কালো সীমানা: দেশভাগ এবং দাঙ্গায় নিষ্পেষিত মানুষদের গল্প

এখানে সমাধিতলে শুয়ে আছে মান্টো আর তার বুকে সমাহিত আছে গল্প বলার সব কৌশল আর রহস্য।

এই কথাগুলো সাদত হাসান মান্টোর সমাধিস্থলের এপিটাফে লেখা! অন্য কেউ নয়, মান্টো নিজেই মৃত্যুর বছরখানেক আগে তার এপিটাফের জন্য লিখে রেখেছিলেন। একজন গল্পকারের চিন্তা-ভাবনা কতটা বিশাল থাকা দরকার এই দুই লাইনের লেখা যেন তারই যথাযথ উত্তর!

একজন সাহিত্যিক হিসেবে মান্টো তুমুল আলোচিত এবং সেই সাথে ব্যাপকভাবে সমালোচিতও! যদিও উপমহাদেশে উর্দু গল্প-উপন্যাস খুব বেশি আলোচিত নয়, তবুও যে কয়েকজন উর্দু সাহিত্যিক নিজের নামকে তুলে ধরেছেন এক অনন্য উচ্চতায়, তাদের মধ্যে সাদত হাসান মান্টো অন্যতম। তার জন্ম ১৯১২ সালে পাঞ্জাবের লুধিয়ানায়। মাত্র ৪৩ বছরের জীবনে তিনি লিখেছেনও অল্প, তবে সেসব লেখাই সাহিত্যের দুনিয়ার হাজার হাজার লেখাকে পাশ কাটিয়ে টিকে আছে যুগের পর যুগ!

মান্টোর লেখালেখির ধরন ছিল সমাজের অমানবিকতার গল্পগুলো নিজের আবেগের সাথে না মিলিয়ে সোজাসাপ্টাভাবে তুলে ধরা, যেন অদূর ভবিষ্যতে লেখাগুলো ইতিহাসের জন্যও কাজে দেয়। শুধু সাহিত্যের জন্য লিখলে মান্টো তার জীবনের অর্ধেক কষ্ট অনায়াসেই কমিয়ে ফেলতে পারতেন। চারদিকের নিন্দা আর সমালোচনার ঝড় থামিয়ে দেয়ার কথা না ভেবে মানুষের জীবনকে তিনি তুলে এনেছেন কলমে। তাই তো তার মৃত্যুর এত বছর পরও তাকে নিয়ে লেখা হচ্ছে শত শত লেখা।

সাদত হাসান মান্টো; Image Source: dailyo.in 

সাদত হাসান মান্টোর গল্পগ্রন্থ ‘কালো সীমানা’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে। ভারত ভাগের সময় ঘটে যাওয়া দাঙ্গা আর অমানুষিকতার নানা কথা উঠে এসেছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়। ‘কালো সীমানা’র প্রতিটি গল্পই একেকটি বিস্ময়ের জন্ম দেয়, কারণ কোনো গল্পই তেমন বড় না, এমনকি কয়েক শব্দের গল্পও আছে! কিন্তু এই অল্প অল্প শব্দে লেখক যে কথাগুলো বলেছেন তা নিঃসন্দেহে এক বিশাল কাজ। দাঙ্গার যে নিষ্ঠুর চেহারা লেখক দেখেছেন তা আমাদের চোখে পৌঁছে দিতেই হয়তো অল্প অল্প কথায় ‘কালো সীমানা’ গল্পগ্রন্থের জন্ম। ইতিহাস আসলে আমাদের ঘটনা জানায়, কিন্তু সাহিত্য সেই ঘটনার ব্যথা অনুভব করতে সাহায্য করে। তাই হয়তো মান্টো সেই পথেই হেঁটেছেন আর আমাদের জানিয়েছেন ভারত ভাগের সময়কার দাঙ্গা, হানাহানি আর ঘরছাড়ার ব্যথা কেমন ছিল!

কালো সীমানা; Image Source: goodreads.com 

 

আগুন লাগল যখন, সারা মহল্লা জ্বলে ছাই হলো। কেবল একটা দোকান বেঁচে গেল, সেই দোকানের ওপর সাইনবোর্ড তখনও পড়া যাচ্ছিল, “এখানে বাড়ি বানানোর মাল-সামান পাওয়া যায়।”

‘চ্যালেঞ্জ’ নামের মাত্র কয়েক শব্দের এই গল্পে মান্টো বলে দিয়েছেন অনেক কথা। মানুষের উপর অমানবিক শাসন, শোষণ আর মানুষের মনোবল ভাঙতে যে নানা ফাঁদ তৈরি করা হয়- এই গল্পে যেন সেসব কথাই ফাঁস করে দিয়েছেন। লেখক নিজেও এসব ফাঁদের শিকার, কারণ দাঙ্গা বাধ্য করেছিল তাকে তার প্রিয় শহর ছাড়তে, বন্ধুবান্ধব-প্রিয়জন ছেড়ে লেখককে যেতে হয়েছিল নিরাপদ আশ্রয়ে। কী আশ্চর্য বিষয়! যে শহরে মান্টোর বেড়ে ওঠা, সেই শহর থেকেই নাকি তাকে যেতে হলো তথাকথিত নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে! নতুন করে সব কিছু গড়ার ফাঁদে লেখকের মতো হঠাৎ করে বহু মানুষই আসলে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে, কারণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল মৃত্যুর উল্লাস! তারই ইঙ্গিত পাওয়া ‘সরি’ নামের আরেকটি গল্পে,

পেট ফাঁক করে দিয়ে নাভি পর্যন্ত নেমে এলো ছুরি। পাজামার ফিতে কেটে গেল। ছুরি চালানো লোকটা সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে বলল, “ছি, ছি, ছি, ছি, মিস্টেক হয়ে গেছে!”

মাত্র কয়েক শব্দের এই গল্পে মান্টো ইংগিত দিয়েছেন মানুষের চিন্তা-ভাবনার দিকে। মানুষের জীবন থেকে অন্যকিছুই যে বড় হতে পারে না সেই কথাই যেন ফিসফিস করে বলেছেন। সাদত হাসান মান্টো তার জীবনেও এমনটাই দেখেছেন। মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতার কারণেই মানুষ নানা সীমানায় নিজেকে বন্দি করে, কিন্তু দিনশেষে সেই পুরাতন শাসন-শোষণই তার বুকের উপর চেপে বসে! ভারতভাগের সময় যেমনটা দেখেছিলেন লেখক; এই তো কয়েকদিন আগের নিজের শহরটাই অন্যের হয়ে যায়, আপন মনে হওয়া প্রিয় প্রতিবেশীকেই ভয় পেতে শুরু করে মানুষ! একটা নতুন সীমানা আসার পর কীভাবে যেন সেই সীমানা মানুষে মানুষে সম্পর্ক থেকেও বড় হয়ে যায়, তা-ও মাত্র অল্প ক’দিনের ব্যবধানেই! এসব ব্যথাই লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন লেখক, যেন ইতিহাস পাঠের সাথে সাথে আমাদের চোখের সামনে মানুষের হাহাকার আর অমানবিকতাও ফুটে ওঠে।

বই জুড়ে শুধু দাঙ্গার কথাই উঠে আসেনি, সমাজের অসংগতির সাথে সাথে মানুষের দ্বিমুখীতাও উঠে এসেছে।যেমন বলা যাক এই বইয়ের আরও একটি ছোট গল্পের কথা, যেখানে দেখা যায় দুই বন্ধু মিলে একটি মেয়েকে কিনে আনে! তারপর রাত শেষ হলে এক বন্ধু মেয়েটির নাম জানতে চেয়ে অবাক হয়ে যায়, কারণ মেয়েটি তাদের ধর্মের নয়! অথচ এমন অপকর্ম সমাজ এবং ধর্মে নিন্দনীয় হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু সেসব পাশ কাটিয়ে দুই বন্ধুর নিজস্ব চিন্তায় ভর করে লেখক আমাদের এক অন্যরকম বিষের সন্ধান দেন, যেখানে দেখা যায় ধর্মের নাম দিয়ে সব করা হচ্ছে, শুধু ধর্মটাই হচ্ছে না!

মানুষ যেন মুহূর্তের মধ্যেই নিজের সুবিধামতো নিজেকে পাল্টে নিচ্ছে। এই যে নিজের সাথে নিজের পরিবর্তনের খেলা, এই খেলার হাত ধরেই সমাজে হানাহানি, মারামারি আর দাঙ্গা হানা দেয়। মানুষের জন্য মানুষের চিরচেনা পরিবেশই হুমকি হয়ে দাঁড়ায়! মানুষ হিসেবে যে ন্যূনতম স্বাধীনতা পাওয়ার কথা তা-ও হারিয়ে যায়! যেমনটি আরেক গল্পে দেখা যায় একজন শিখ তার ন্যূনতম স্বাধীনতার সন্ধান করে এভাবে,

আমি মোটেও শিখ হতে রাজি নই, আমার দাড়ি কামানোর জিনিসপত্র ফেরত দাও।

ঠিক এমনটাই হয় যখন সমাজে অন্ধকারের রাজত্ব কায়েম হয়, মানুষ হিসেবে ন্যূনতম যে স্বাধীনতা সেটাই দুর্লভ হয়ে ওঠে। এসবের বিরুদ্ধেই লড়ে গেছেন সাদত হাসান মান্টো। ‘কালো সীমানা’য় জানিয়েছেন সে কথাই। জানিয়েছেন আমরা যখন আমাদের জন্যই নিরাপদ নই তখন যে সমাজটা থাকে সেটা আসলে পুরোপুরি অন্ধকারের দখলে থাকা সমাজে পরিণত হয়।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় এভাবেই মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে চলেছিল; image source: thegurdian.com

 

‘কালো সীমানা’ বইয়ের প্রতিটি গল্পই পাঠককে যেমন সমাজের অন্ধকারের ব্যথা অনুভব করতে বাধ্য করবে, তেমনই চিন্তার পথেও এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। নিঃসন্দেহে পাঠকের জন্য এটি এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা আর ইতিহাসের হাহাকার অনুভব করতে তো সাদত হাসান মান্টোর কাছে যাওয়াই যায়। লেখা শেষ করা যাক মির্জা গালিবের পঙক্তি দিয়ে, যা মান্টো তার ‘কাফনের গলা’ নামের লেখায় ব্যবহার করেছেন,

ভেবো না আমি নিভে গেছি, ভোরের সূর্যের মতো
প্রেমের দাগ আমার কাফনের গলায় অলংকার হয়ে আছে।

কালো সীমানা বইটি কিনতে ভিজিট করুন রকমারিতে।

This is a bengali book review article on 'Kalo Simana' by Sadot Hasan Manto.

Feature Image Courtesy: Author

Related Articles

Exit mobile version