“কারো কেউ নইকো আমি
কেউ আমার নয়,
কোনো নাম নেইকো আমার
শোনো মহাশয়!”
প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি গায়ক কিশোর কুমারের কণ্ঠে গাওয়া এই গানটি বাংলা সঙ্গীতের জগতের একটি ক্লাসিকে পরিণত হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। সেইসঙ্গে যে চলচ্চিত্রে এই গানটি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটিকেও ১৯৭০–এর দশকের ভারতীয় চলচ্চিত্রের একটি ক্লাসিক হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। চলচ্চিত্রটির নাম ‘লাল কুঠি’।
যারা এখন বলিউড বা হলিউডের দ্রুতগতির অ্যাকশন মুভি দেখে অভ্যস্ত, তাদের কাছে হয়তো সত্তরের দশকের এই চলচ্চিত্রটির তেমন চিত্তাকর্ষক বলে প্রতীয়মান হবে না। কিন্তু ১৯৭০–এর দশকে যখন ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ নিম্নমানের অ্যাকশন মুভি আর অতিনাটকীয় ঘরোয়া বা প্রেমমূলক চলচ্চিত্রে ছেয়ে গিয়েছিল, সে সময় লাল কুঠি ছিল নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ, এটিতে অ্যাকশন মুভির মালমশলা ছিল খুবই কম, এটি ছিল থ্রিলার ঘরানার একটি চলচ্চিত্র।
এর কাহিনী ‘লাল কুঠি’ নামের একটি বাংলোকে ঘিরে। রহস্যজনকভাবে লাল কুঠি এবং নিকটবর্তী চা বাগানের মালিক মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তার মেয়ে রুনু উত্তরাধিকারসূত্রে লাল কুঠি এবং চা বাগানের মালিকানা লাভ করে। কিন্তু এরপর ঐ লাল কুঠিতেই এক রাতে রুনুর সামনে তার প্রেমিক দীপককে খুন করা হয়। রুনু খুনিদের একজনকে দেখতে পায়, কিন্তু সেই খুনেরও কোনো সুরাহা হয়নি। কাছের দু’জন মানুষের অকস্মাৎ মৃত্যুতে রুনু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তার আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।
এমতাবস্থায় রুনুর কাকাবাবু সেন সাহেব লাল কুঠি এবং চা বাগানের দেখাশোনার জন্য অজয় নামক একজনকে ব্যবস্থাপক হিসেবে নিযুক্ত করেন। অজয় লাল কুঠিতে বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিকতার সম্মুখীন হয়, কিন্তু কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। রুনুর সঙ্গে তার একধরনের সখ্যতা গড়ে উঠে, যেটি ক্রমে প্রণয় থেকে পরিণয়ে রূপ নেয়।
কয়েক বছর পর অজয় আর রুনু একটি অনুষ্ঠানে গেলে আকস্মিকভাবে রুনু তার মৃত প্রেমিক দীপকের খুনিকে সেখানে দেখতে পায়। আতঙ্কিত রুনু সেখান থেকে লাল কুঠিতে ফেরার পথে তার গাড়ির আঘাতে সেই লোক নিহত হয় এবং খাদে গড়িয়ে পড়ে। রুনু এই দুর্ঘটনার ব্যাপারটা পুলিশকে জানাতে চায়, কিন্তু তারা খুনের মামলায় ফেঁসে যেতে পারে এ আশঙ্কায় অজয় তাকে নিবৃত্ত করে। পরবর্তী দিন সোনাম নামের এক বিচিত্র ব্যক্তি রুনুকে এই দুর্ঘটনার ব্যাপারটা নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে এবং লাল কুঠিতে এসে অবস্থান করতে শুরু করে। রুনু আর অজয় বাধ্য হয়ে তাকে সহ্য করতে থাকে।
এদিকে বোর্ডিং স্কুল ছুটি হওয়ায় রুনু আর অজয়ের ছোট্ট ছেলে সমীর ফেরত আসে। রুনু মোটেই তার ছেলেকে সোনামের মতো অপরাধীর সাথে মিশতে দিতে রাজি নয়, কিন্তু বাচ্চা সমীরের সঙ্গে সোনামের সখ্যতা গড়ে ওঠে। সমীরের নিষ্পাপ, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ সিকিমের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে সমতলে এসে অপরাধীতে পরিণত হওয়া সোনামের মনে তার জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন দেখা দেয়। এভাবেই এগিয়ে চলে চলচ্চিত্রটির কাহিনী।
চলচ্চিত্রটি মূলত থ্রিলার ঘরানার। খুন, ষড়যন্ত্র, আতঙ্ক আর রহস্য নিয়ে চলচ্চিত্রটির কাহিনী গড়ে উঠেছে। সাধারণ ভারতীয় চলচ্চিত্রের মতো প্রেম-ভালোবাসা এই চলচ্চিত্রে প্রাধান্য পায়নি। কিন্তু এর পাশাপাশি সমীরের সঙ্গে সোনামের স্নেহের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটিতে একটি মানবিক দিক সংযুক্ত করা হয়েছে।
সোনামের জীবনকাহিনী এই চলচ্চিত্রটিতে জোড়া খুনের রহস্যের চেয়েও বেশি চমকপ্রদ। সিকিমের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে কাজের খোঁজে সোনাম নেমে এসেছিল ‘সুসভ্য’ সমতলভূমিতে। সেখানে দারিদ্র্যের তাড়নায় সে হারিয়ে গিয়েছিল অপরাধের চোরাগলিতে। কিন্তু মন থেকে সে অপরাধী হয়ে উঠতে পারেনি, এজন্য তার নিষ্পাপ পূর্বজীবনের সঙ্গে বর্তমান অপরাধ জীবনের সংঘাত চলে সবসময়। অপরাধের সঙ্গে জড়িত হওয়ার পরও তার স্বাতন্ত্র্যবোধ সে হারিয়ে ফেলেনি। সে যে কারো হাতের পুতুল নয়, সেটি বোঝাতেই যেন সে বলে ওঠে,
“আমি কারো হুকুমের গোলাম নই, আমি তুরুপের তাস।”
সমীর যখন সোনামকে তার বাড়ি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তখন সোনাম জবাব দেয়,
“বাড়ি?
তোমার বাড়ি আমার বাড়ি
আমার বাড়ি নেই,
পথে ঠেলে দিলে আমায়
পথেই পড়ে রই।
যে যখন দেখে আমায়
কিনে নিতে চায়,
মনের মতোন দামটি দিলে
তখন পাওয়া যায়।”
শিশু সমীর নিজের অজান্তেই সোনামকে তার মনের মতো দামটি দিতে পেরেছিল। সেটি হলো শিশুমনের নিষ্পাপ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। আর সেটিই শেষপর্যন্ত সোনামের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
থ্রিলার ঘরানার এই চলচ্চিত্রটি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দর্শককে এক ধরনের উৎকণ্ঠা বা কৌতূহলে আচ্ছন্ন করে রাখে। লাল কুঠির প্রকৃত রহস্য কী? কেন লাল কুঠির সঙ্গে এত মানুষের মৃত্যু জড়িত? কেন সোনাম রুনু আর অজয়ের কাছে টাকা দাবি না করে লাল কুঠিতে থেকে যাওয়ার অদ্ভুত শর্ত দিয়েছিল? সোনামই কি ছিল প্রকৃত খুনি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর চলচ্চিত্রটির শেষপ্রান্তে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত পাওয়া যায় না।
সোনামের জীবনকাহিনী সমতলভূমিতে পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জীবনের কঠোর বাস্তবতার প্রতীক। দরিদ্র পাহাড়ি অঞ্চলগুলো থেকে জীবিকার খোঁজে যারা ‘সুসভ্য’ সমতলভূমিতে নেমে আসে, তাদের কঠিন জীবনকে ফুটিয়ে তোলাই কি চলচ্চিত্রটির উদ্দেশ্য ছিল? থ্রিলার বা রহস্যের আবরণে মোড়ানো ‘লাল কুঠি’ চলচ্চিত্রটিতে কি প্রচ্ছন্নভাবে একটি সামাজিক বার্তা দেয়া হয়েছিল?
এর জবাব হয়তো চলচ্চিত্রটির পরিচালক কনক মুখোপাধ্যায় দিতে পারতেন, যিনি কেবল চলচ্চিত্র পরিচালকই ছিলেন না, একই সঙ্গে ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নারী আন্দোলনের একজন অগ্রদূত এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্যা। কিংবা চলচ্চিত্রটির কাহিনীলেখক মহেন্দ্র বাটরাও হয়তোবা এই প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর জানতেন।
১৯৭৮ সালের ৩ মার্চ ‘লাল কুঠি’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি লাভ করেছিল। চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ে অবস্থিত কুচবিহারের প্রাক্তন মহারাজাদের একটি দোতলা বাড়িতে, যেটি এ চলচ্চিত্রের নামানুসারে ‘লাল কুঠি’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। চলচ্চিত্রটি একই সঙ্গে বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষায় মুক্তি পেয়েছিল। হিন্দিতে চলচ্চিত্রটির নাম ছিল ‘লাল কোঠি’।
বেশ কয়েকজন বিখ্যাত অভিনেতা এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অজয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক। রুনুর চরিত্রে ছিলেন মারাঠি অভিনেত্রী তনুজা সমর্থ। ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত ‘খলনায়ক’ উৎপল দত্ত (যিনি ফেলুদা সিরিজের ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ চলচ্চিত্রে ‘মগনলাল মেঘরাজ’ চরিত্রে এবং ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রে হীরক রাজার চরিত্রে অভিনয় করে অমর হয়ে আছেন) ছিলেন এই চলচ্চিত্রের মূল খলনায়ক সেন সাহেবের চরিত্রে। সোনামের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন সিকিমের অভিনেতা (এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রের আরেক খ্যাতিমান ‘খলনায়ক’) ড্যানি দেনজোংপা। আর শিশু সমীরের চরিত্রের অভিনেতার নাম পার্থ মুখোপাধ্যায়।
‘লাল কুঠি’ চলচ্চিত্রটি ৪০ বছরেরও বেশি সময় আগে নির্মিত হয়েছিল। এরপরে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে নানাবিধ গুণগত পরিবর্তন এসেছে। নতুন ধরনের চলচ্চিত্রের সঙ্গে দর্শকরা একাত্ম হয়ে গেছেন। কিন্তু যারা পুরাতন মুভিতে থ্রিলার, সাসপেন্স আর ট্র্যাজেডি একসঙ্গে অনুভব করতে চান, তাদের কাছে ‘লাল কুঠি’ চলচ্চিত্রটি অসাধারণ হিসেবে প্রতীয়মান হবে।