ও কোরগুলো ছিনিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। যার ফলে, ‘অ্যাপস্টলেস’ এর হাতে সেই শক্তিশালী পারমাণবিক অস্ত্র ‘ছেলের হাতের মোয়া’র মতো ধরা দেয়। কিন্তু ইথান তো দমে যাবার পাত্র নয়। তাই সে একের পর এক মাস্টারপ্ল্যানের সাথে প্লুটোনিয়াম কোরগুলো ও অ্যাপস্টলেস এর পেছনে অবিরাম ছুটে চলতে শুরু করলো। আর এই যাত্রাপথে, ইথানকে যেমন অগণিত বাধাবিপত্তি পার করতে হয়েছিল, ঠিক তেমনি মিত্র ও শত্রুর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে ও বিপক্ষ দলের মানুষগুলোর চালগুলো ধরতে হিমশিম খেতে হয়েছিল। কিন্তু ইথান হান্টকে দমানো কি আর এত সহজ? ইথানের এই ধুরন্ধর অভিযানের বাকি গল্প না হয় আপনাকে প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে জেনে নেবার সুযোগ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যাক।
উপরের অনুচ্ছেদে ইথান হান্টকে নিয়ে এত কথা বলা হলো। এবার তার সাথে একবার আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় না করিয়ে দিলে কি আর হয়, বলুন? ‘মিশন ইম্পসিবল’ ফিল্ম সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্রটির নামই হচ্ছে ইথান হান্ট। এই সিরিজের প্রতিটা মুভিতেই ইথান হান্ট ও ‘ইম্পসিবল মিশন ফোর্স’ এর বাকি এজেন্টরা মিলে একেকটি বিশাল ও আক্রমণাত্মক মিশনে অংশ নিয়ে থাকে। আর প্রতিটি মিশনেই ইথান ‘লিডার’ হিসেবে তার দলকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে থাকে। আর গত ২২ বছর ধরেই ইথান হান্টের চরিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছেন হলিউডের অন্যতম আলোচিত অভিনেতা টম ক্রুজ। জানা নেই, টম ক্রুজ এতটা দুর্দান্ত অ্যাকশন হিরো বলেই কি ইথান হান্ট চরিত্রটি সবার চোখে এতটা প্রিয় নাকি ইথান হান্ট চরিত্রটিই এমনভাবে রচিত হয়েছে যা ক্রুজকে এনে দিয়েছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ও অনন্য লেভেলের এক জনপ্রিয়তা। সে যা-ই হোক না কেন, দিন শেষে, ইথান হান্টের রূপে ক্রুজকে আরও একবার পর্দায় দেখতে আজ দুই যুগের কাছাকাছি সময় ধরে লোকজন অধীর আগ্রহে পরবর্তী সিনেমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ইথান হান্টের চরিত্রে অন্য কোনো নায়ককে কল্পনা করাও যেন তার ভক্তদের কাছে অকল্পনীয় ব্যাপার।
১৯৯৬ সালে ‘মিশন ইম্পসিবল’ নামের এই ফিল্ম সিরিজের প্রথম মুভিতে ইথান হান্ট ও তার দল ‘ম্যাক্স’ নামের একজন আন্তর্জাতিক অপরাধীর পেছনে তাড়া করেছিল। সেই থেকে মূলত ইথানের দর্শক মনে জায়গা করে নেওয়ার শুরু। এরপর চার বছর বিরতির পর যখন সিরিজের দ্বিতীয় মুভি ‘মিশন ইম্পসিবল টু’ রিলিজ হয়, সেখানে ইথান এমন এক এজেন্টের পিছু নেয় যার কাছে একটি প্রাণঘাতী ভাইরাস রয়েছে। সেই সিনেমা সিরিজের মান ধরতে রাখতে পারায় এর প্রায় ছয় বছর ‘মিশন ইম্পসিবল থ্রি’ মুক্তি পেয়েছিল। তবে এই সিরিজের চতুর্থ মুভি ‘মিশন ইম্পসিবল- গোস্ট প্রোটকল’ সত্যিকার অর্থে সিরিজটির দর্শকপ্রিয়তাকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে যায়। ২০১১ সাল থেকে মিশন ইম্পসিবল সিরিজের নতুন আরেকটি মুভি পাবার জন্য সিনেমাপ্রেমীরা ব্যাকুল হতে শুরু করলো। আর তাই তো, ২০১৫ সালে পঞ্চম মুভিটি বের হবার পর থেকে পরবর্তী মুভির শুটিং কবে থেকে, শুটিং এর স্টিল পিক, মুভির অফিসিয়াল পোস্টার, টিজার ও ট্রেলার নিয়ে দর্শকদের আগ্রহের পরিমাণ আকাশছোঁয়া ছিল। এর কতটা মুভিটি মেটাতে পেরেছে এবার সেই বিষয়ে চলে যাই তাহলে।
‘মিশন ইম্পসিবল- ফল আউট’ মুভিটি কেমন? এ ব্যাপারে বলতে গেলে আগেরগুলোর সাথে এটার অল্পবিস্তর তুলনা করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে গভীরভাবে বিশ্লেষণ না করেই যদি এক কথায় বলতে যাই, তাহলে বলবো, আগের মুভিগুলো থেকে এটা সব দিক থেকেই বেশ এগিয়ে। আর কেনই বা হবে না, বলুন? প্রথমবারের মতো এই সিরিজের একাধিক মুভি পরিচালনার দায়িত্ব একজন পরিচালকের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিশ্চয়ই তার পরিচালিত আগের মুভিটি বেশ বড় রকমের সাড়া ফেলার ফলেই তাকে দ্বিতীয়বারের মতো এই গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তাই না? আর স্বাভাবিকভাবে, বুদ্ধিদীপ্ত ও সুকৌশলী ব্যক্তিদের মনে প্রতিনিয়ত আগের কাজ থেকে পরের কাজে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাবার বাসনা কাজ করে। শুধু বাসনা বললে ভুল হবে, নির্মাতা ক্রিস্টোফার ম্যাককুয়ারি যেন ব্যাপারটাকে নিজের সাথে নিজের চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। তাই তো, নিজেকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে গিয়ে তিনি নির্মাণ করে বসেন এই সিরিজের এযাবতকালের সবথেকে অসাধারণ সিনেমাটি।
কী নেই এই সিনেমাতে? সিনেমার প্লট যেমন জটিলতায় ঘেরা, ঘটনাপ্রবাহের প্রতিটি মোড় তেমনি নতুন নতুন চমকে ঢাকা। এছাড়া সিনেমার প্রায় প্রতি পাঁচ মিনিটেই যেন দারুণ দারুণ সব অ্যাকশন সিকুয়েন্স রয়েছে। সিনেমাটি শুধু হাড্ডাহাড্ডি মারপিটের জন্যই নয়, মজাদার সব সংলাপের জন্যও বেশ বিনোদনধর্মী বলে বিবেচনা করা যায়। মিশন ইম্পসিবলের বাকি সিনেমাগুলোর মতো এটার শেষের দিকেও রোমহর্ষক লড়াইয়ের দৃশ্য ছিল। টুইস্টের কথা আর না-ই বলি।
সিনেমার অভিনয়শিল্পীদের কথা বলতে গেলে টম ক্রুজকে দিয়েই শুরু করতে হয়। শুনেছিলাম, তিনি শুটিং চলাকালীন একটি দৃশ্যে ক্যামেরাবন্দি হতে গিয়ে বেশ ভালো রকমের আঘাত পেয়েছিলেন। সেই দৃশ্যটিতে তাকে এক বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে যেতে দেখা যাবে, এমন ছিল। সিনেমাতে যখন সেই দৃশ্যটি আসবে, আপনি ‘হাঁ’ করে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হবেন। একজন মানুষ ৫৬ বছর বয়সেও এত ফিট ও টগবগে রূপে নিজেকে কীভাবে উপস্থাপন করে সেটাই ভেবে অবাক হতে হয়। পুরো সিনেমাতে তার দিক থেকেই চোখ ফেরানো দায় ছিল, বাকিদের আর কী দেখবো। সুপারম্যান খ্যাত হ্যানরি কেভিলকে এই মুভিতে বেশ হাস্যরসিকতায় পূর্ণ চরিত্র হিসেবেই দেখা যাবে। ভিলেন রূপে তাকে আহামরি না লাগলেও, খারাপ লাগেনি। এছাড়া সিনেমার উল্লেখযোগ্য কোনো চরিত্রের কথা বলতে গেলে অভিনেত্রী রেবেকা ফার্গুসনের কথা বলতে হয়। নারী এজেন্ট রূপে তার উপস্থিতি ছিল দুরন্তপনা ও সাহসিকতায় ভরপুর। আর মুভিতে ‘ওয়াইট উইডো’ নামধারী অভিনেত্রী ভেনেসা কিরবি ক্ষণকালের জন্য চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য নিয়ে পর্দার সামনে এসেছিলেন। বাদ বাকি সব চরিত্র নিজ নিজ দৃশ্যে দারুণ অভিনয়ই করেছে।
পুরো সিনেমাতে মোট ২৬টি সাউন্ডট্র্যাক রয়েছে যার প্রতিটিই পুরো সিনেমা জুড়ে এক রোমাঞ্চকর আবহ ধরে রাখতে সহায়তা করেছে। অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফির জন্য রব হার্ডির একটা আন্তরিক ধন্যবাদ পাওনা থেকে যায়। সিনেমার চিত্রধারণ হয়েছিল প্যারিস, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড ও নরওয়েতে। প্রায় ১৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে নির্মিত এই সিনেমাটি প্রথম সপ্তাহে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে সক্ষম হয়েছে। রটেন টমেটোসে ২৮২ রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৯৭% ও মেটাক্রিটিকে ৫৯টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৮৬% রেটিং প্রাপ্ত হয়েছে সিনেমাটি।
ফিচার ইমেজ- Wallpapers “4k”