ওয়াইল্ডলাইফ (২০১৮): যে জীবন যাতনার, নয় বন্যতার

গত দশকের সেরা বা অন্যতম সেরা সিনেমা হিসেবে বিশেষিত ‘দেয়ার উইল বি ব্লাড’ কিংবা এ দশকে ‘প্রিজনার্স’, ‘১২ ইয়ার্স আ স্লেইভ’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ সিনেমাগুলোতে চমৎকার অভিনয় দিয়ে নিজেকে এ প্রজন্মের অভিনেতাদের মাঝে এক বিরল প্রতিভা পল দানো। তিনি যখন পরিচালক হিসেবে নাম লেখাতে যাচ্ছেন, তখন খবরটাকে ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই বেশ আগ্রহ জমা হয়েছিল। পল থমাস অ্যান্ডারসন, ড্যানিস ভিলানুভে, স্টিভ ম্যাককুইন’দের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা যখন আছে, তখন অবশ্যই নিজের এই কাজের জন্য দু-চার কলাকৌশল রপ্ত করে তবেই নির্মাণে নেমেছেন। এ নিয়ে ভাবাভাবির সময়টাতে রিচার্ড ফোর্ডের উপন্যাস ‘ওয়াইল্ডলাইফ’কে ভিত্তি করে একই নামের সিনেমা নিয়ে এলেন পল দানো। যে সিনেমায় ৬০ দশকের মন্টানা শহরে সদ্য বাস করতে আসা ছোট্ট একটি পরিবারের হৃদয়গ্রাহী গল্পের চিত্রায়ন করেছেন তিনি।

৬০ দশকের মন্টানার শান্ত, মনোরম পরিবেশ সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে ধরা দেয় ছোট্ট এই পরিবারটির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, এ পরিবারের ১৪ বছর বয়সী বালক জো’র দৃষ্টিকোণ থেকে। পুরো পরিবারটির বিদগ্ধ, নির্মম বাস্তবতার গল্প বয়ান করা হয় সিনেমায়। পরিবারের প্রধান কর্তা জেরি ব্রিনসন, একজন অভিজ্ঞ গল্ফ খেলোয়াড়। কিন্তু মন্দভাগ্যের কারণে বারবার বদলি হতে হয় তাকে। আর তা নিয়ে যথেষ্ট বিরক্ত পরিবারের বাকি দুই সদস্য।

এর কিছুটা আভাস দর্শক পায় সিনেমার শুরুর দৃশ্যে। বাড়ির সামনের লনে দুই পিতা-পুত্র গল্ফ খেলাকে কেন্দ্র করে যথেষ্ট আমুদে ভাবে থাকলেও, ডাইনিং টেবিল পর্যন্ত গড়াতে গড়াতে পুরো পরিবেশটা হয়ে ওঠে গুমোট। নিমেষেই হাসি মুছে গিয়ে, সবার মুখটা গম্ভীর আর হতাশায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। যার কারণ তৎক্ষণাৎ দর্শকের সামনে প্রকাশিত না হয়ে, খানিক সময় নেয়।

ডাইনিং টেবিলের দৃশ্যটি;
Image Source: June Films

পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গড়ায়, যখন কর্তা জেরি তার একমাত্র উপার্জনের পথটিও হারিয়ে বসে। আর্থিক দুর্যোগ নেমে আসে গোটা পরিবারে। কর্ত্রী জ্যানেটের একার আয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না আর। সন্তান জো চিন্তিত- আবার না জানি কোন অজানা পরিবেশে ছুটতে হয়, তা নিয়ে। তাদের আর্থিক অনটন এতটাই প্রকট যে, ভাঙা টিভিখানা সারানোর জোগাড় নেই। পুরনো রেডিওতে একটা ভারিক্কি কণ্ঠে বারবার ভেসে আসছে মন্টানা শহরের পাহাড়ঘেরা অংশে সৃষ্ট দাবানল এবং তা লোকালয়ে বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কাজনক বার্তা। বেকার জেরি সিদ্ধান্ত নেয়, ‘ফায়ার ফাইটার’ হিসেবে যোগ দেবে। এতে নাখোশ হয় জ্যানেট। তবে নিজ সিদ্ধান্তে অটলতা নয়, বরং জেরির ওই ভয়ংকর জেদটাই জ্যানেটের মাঝে তাদের সম্পর্ক নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে।

এতদিনের কর্তব্যপরায়ণতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। পরিবারের জন্য নিজেকে বিসর্জন দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তে অটল থাকা জ্যানেটের অটলতায় চিড় ধরে। জ্যানেটের প্রতি সহানুভূতি বোধ করতে থাকা দর্শক তার হঠাৎ পরিবর্তনে একটা চাপা উৎকণ্ঠা বোধ করে। এ পর্যায়ে দর্শক নিজের মাঝেও একটা দ্বন্দ্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়। পরিবারটিকে একত্র রাখার তাগিদ শুধু জো নয়, দর্শকও যেন বোধ করতে থাকে। জো’র দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় দর্শক জ্যানেটকে এক মুহূর্তের জন্য নিষ্ঠুর ভাবতে পারে, কিন্তু পরমুহূর্তে জ্যানেটের অবস্থানে দর্শক নিজেকে রাখতে গিয়ে দিশেহারা হয়; এবং সামনের কথা ভাবতে গিয়ে ক্রমশ বিচলিত হয়ে পড়তে থাকে। 

রক্তের সম্পর্ক আর বিশ্বাসে গড়ে ওঠা পরিবারে, বিশ্বাসের জায়গাটি যখন নষ্ট হয়ে যায়- তখন একমাত্র রক্তের সম্পর্ক পরিবার বাঁচিয়ে রাখার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পল দানো সিনেমার প্রতিটি ফ্রেমের ভেতরের বক্তব্য দিয়ে এই গভীর দর্শন প্রতিষ্ঠা করেছেন। রূঢ় বাস্তবতা আর মানবিকতা, দুটোকে পাশাপাশি রেখে অখণ্ড এক চিত্র তৈরি করেছেন তিনি। 

সম্পর্ক তখন শুধুই রক্তের প্রয়োজনে;
Image Source: June Films

প্রেমিকা যোয়ি কাজানকে সাথে নিয়ে গম্ভীর আর প্রগাঢ় চিত্রনাট্যটি লিখেছেন তিনি। চরিত্রগুলো নিয়ে ভেবেছেন, যত্ন নিয়েছেন। দানো চরিত্রগুলোকে বিচার করতে যাননি, আপন গতিতে চলতে দিয়েছেন। আর চরিত্রগুলোকে দর্শকের সামনে জীবন্ত করে তুলতে নির্ভুল একটা কাস্টিং বাছাই করেছেন। চমৎকার কিছু অভিনয়শিল্পীদের কাজে লাগিয়েছেন। অভিনেতা হওয়ার কারণে সবচেয়ে বড় সুবিধাটা তিনি এ জায়গায় পেয়েছেন। তার চরিত্রকে দর্শকের সামনে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য যতটা যা দরকার, তার সবটুকুই নিংড়ে নিয়েছেন অভিনয়শিল্পীদের কাছ থেকে।

এবং অভিনয়ের কথা বলতে গেলে, শুরুতেই চলে আসে জ্যানেট চরিত্রে ক্যারি মুলিগানের কথা। শুরু থেকে যেভাবে দর্শক চরিত্রটিকে দেখে আসছে, সেই স্বভাবের বিরুদ্ধাচরণ দর্শককে সম্পূর্ণ নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জ্যানেট চরিত্রটিকে দেখতে আহ্বান করে। নিজের ক্ষতির মধ্য দিয়েই আলোড়নের পথ খুঁজে বের করে এ চরিত্র। ধ্বংসের মধ্য দিয়েই যেন পুনঃজাগরণ। এ সিনেমা নারী স্বাধীনতার বার্তা বয়ে বেড়ায় সূক্ষ্মভাবে। যে আবেদন এই চরিত্রটি রাখতে চায়, তা প্রশংসনীয় আর জোরালো হয়ে প্রভাব রাখতে পারার যোগ্যতা রাখে ওমন চরিত্রায়ন আর ক্যারি মুলিগানের অভিনয়ের কারণেই। চরিত্রটি নিয়ে তার বোঝাপড়া, অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ নতুন এক প্রলেপ দিয়েছে চরিত্রটায়। 

ক্যারি মুলিগান আদর্শ স্ত্রী হয়েই তখন স্বামীকে বোঝাচ্ছিল;
Image Source: June Films

 

তারপর বলতে হয়, কর্তা জেরির কথা। তার মধ্যে অহংবোধের দেখা মেলে, জ্যানেট এবং জো’র মতো দর্শকের সারিতে আমরাও তাতে ক্ষুব্ধ হই। আমরা ভাবি, তার স্বভাব খুব ঔদ্ধত্যপূর্ণ; কিন্তু, না। আমরা জেরির ওই শুকনো মুখ আর সবকিছুর প্রতি বিষিয়ে ওঠা মনোভাবে তথাকথিত ‘আমেরিকান ড্রিম’ অর্জনে ব্যর্থ হওয়া লোকটির ছায়া দেখতে পাই। জ্যাক জিল্যানহলের চোখের ওই অভিব্যক্তিতেই আমরা জেরি চরিত্রটির ভেতরটা পড়ে নিতে পারি। তার চাপা ক্ষোভ আর বেদনাটা আমরা বুঝে ওঠার চেষ্টা করি সে পর্যায়ে। আত্মমর্যাদায় আঘাত এলে, সেই ঘাঁ কতটুকু গভীরে পৌঁছায়, তার কিছুটা আঁচ করতে পারি তার মুখ দেখে। একটা দীর্ঘ বিরতির পর আমরা আবার তাকে দেখতে পাই, জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত বিধ্বস্ত সৈনিকরূপে। এবং এবার যে অস্থিরতার কবলে তাকে পড়তে হবে, সেকথা ভেবে আমরা নিজেদের মাঝে সহানুভূতি খুঁজে পাই তার জন্য।

তবে আমাদের উদ্বিগ্নতা আর সহানুভূতিশীল মনোভাব চরমে পৌঁছোয়, যখন আমরা কিশোর জো’র দিকে তাকাই। আমরা যতটুকু না শুনি, তারচেয়েও কম বলি। কিন্তু, তার চোখ দিয়ে আমরা সবটাই দেখি। তার সাথে আমরা সাক্ষী হই পিতা জেরির হতাশার, মা জ্যানেটের নিরাশার। এমনকি অন্য এক পুরুষের সাথে তার মায়ের একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের চিত্রও আমরা অবলোকন করি। জো কিচ্ছুটি বলেনি, কারণ, তার প্রচণ্ড অন্তর্মুখী স্বভাব। কিন্তু এর ভয়াবহতা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি। আমরা তা উপলব্ধি করি এড অক্সেনবৌল্ডের অভিব্যক্তিপূর্ণ চোখ আর তার শারীরি ভাষার মধ্য দিয়ে। তার অব্যক্ত আবেগ পর্দায় তুলে আনতে ক্যামেরা সবসময় তার কাছাকাছি থেকেছে, থেকেছি আমরাও।

পিতাকে বিষণ্ণচিত্তে বিদায় দেওয়ার সেই দৃশ্যে;
Image Source; June Films

পারিবারিক জটিলতা ও সম্পর্কের দ্বন্দ্ব নিয়ে নির্মিত এই সিনেমাকে বিষয়বস্তু আলোচনায় ‘রেভল্যুশনারি রোড’, ‘ব্লু ভ্যালেন্টাইন’ সিনেমাগুলোর পাশাপাশি রেখে দেখা যেতে পারে। আবার নান্দনিকতার দিক দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করা যেতে পারে টেরেন্স মালিকের ‘ট্রি অভ লাইফ’, থমাস অ্যান্ডারসনের ‘দ্য মাস্টার’ সিনেমাগুলোর সাথে। গল্পের বয়ানভঙ্গি ক্লাসিক ধারার। গল্প বয়ানে আর ভিজ্যুয়াল ভাষায় স্মৃতিকাতরতা চুঁইয়ে পড়ছে যেন। পরিচালক পল, পারিবারিক সম্পর্কের আবেগঘন গল্প যেমন বলেছেন, ঠিক একই সময়ে ৬০ দশকের আমেরিকার প্রগতিশীল সমাজ আর দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদী অবস্থার চিত্র বর্ণনা করেছেন সূক্ষ্মভাবে। তবে অনুনাদী হতে গিয়ে মেলোড্রামাটিক হয়নি, চরিত্রের প্রতি আকুলতা জাগাতে গিয়ে ম্যান্যুপুলেটিভ হয়নি।

৬০ দশকের মন্টানাকে পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরার প্রয়াসে যথেষ্ট সমৃদ্ধ আর বর্ণনাত্মক ছিল ডিয়াগো গার্সিয়ার সিনেমাটোগ্রাফি। শুধু মন্টানার নীরবতার উপাখ্যান বর্ণনায় থেমে থাকেনি দানোর নির্দেশনা আর গার্সিয়ার ক্যামেরা। দানোর বাস্তবধর্মী পরিচালনার পরিচয় আমরা একদম শুরুতেই পাই। যেখানে জ্যারি আর জ্যানেটের বিক্ষিপ্ত আর উত্তেজিত বাতচিতের দৃশ্যে দু’জন দৃশ্য থেকে প্রস্থান করলেও দানো স্ট্যাটিক পজিশনে ক্যামেরা রেখেছেন। শুধু একবার নয়, বারবার এ ধারা তিনি অনুসরণ করেছেন আর এতে করে স্পেসের যে ব্যবহার তিনি করে দেখিয়েছেন, তা খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়।

এই কৌশল জো’র নিজস্ব জগত প্রতিষ্ঠায় পিওভি শটগুলোকে আরো দৃঢ়তায় বেঁধে ফেলে। মন্তাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারও আমরা দেখতে পাই, প্রথম অঙ্কের একটি বিশেষ দৃশ্যে। যেখানে জ্যানেট তার মোটরসাইকেলে চড়ছে, জেরি গাড়িতে আর জো বাসে; এ দৃশ্যে মন্তাজের ব্যবহার থেকে আমরা প্রতিটি চরিত্রের আলাদা গন্তব্য আর তাদের বিচ্ছিন্নতার আভাস পাই। দানো, ক্যামেরার গতিবিধি একদমই পরিমিত রেখে স্ট্যাটিক কম্পোজিশনে সাজিয়েছেন শটগুলো। ঠিক যেন হাতে আঁকা ছবি। এডওয়ার্ড হপারের চিত্রকর্মগুলোর অনুপ্রেরণাতেই মূলত তিনি শট কম্পোজ করেছেন। আবহসঙ্গীতে ডেভিড ল্যাং’য়ের স্যাক্সোফোন, হৃদয়ে মোচড় দেওয়ার মতো পিয়ানোর সুর ভাবনার জালকে আরো বিস্তৃত করে। 

আরেকটি পেইন্টারলি কম্পোজড শট;
Image Source: June Films

 

ওয়াইল্ডলাইফ গল্প বয়ানে তো ধরেছে ক্লাসিক স্টাইল, তবে যে শৈলীতে পল দানো এই সিনেমা উপস্থাপন করেছেন, তা নতুন কিছু। কিছু জায়গায় অবশ্য সিনেমার নাটকীয় সংলাপ, বিষয়াদির সাথে সংযোগ স্থাপনের চেয়ে চরিত্রে অনুকম্পন তুলতে আগ্রহী বেশি ছিল। তা খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক ঠেকে এবং গল্প বয়ানের স্বাভাবিক গতি খানিক বাধাপ্রাপ্ত হয় এতে। কিন্তু সেসব জায়গায়ও দানোর পরিমিত নির্দেশনা দর্শকের আগ্রহ পুনরায় কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। সে কাজটিও এই সিনেমা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে করেছে, যে বিনয় আমাদের চোখ এড়ায় না ল্যান্ডস্কেপ দৃশ্যগুলোতেও। সিনেমার অন্তিম দৃশ্যে এত অনুনাদী আর মর্মস্পর্শী দৃশ্য, যা পর্দা থেকে মুছে গেলেও দর্শকের মনে পড়ে থাকে। সুন্দরতা আর কঠোর বাস্তবতার সাংঘর্ষিক সম্পর্ক পাশাপাশি এক হয়ে থেকেছে সেখানে।

This bengali article is a review of the acclaimed 2018 film 'Wildlife' (2018). It's directed by the first time director Paul Dano, who previously worked as an actor in the films; 'There Will Be Blood', '12 Years A Slave', 'Ruby Sparks'. It's a heart warming and also a heart breaking film. An accomplished debut for Paul Dano.

Featured Image: The New York Times

Related Articles

Exit mobile version