দোলনচাঁপা, একটি ফুলের নাম। সুগন্ধের জন্য যার নামডাক সর্বত্রই বিরাজমান। দোলনচাঁপা নামে আরও আছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, যার মুখবন্ধে পাওয়া যায় ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে– মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে’ এই জনপ্রিয় কবিতাটি; কবিতাটি কবি লিখেছিলেন যখন তিনি ব্রিটিশ সরকার বিরোধী কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ লেখার জন্য এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত।
তবে আমাদের এই চেনা পরিচিত গণ্ডির বাইরে দোলনচাঁপার আরো একটি পরিচয় আছে। এই নামে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদকে ডাকতেন তাঁর স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন। তিনি হয়তো নিছক প্রেম থেকেই এই নাম দিয়েছেন তার ভালোবাসার মানুষটিকে, কিন্তু কি অদ্ভুত সাদৃশ্যই না বিদ্যমান তার দেয়া নাম আর আগের অনুচ্ছেদের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে।
যতদিন বেঁচে ছিলেন, ব্যক্তিত্ব এবং চারিত্রিক ব্যবহারে সুবাসিত করেছেন চারপাশ। আবার এই ব্যক্তিত্বের গুণে বা দোষেই হোক, জেল জীবন ছিল তার নিত্যসঙ্গী। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যেমন কারাবরণ করেছেন নিয়মিত, আবার স্বাধীনতা উত্তরকালেও চক্রান্তের শিকার হয়ে জীবনের শেষ দিনগুলোও তাকে কাটাতে হয়েছে কারাগারের ছোট্ট প্রকোষ্ঠে, যার ইতি ঘটে তার জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে।
৫০ বছরের এই নাতিদীর্ঘ জীবনে তাজউদ্দীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছেন বার বার, নিজ হাতে রচনা করেছেন ইতিহাসের গতিপথ, অথচ সেই অর্থে ঠিক পাদপ্রদীপের আলোতে কখনোই উদ্ভাসিত হননি তিনি। বঙ্গবন্ধুর দুর্দমনীয় ব্যক্তিত্বের আড়ালে থেকে নিজের কাজটা করে গেছেন ধীর স্থির-সচেষ্টভাবে, ঠাণ্ডা মাথায়। ২৫ মার্চের খুন রাঙা সময়ের পরবর্তীক্ষণে, বন্দুকের তপ্ত সীসার মুহুর্মুহু উদগিরণে, জাতীয়তাবাদী চেতনা দমনের নীল নকশার সামনে যার মাপা পদক্ষেপ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে করেছে সংগঠিত, ইনি সেই তাজউদ্দীন।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে পরিমাণ কিংবদন্তী রচিত হয়েছে, সে তুলনায় তাজউদ্দীনকে নিয়ে তেমন কিছুই হয়নি। অথচ তার অবদান কিছুমাত্র কম নয়। অন্তত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সব রাজনৈতিক দিক ঠাণ্ডা মাথায় সামাল দেওয়াটাই তো এক অনন্য উপাখ্যান হতে পারতো। অথচ এই মানুষটিকে নিয়ে হয়নি তেমন উচ্চবাচ্য, হয়নি মানুষটার মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণ, হয়নি তার স্বপ্ন ও সংগ্রামের চিত্রায়ন। কেবল হয়েছে তার মৃত্যু দিবস উপলক্ষে স্মরণসভা, তার নামে সড়কের নামকরণ, গুটিকতক বইপুস্তক। বর্তমান প্রজন্মের সামনে তাকে স্বতন্ত্রভাবে তুলে ধরার সেই কাজটিই করার চেষ্টা করেছেন সুহান রিজওয়ান তার ‘সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’ উপন্যাসে।
উপন্যাসের কাহিনীসংক্ষেপ হিসেবে বলা আছে,
এই কাহিনী একটি যুদ্ধের। সেই যুদ্ধের দেয়ালে নানা চলকের লুকোচুরি, দেশপ্রেমের ঢেউ আর বিশ্বাসঘাতকতার চোরাস্রোত, দাবার বোর্ডের গুটি হয়ে বহু মানুষের হাঁটাচলা।
এই কাহিনী একটি যুদ্ধোত্তর দেশের। সেখানে বহুমাত্রিক সব জটিল গণিত, আলোকের যত অনন্তধারার সঙ্গী দুর্ভাগ্যের অন্ধকার।
‘সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’ এই দুই সর্পিল সময়ের পটে দাঁড়ানো একজন সরল মানুষের গল্প।
কী আছে এতে
এ বইটি কোনো ইতিহাস নয়, বরং ইতিহাসকে উপজীব্য করে লেখা এক উপন্যাস। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ থাকলেও বইয়ের ঘটনাবলিতে ক্ষণে ক্ষণেই অনেক ঐতিহাসিক চরিত্রের পদচারণা ঘটেছে; যাদের স্পর্শের প্রতিধ্বনি ঘটেছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপাখ্যানের অলিতে-গলিতে।
২৫ মার্চের নারকীয় এবং ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞের প্রতিক্রিয়ায় যখন শহর ছেড়ে গ্রামের অভিমুখে ধাবমান হচ্ছে মানুষ, তাদের দলে ছিলেন তাজউদ্দীনও। কিন্তু, অন্যদের মতো তাজউদ্দীনকে তো শুধু জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম নিয়ে ভাবলেই চলবে না, তিনি তখন ইতিহাসের দিক পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে চালিয়ে যেতে হবে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।
ঠিক এখান থেকেই শুরু হয় এ বইয়ের ঘটনাক্রম। মুক্তিযুদ্ধ বলতে আমরা যারা সশস্ত্র প্রতিরোধের ছবিগুলোই দেখতে পাই, তাদের জন্য এ বই উন্মোচন করবে পারিপার্শ্বিক আরেকটি দুয়ার। যে দুয়ারের পরতে পরতে ছিল বিশ্ব রাজনীতির কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট। যে দুয়ারের মাধ্যমে হটানো হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পরাশক্তিকে, বানচাল করা হয়েছে তাদের চক্রান্তকে।
এগুলো হচ্ছে দুই অংশে সাজানো উপন্যাসের প্রথম অংশ। পরবর্তী অংশে উঠে এসেছে স্বাধীনতা উত্তরকালের টুকরো টুকরো ঘটনাসূচী এবং মোহভঙ্গের সেই কঠিন দিনগুলোতে তাজউদ্দীন আহমেদের ভূমিকা। একাত্তর থেকে পঁচাত্তরের মধ্যবর্তী সময়টুকু নিয়ে জানতে উৎসাহী যারা, এ অংশটিতে পর্যাপ্ত খোরাক আছে তাদের জন্য।
বইটি কোথায় অনন্য
এটি ইতিহাস নয়, একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। কিন্তু, তা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর সম্মিলনে ইতিহাসের অনেক না বলা কথা উপস্থাপিত হয়েছে এখানে। এগুলো পরিপূর্ণতা পেয়েছে উপর্যুপরি তথ্যসূত্রের আলিঙ্গনে। মনে হতে পারে, এতে কী-ই বা এমন অসাধারণত্ব প্রকাশ পায়? তা বুঝতে গেলে খেয়াল করতে হবে বাংলা সাহিত্যের সেরা ঐতিহাসিক উপন্যাসের সিরিজটির দিকে, সুনীলের ‘সময়’ সিরিজ। ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’ এবং ‘পূর্ব-পশ্চিম’ এর মতো কালজয়ী উপন্যাসগুলো এই সিরিজের অন্তর্ভুক্ত।
এ উপন্যাসগুলোর সিংহভাগই লেখকের কল্পনাপ্রসূত; বলা যেতে পারে ইতিহাসের চরিত্রগুলোকে লেখক নিজের মতো এঁকেছেন, নিজের পছন্দ করা পটে। পক্ষান্তরে, অল্প কিছু অংশ ব্যতীত এ উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণে লেখকের পড়াশোনার পরিধি বিস্তর, যাচাই বাছাই করা হয়েছে ব্যাপক।
এছাড়া আরেকটি দিক বিবেচনায় বইটির আকর্ষণ অনুপেক্ষণীয়, তা হলো এটি ঠাণ্ডা মাথার কৌশলী তাজউদ্দীনের পাশাপাশি তার ভেতরের ব্যক্তি তাজউদ্দীনকেও বিশেষায়িত করেছে, যে তাজউদ্দীনের পরিচয় নেতার খোলসের বাইরে অন্য সবকিছু। এ তাজউদ্দীনকে কখনো পড়া যাবে তার সন্তানদের চোখ দিয়ে, কখনো পড়া যাবে তার সহধর্মিণীর চোখ দিয়ে, কখনও তার একান্ত সচিবের চোখ দিয়ে, আবার কখনো বা একজন বিএসএফ কর্মকর্তা গোলক মজুমদারের চোখ দিয়ে। মোটকথা, তাজউদ্দীন এ উপন্যাসে প্রতিভাত হয়েছেন শত্রুমিত্র নানা দৃষ্টিকোণ থেকেই।
গঠনশৈলী
এদিক থেকে বইটি এক কথায় অপূর্ব। কোনো জায়গাতেই লেখাকে টেনে লম্বা করা হয়েছে এমন মনে হবে না। এছাড়া গল্প এগিয়েছে নিজস্ব ছন্দে, নিজস্ব ভঙ্গিমায়, যা পড়তে গিয়ে বিরক্তির উদ্রেক হয় না আবার অপূর্ণতাও থাকে না। এরকম ঐতিহাসিক চরিত্র চিত্রণে অনেক বেশি তথ্যের সম্ভার ঘটানোর তাড়নাকে উপেক্ষা করাটা বেশ দুরূহই বটে। লেখক এ কাজটাতে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন নিপুণভাবে। কোনো জায়গাতেই অত্যধিক তথ্যবহুল মনে হবে না, অথচ তথ্যের কোনো কমতিও নেই কোথাও। পাশাপাশি লেখার গতি সর্বত্রই সুনিয়ন্ত্রিত। আলস্য বা বিরক্তি আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
লেখনী
লেখনীর দিক থেকে প্রথম কিছুটা সময় লেখকের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। একবার খাপ খাইয়ে নিতে পারলে এর ভাষা সুমিষ্ট, পঠন আকর্ষণীয়, বুনন প্রশংসনীয়। প্রতিটি ভিন্ন অংশের সাথে মানানসই উপশিরোনাম পাঠককে রাখবে সদাসতর্ক, প্রতিটি অংশের শেষে পরবর্তী কোনো এক অংশের পূর্বাভাস পাঠককে রাখবে সদাব্যাকুল। এগুলো ছাড়াও লেখকের শব্দচয়ন এবং বর্ণনাশৈলী উপন্যাসের প্রেক্ষাপটের সাথে যথোচিত।
বাড়তি পাওয়া
বর্ণিত অন্য সবকিছুর সাথে এ উপন্যাসে ছাড়াছাড়াভাবে উঠে এসেছে ক্র্যাক প্লাটুন, জাহানারা ইমাম, রবার্ট ম্যাকনামারা সহ স্বাধীনতার উত্তরকাল থেকে আজ অবধি চলে আসা কিছু মিথের যুক্তিযুক্ত খণ্ডায়ন। সেই খণ্ডায়নগুলো গ্রহণীয় নাকি বর্জনীয় তার দায় পাঠকেরই একান্ত যৌক্তিক চিন্তা চেতনার সাথে সহাবস্থানীয়।
সবশেষে…
আবারও পুনরাবৃত্তি করতে হয়ে যে, এই বইটা ঐতিহাসিক দলিল নয়, বরং ঐতিহাসিক দলিল অবলম্বনে একটি উপন্যাস। কিন্তু, একজন পিতা, একজন আপসহীন নেতা, একজন দুঃসময়ের কাণ্ডারি, সর্বোপরি একজন ব্যক্তি তাজউদ্দীনকে চিনতে হলে এই বইটা হতে পারে খুব পাওয়ারফুল একটা চশমা, খুব উপযোগী একটি উপকরণ।
তবে উপন্যাসই হোক, আর ইতিহাসই হোক, তা লেখে মানুষই; আর মানুষ পক্ষপাতিত্বের উর্ধ্বে নয়। কাজেই কোনো লেখাই হয়তো অতিরঞ্জনের বাষ্প মুক্ত নয়। সেক্ষেত্রে, তথ্যের সঠিকতা নিরূপণের জন্য ধর্তব্যে নেওয়া যেতে পারে অনেক মানুষের সম্মিলিত ভাষ্য আর এর জন্য লেখক সুহান রিজওয়ান করেছেন বিস্তর গবেষণা, করেছেন ব্যাপক নিরীক্ষণ, যার প্রমাণ বইয়ের উপসংহারে প্রবলভাবে দৃশ্যমান। কাজেই, তার প্রচেষ্টাকে সম্মান জ্ঞাপন পূর্বক এই বইটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশি মাত্রেই সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য বলে পরিগণিত করা যেতে পারে। কেননা মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর মতো তাজউদ্দীনও ছিলেন বাংলাদেশ শব্দের সাথে সমার্থক; সবসময় আগলে রেখেছেন পরম মমতায়, সাক্ষী হয়েছেন এর উত্থান ও পতনের সময়কালের।