বাংলাদেশের স্বপ্নচোখ: আশা, আকাঙ্ক্ষা, আর ভালোবাসায় মোড়ানো মলাটবন্দি বাস্তবতা

যুগে যুগে তরুণরাই বিশ্বজয়ে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। বিশ্বকে জয় করে ছুটে চলেছে মহাবিশ্ব জয়ের নেশায়। আজকের তরুণরাই আগামী প্রজন্মের নির্মাতা। একটি জাতির সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদও বটে। পৃথিবীর যেকোনো উন্নত দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যায় সেদেশে তরুণদের ভূমিকা কতটা গভীর। এই তরুণদের নির্মাণ করতে সেসব জাতি তাদের দিয়েছে বিশ্বমানের শিক্ষা, শিক্ষক আর প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো। একসময় সেই তরুণেরা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পুরো পৃথিবীর উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হয়েছে, হচ্ছে, এবং ভবিষ্যতেও হবে।

‘বাংলাদেশের স্বপ্নচোখ’ বইয়ে লেখক রউফুল আলম শুনিয়েছেন বাংলাদেশ নিয়ে তার ভাবনা। দূর পরবাসে থেকেও বাংলাদেশকে লালন করে চলেছেন হৃদয়ের গভীরে। ৫২টি অণুপ্রবন্ধ দিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি। যার বেশিরভাগই বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এই অণুপ্রবন্ধগুলোতে তুলে ধরা হয়েছে প্রিয় মাতৃভূমির সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, এবং আনুষঙ্গিক বেশ কিছু সমস্যা। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের কিছু পথও তিনি দেখিয়েছেন। যেকোনো চিন্তাশীল পাঠক নিঃসন্দেহে বইটি পড়তে গিয়ে কখনো আনন্দে উদ্ভাসিত হবেন, কখনো বা চিন্তার জগতে হারিয়ে যাবেন, মাঝে মাঝে হয়তো অজানা কোনো আশঙ্কায় শিহরিতও হবেন।

লেখকের প্রকাশিত দ্বিতীয় বই,Image Credit_ MD. TAUFIK ISLAM
লেখকের প্রকাশিত দ্বিতীয় বই, Image Credit_ MD. TAUFIK ISLAM

সূচীপত্রের প্রথমেই স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ‘প্রিয় বঙ্গবন্ধু’। না, এটা তথাকথিত কোনো চর্বিত চর্বণ নয়! নয় তোষামুদে কোনো লেজুরবৃত্তিও। অসংখ্য মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে মিথ্যে প্রমাণ করার সাহস দেখিয়েছিলেন যে বীর, লাখো মানুষের মনো-নদীকে এক মোহনায় এনে শপথ করিয়েছিলেন যিনি, সেই পিতা আজ ভালো নেই। বঙ্গবন্ধুর নাম বলে বলে যারা আজ রাষ্ট্রকে লুট করে, আদর্শের নাম ভাঙিয়ে নৈরাজ্য করে বেড়ায় যারা, তাদের ভয়ে আজ কোণঠাসা সোনার বাংলা। তাই তো লেখক ব্যথিত হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে অনুযোগের সুরে জানতে চেয়েছেন,

আপনি কি চেয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঝিমিয়ে পড়ুক অনিয়ম আর দলীয়করণে? আপনি কি চেয়েছিলেন, মানুষগুলো কাজ না করে শুধু লেজুড়বৃত্তি করে বেঁচে থাকুক? আপনি কি চেয়েছিলেন, মানুষের বলার অধিকার বিলীন হয়ে যাক? স্বাধীনতা কি এজন্যই এনেছিলেন? এজন্যই কি পুরো বাংলাদেশ একটা শহীদ মিনার হয়ে উঠেছিল?

প্রতিটি জীবের দেখার জন্য যেমন চোখের প্রয়োজন, তেমনি একটি সমাজের, একটি দেশকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যেও দৃষ্টিশক্তির প্রয়োজন। সমাজের জ্ঞানী মানুষেরাই সংস্কারের পথ দেখায়, জরাজীর্ণতা দূর করে মানুষকে ভাবাতে শেখায়। আমাদের সমাজে শিক্ষিত মানুষ দেখা গেলেও জ্ঞানী মানুষের বড়ই অভাব। ‘চোখের আলোয় দেখেছিলাম’ অণুপ্রবন্ধে লেখক জানাতে চেয়েছেন,

জ্ঞান হলো সেটাই, যেটা মানুষকে নতুন আলো দেখায়। প্রশ্ন করতে শেখায়। মগজের নিউরনে নিউরনে তীব্র আঘাত করে। যেটা মানুষকে আলোক দিশারী করে তোলে। জ্ঞান সেটাই, যেটা মানুষের অধিকারের জন্য লড়তে লড়তে জাগ্রত করে। সমাজকে জাগাতে নির্ভীক, সত্য করে তোলে। এমন জ্ঞনের চাষ যে সমাজে হয় না, সেখানে সনদধারীতে কিলবিল করে। আলোকের সন্ধান মেলে না সহজে। মুক্তি হয় বিলম্বিত! বই মানুষকে সত্যিকারের জ্ঞানী করে। বই মানুষের ভেতর সত্যিকারের জ্ঞানের আলো ঢুকাতে সাহায্য করে।

ইউপ‍্যানের(UPenn) ল‍্যাবে কাজ করার সময় (২০১৭)_Image Credit_লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল
UPenn-এর ল‍্যাবে কাজ করার সময় (২০১৭); Image Credit: Rauful Alam

আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত ধর্ষণের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। শুধু দেশে নয়, পুরো পৃথিবীতেই ধর্ষণ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। ইউরোপ-আমেরিকাতেও এর ভয়াবহতা নিছক কম নয়। তবে আমাদের দেশে যখন একটি মেয়ে ধর্ষিত হয়, তখন আমরা প্রথমে মেয়েটিকে যাচাই করতে শুরু করি। মেয়েটি কেমন পোশাক পড়ত, কাদের সাথে ঘুরত, হিজাব পরত নাকি চুল উড়িয়ে বেড়াত, বয়ফ্রেন্ড আছে নাকি, কোন ধর্মের সে, তার ফেসবুক পরিচিতি কেমন ইত্যাদি। ধর্ষকের কাছে তো ধর্ম-রাষ্ট্র-জাত পরিচয় নেই। যখন আমি-আপনি ধর্ষণের শিকার সেই মেয়ের পরিচয় নিয়ে মেতে উঠি, তখন ধর্ষকরা ধৃষ্টতা নিয়ে উল্লাস করে বেড়ায়। পৃথিবীর আর কোনো দেশে ধর্ষণের পর একটি মেয়েকে নিয়ে এমন ঘৃণ্যতম কাটাছেড়া করা হয় না। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও ধর্ষণের শিকার একটি মেয়ে এই দেশে সঠিক বিচার পায় না— কবে পাবে সেই প্রশ্ন লেখক রেখে গেছেন।

একটি অণুপ্রবন্ধের শিরোনাম ‘বাবার পরিচয়’। এ লেখাটি পাঠককে ভাবাতে বাধ্য করবে। ‘তোমার বাবা কী করে?’ প্রশ্নটি আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অফিস-আদালত পর্যন্ত কাজ করে এমন অনেককেই শুনতে হয়। কখনো কখনো প্রশ্নটি করাই অনেক বিব্রতকর। একেকজন ব্যক্তি একেক রকম পারিবারিক অবস্থা থেকে উঠে আসে। যদিও সব পেশার পিতার প্রতিই প্রতিটি সন্তান গর্ববোধ করে। তবুও এ রকম কোনো প্রশ্ন করে কাউকে বিচার করা কিংবা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলানো কারোই কাম্য নয়। পৃথিবীর মহান মানুষগুলো তাদের বাবার পরিচয়ে বড় হয়নি, নিজ কর্মগুণে তারা বিশ্বজয় করেছে। অনুকরণে বলা যায়,

মানুষের সবচেয়ে সুন্দর পরিচয় হলো তার নিজ কর্ম। কর্মে অলংকৃত নয় যে জীবন, সে আর যত অলংকারই পরুক, বৃথা সে। মলিন সে।

স্ত্রী এবং পুত্রের সাথে লেখক, Image Credit_লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল
স্ত্রী-পুত্রের সাথে লেখক; Image Credit: Rauful Alam

দুই মলাটের ভেতরে লেখক তুলে ধরেছেন তার নিজ জীবনের কথা, অভিজ্ঞতার কথা। গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। তিনি আশার কথা বলেছেন, হতাশার কথা বলেছেন, পাষণ্ডের দেশে মস্তকাবনত পণ্ডিতের কথা বলেছেন। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কথা বলেছেন। ভাঙা স্বপ্ন জোড়া লাগানোর গল্প শুনিয়েছেন। তার সূক্ষ্ম লেখনীর শব্দভাণ্ডারে উঠে এসেছে শ্রমিকের ঘামের মূল্য, সেশনজট নামক এক অভিশাপ কিংবা রেমিটেন্স যোদ্ধাদের নিরন্তর সংগ্রাম। অসংখ্য মেধাবী তরুণ মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে অকালেই ঝরে পড়ছে, তাদের বাঁচাতে আকুতি জানিয়েছেন। স্বাধীনতার অর্ধশতাধিক বছরে অনেক অর্জন থাকলেও জাতিকে দেয়ার মতো এখনো অনেক কিছুই বাকি আছে। সেগুলো অর্জনের জন্য জাতিকে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে সামনে এগিয়ে যেতেই হবে। অসংখ্য নির্যাতিত নারীর না বলা অনেক কথা, বাবা হারানো শিশুটির নিষ্পাপ চোখের ছলছল চাহনি, মালিকের ধমক খেয়ে অধিকার বঞ্চিত শ্রমিকের হৃদয়ের কান্না যে শুনতেই হবে আগামীর বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের স্বপ্নচোখ যে আছে সেদিকেই তাকিয়ে!

লেখকপ্রসঙ্গ

ড. রউফুল আলম অর্গানিক কেমিস্ট্রির একজন গবেষক। জন্মস্থান কুমিল্লা জেলায়। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ  মাধ্যমিক শেষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি শেষে সুইডিশ কেমিক্যাল সোসাইটির স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভ্যানিয়ায় (UPenn) পোস্টডক্টরাল গবেষণা করেন। বর্তমানে নিউজার্সিতে ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে সিনিয়র সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করছেন।

অণুর সাথে অণুর মিস্ত্রী! Image Credit_লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল
অণুর সাথে অণুর মিস্ত্রী; Image Credit: Rauful Alam

নতুন নতুন রাসায়নিক বিক্রিয়া উদ্ভাবন করে মানবকল্যাণে ব্যবহার করা তার গবেষণার বিষয়। তিনি সুইডিশ কেমিক্যাল সোসাইটি ও আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির সদস্য। তার গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে রসায়নের আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা জার্নালগুলোতে। এর মধ্যে জার্নাল অব দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি (JACS) এবং Angewandte Chemie উল্লেখযোগ্য। গবেষণাকর্ম উপস্থাপন করেছেন আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

লেখালেখির সাথে তার সম্পৃক্ততা বহুদিনের। দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে লিখেছেন তিনি। তার প্রকাশিত প্রথম বই ‘একটা দেশ যেভাবে দাঁড়ায়’ পাঠক সমাদৃত। বাংলাদেশের টেকসই, সুষম উন্নয়নের জন্য তিনি তার অভিজ্ঞতা ও দিক-নির্দেশনাগুলো লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করে যাচ্ছেন।

পাঠককে আকৃষ্ট করবে যেসব কথা

  • মানুষের পৃথিবীতে যতই সীমারেখা টানি, মানুষ সে সীমারেখা ভাঙবেই।
  • যে হাঁটতে জানে তার জন্য পথের দরকার হয় না। যে হাঁটতে জানে না, সেই খোঁজে মসৃণ পথ।
  • দ্বিধান্বিত হওয়ার সাহস মানুষকে নতুন পথ দেখায়। দ্বিধান্বিত হওয়ার মতো প্রখর যুক্তি মানুষের মনে ভিন্ন জানালা খুলে দেয়।
  • যে সমাজের মানুষ ভয়শূন্য চিত্তে বড় হতে পারে না, সে সমাজের মানুষের হৃদয় খর্বাকৃতির হয়ে থাকে।
  • মানুষকে কখনোই একটি-দুটি পরীক্ষা দিয়ে বিচার করা যায় না। মানুষ অত সহজ, সস্তা কিছু নয়। সন্তানদের জীবনের পরীক্ষাগুলোতে উত্তীর্ণ হওয়ার শিক্ষা দিন। তারা একদিন হাসবেই। একদিন হাসাবেই!
  • এ যেন দ্য ল্যান্ড অব ব্রিলিয়ান্ট মাইন্ড কিলার। মেধাবীদেরকে মেরে, মূর্খরাই সেখানে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে বেড়াবে।
  • সৃষ্টির দাবি করতে হয় সর্বাগ্রে। সৃষ্টিতে দ্বিতীয়ের স্থান নেই।
  • যে জাতি শ্রমকে মূল্য দেয় না, শ্রদ্ধা করে না, তাদের অগ্রগতি হয় না। প্রকৃতি সেখানে অপ্রসন্ন হয়ে থাকে। 
  • এই বৈচিত্র্যতাই চিরন্তন। এই বৈচিত্র্যতাই আমাদের আবাস গৃহ– আপনি মেনে নিতে পারেন কিংবা না-ই পারেন।
  • যেখানে প্রশ্ন নেই, যুক্তি নেই, তর্ক নেই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই, সেখানে প্রাণ কোথায়– সেটা তো স্থানু। সেখানে জঙ্গমতা নেই!
  • বিদ্যা কোনো মদের বোতল নয় যে পুরনো হলেই টেস্ট বাড়বে। বিদ্যা হলো করাত, নিত্যদিন শান দিতে হয়। তা নাহলে জং ধরে।
  • একজন অযোগ্য বসের অধীন কখনো যোগ্য ও স্মার্ট লোকজন বেড়ে উঠতে পারে না। সেখানে কর্মস্পৃহা হ্রাস পায়। মগজে জং পড়ে। টেবিলে টেবিলে ধুলো আর ফাইল স্তুপ হতে থাকে সমান্তরালে।
  • ছোট চারাগাছ থেকে কেউ কোনোদিন বলে দিতে পারে না— কোন গাছটি বৃক্ষ হবে, কোন গাছটি মহীরুহ হবে। তাই প্রতিটি চারাগাছকেই যত্ন করতে হয়।
  • আমার কাছে এই ‘চোখের আলোর’ অর্থ হলো জ্ঞান। বই পড়ে সৃষ্ট ওমাটিডিয়াম! বই থেকে স্ফুরিত দীপ্র।  

Language: Bangla

Topic: This article is a book review on 'Bangladesher Shopnochokh' written by the scientist and researcher Dr Rauful Alam. 

Featured Image: Rauful Alam

Related Articles

Exit mobile version