টম এন্ড জেরি, পপাই, বাগস বানি, মিকি মাউজ… নামগুলো শুনলে কি মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা? বিটিভিতে প্রতি মঙ্গলবার গডজিলা, কিংবা প্রতি সোম আর বুধবার জুমানজি দেখে বড় হয়নি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। টেলিভিশনের পর্দায় সিংহের মাথা ভেসে উঠলে ছেলেবেলায় আপনাআপনি মনে আনন্দের শিহরণ জাগতো, এই বুঝি টম এন্ড জেরি দিল!
শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ পর্যন্ত কে না পছন্দ করে কার্টুন? ছোটদের খাবার খাওয়ানোর দুর্দান্ত অস্ত্র হিসেবে তো আছেই, বিনোদনের দিক দিয়ে কার্টুন শতাব্দীকাল ধরে মানুষের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে আছে। কিন্তু এই সোজা-সরল, নিষ্কলুষ বিনোদনের উৎসেরও রয়েছে একটি অন্ধকার ইতিহাস। বিতর্কিত বিষয় থাকার কারণে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ শতকের দিকে বানানো বেশ কিছু কার্টুনকে। আজ জানা যাক তেমনই কয়েকটি নিষিদ্ধ কার্টুন সম্পর্কে।
কোল ব্ল্যাক অ্যান্ড দি সেবেন ডর্ফ
ওয়াল্ট ডিজনির ‘তুষারকণা ও সাত বামন’ (Snow White and the Seven Dwarfs) এর গল্প কম-বেশি সবার জানা। সেই যে তুষারের মতো ধবধবে সাদা রাজকন্যা, কুচক্রী সৎমা রানী আর জাদুর আয়নার গল্পটা আর কি। তো, বব ক্ল্যাম্পেট নামের এক ভদ্রলোকের মনে হলো পুরো ব্যাপারটিকে প্যারোডির মতো করে একটি কার্টুন বানালে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমন কাজ, স্নো হোয়াইটের প্যারোডি তৈরি করে কার্টুন তৈরি করে ফেললেন। যেন-তেন কেউ নয়, মেরি মেলোডিজের এই কার্টুনটি ১৯৪৩ সালে রিলিজ পেলো স্বয়ং ওয়ার্নার ব্রাদার্স কোম্পানি থেকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন এই কার্টুনটির নাম প্রথমে ‘সো হোয়াইট অ্যান্ড দি সেবেন ডর্ফস’ (So White and de Sebben Dwarfs) ঠিক হলেও, আসল কার্টুনের কাছাকাছি নাম হয়ে যায় বলে নামটি পরে পরিবর্তন করা হয়। প্যারোডি কার্টুনটিতে কুচক্রী রানী , জাদুর আয়না, এমনকি গল্পের প্রধান একটি মেয়ে চরিত্রও আছে স্নো হোয়াইটের মতো, যার নাম থাকে সো হোয়াইট। কিন্তু এই কার্টুনের প্রত্যেকটি চরিত্র থাকে কৃষ্ণাঙ্গ, এমনকি সো হোয়াইট নামের মেয়েটিও! বর্ণবাদ, অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট ও অন্যান্য কারণে এটি পরবর্তীতে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং কখনও টেলিভিশনে এটি প্রচার করা হয়নি। ক্লাসিক ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সবচাইতে বিতর্কিত কার্টুনের স্থানে নিজেকে ধরে রেখেছে আলোচ্য কার্টুনটি।
বাগস বানি নিপস দ্য নিপস
মেরি মেলোডিজের জনপ্রিয় একটি কার্টুন চরিত্র হলো বাগস বানি। ওয়ার্নার ব্রাদার্স কোম্পানির অফিসিয়াল ম্যাসকট এই বাগস বানিকে কার্টুনের পাশাপাশি দেখা গেছে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন, সিনেমা, কমিক বই, মিউজিক ভিডিও ও গেমে। লম্বা কানের সাদা-ধূসর এই খরগোশটির সাথে বেশিরভাগ সময়ে সহ-চরিত্রে দেখা গেছে শিকারি এলমার ফাডকে। কৌতুকপূর্ণ বাগস বানির বিভিন্ন শিশুতোষ হাস্যকর কর্মকান্ডে না হেসে উপায় থাকে না। কিন্তু এই বাগস বানির একটি পর্বকেও রাখা হয়েছে নিষিদ্ধ কার্টুনের তালিকায়।
‘বাগস বানি নিপস দ্য নিপস’ (১৯৪৪) নামের এই পর্বে বাগস বানিকে দেখা যায় সাগরে একটি কাগজের বাক্সে ভেসে এক পরিত্যক্ত দ্বীপে চলে আসতে। এ সময় তার দেখা হয় এক জাপানি সৈনিকের সাথে, যে ছোরা বের করে বানিকে নাস্তানাবুদ করতে আসে। এরপর বানির দেখা হয় এক সুমো কুস্তিগীরের সঙ্গে, সেখানেও কিছু মজার কার্যকলাপ দেখা যায়। কিন্তু সমস্যা একটিই, পুরো কার্টুন জুড়ে জাপানিদের মাত্রাতিরিক্ত স্টেরিওটাইপ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তুলনামূলক খাটো, ছোট ছোট চোখ এবং অনর্গল জাপানী ভাষায় দুর্বোধ্য বকবকানি ইত্যাদি সবার হাসির খোরাক যোগালেও জাপানীদের আহত করেছিল। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নির্মিত এই কার্টুনটিতে আমেরিকার অন্যতম প্রধান শত্রুপক্ষ জাপানের ব্যাপারে একটি নেতিবাচক ভাব দেখানো হয়। কাজেই সব মিলিয়ে এই কার্টুনটিকে টেলিভিশনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
ক্লিন প্যাশ্চার
১৯৩৬ সালে ওয়ার্নার ব্রাদার্স কোম্পানি থেকে মুক্তি পায় দ্য গ্রিন প্যাশ্চার্স সিনেমাটি। ধর্মের বিভিন্ন দিক, ঈশ্বর, স্বর্গ, নরক, বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে নির্মিত সিনেমাটিতে মূলত আফ্রিকান-আমেরিকানদের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় চরিত্রে রাখা হয়। বেশ কিছু দেশে এই সিনেমাটি নিষিদ্ধ রয়েছে। ফ্রিজ ফ্রিলেং নাম্নী জনৈক লোক ভাবলেন, কেন এই সিনেমাটির আদলে নতুন কিছু করছি না? কাজেই পরের বছরেই (১৯৩৭) জনাব ফ্রিলেং বানিয়ে ফেললেন প্যারোডি কার্টুন ‘ক্লিন প্যাশ্চার’। বলা বাহুল্য, এটিও একটি মেরি মেলোডিজ কার্টুন।
প্লট শুরু হয় ম্যানহাটনের হারলেম শহরে, আফ্রিকান-আমেরিকানদের সবচেয়ে বড় আবাসস্থল হিসেবে এই শহরটি পরিচিত। কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের সাংস্কৃতিক আর বাণিজ্যিক কেন্দ্র এই হারলেম শহর। তো, ঈশ্বর দেখলেন স্বর্গের স্টক ভ্যালু ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এখানে স্বর্গকে অবশ্য বলা হয়েছে ‘Pair-o-dice’, পরিষ্কারভাবে এটি ইংরেজি শব্দ ‘প্যারাডাইস’কে বিদ্রূপ করে বলা। এদিকে হারলেম শহরের সবাই নাচ-গান আর পানাহারে মত্ত। কাজেই ঈশ্বর তার এক দূতকে হারলেমে পাঠালেন সেখান থেকে কিছু ক্রেতাকে বুঝিয়ে Pair-o-dice এ আনার জন্যে। কিন্তু ধীর-স্থির এই দূত কাউকে সেখান থেকে আনতে পারলেন না। পরে একদল ‘মিউজিক্যাল এঞ্জেল’কে হারলেমে পাঠানো হয়, যাদের নাচ-গানে আকৃষ্ট হয়ে কেবল মানুষ না, স্বয়ং শয়তান পর্যন্ত Pair-o-dice এ আসতে চায়।
কাহিনী শুনেই খানিকটা ধরে ফেলা যায় যে, এই কার্টুনে একইসাথে ধর্ম অবমাননা এবং বর্ণবাদ- দুটোর উপস্থিতিই বিদ্যমান। এছাড়া হারলেম শহরকে এখানে দেখানো হয়েছে পাপপূর্ণ শহর হিসেবে, যা তখনকার আফ্রিকান-আমেরিকানদের আহত করে অনেকাংশেই। আর তাই ক্লিন প্যাশ্চার কার্টুনটি টেলিভিশনে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়।
জাঙ্গল জিটার্স
পরিচালক ফ্রিজ ফ্রিলেং, ক্লিন প্যাশ্চারের এমন করুণ পরিণতিতেই কি না কে জানে, পরের বছরেই সিদ্ধান্ত নিলেন চ্যালেঞ্জিং আরেকটি কার্টুন তৈরি করে দেখাবেন। ব্যস, ১৯৩৮ সালেই তিনি বানিয়ে ফেললেন ‘জাঙ্গল জিটার্স’ নামের কার্টুনটি, যথারীতি মেরি মেলোডিজ থেকে রিলিজ পায় এটি। তবে এই কার্টুনটি কোনোদিনও অফিসিয়াল ভিডিও রিলিজের ছাড়পত্র পায়নি। কেন? সেটিই দেখা যাক।
জাঙ্গল জিটার্স কার্টুনের গল্প শুরু হয় আফ্রিকান এক জঙ্গলে, সেখানকার অধিবাসীদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম দেখানো হয়। এখানে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান এসকল অধিবাসীদের দেখানো হয় নরখাদক হিসেবে। তারা পশুপাখির পাশাপাশি মানুষকেও রান্না করে (কিংবা কাঁচা) খেয়ে ফেলে। তাদের নেহায়েত অসভ্য জংলি হিসেবে উপস্থাপন করলেও জঙ্গলের বিভিন্ন উপকরণের সঙ্গে আধুনিক জীবনের বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সাদৃশ্য দেখানো হয়েছে।
একপর্যায়ে দেখা যায়, সভ্য জগতের এক সেলসম্যান (বিক্রেতা) কোনো একভাবে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে এবং জঙ্গলের অধিবাসীরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারা তাকে বড় একটি হাঁড়িতে ঢুকিয়ে সেদ্ধ করে খাওয়ার উপক্রম করে। কিন্তু একসময় তাদের রানীর নজরে পড়ে যায় লোকটি। রানী লোকটির প্রেমে পড়ে যায় এবং তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ রানীকে বিয়ে করার চাইতে লোকটি নরখাদকের পেটে চলে যাওয়াকেই বেছে নেয়।
বোঝাই যাচ্ছে, বর্ণবাদ দোষে দুষ্ট কার্টুনটি কেন কখনোই অফিসিয়াল রিলিজ পায়নি!
অল দিজ অ্যান্ড র্যাবিট স্টু
র্যাবিট শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এই কার্টুনটি কী হতে পারে, তাই না? ঠিকই অনুমান করেছেন, এটি দুষ্ট খরগোশ বাগস বানিকে নিয়েই নির্মিত একটি পর্ব। কিন্তু আবার কী কারণে নিরীহ নরম তুলতুলে বাগস বানিকে তোপের মুখে পড়তে হলো?
১৯৪১ সালে টেক্স অ্যাভেরির পরিচালনায় মেরি মেলোডিজ সিরিজের ‘অল দিজ অ্যান্ড র্যাবিট স্টু’ কার্টুনটি মুক্তি পায়। বাগস বানির চির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সবসময় শিকারি এলমার ফাডকে দেখানো হয়, কিন্তু এই পর্বে দেখা যায় কৃষ্ণাঙ্গ এক শিকারিকে। বিতর্কিত এই কার্টুনে বাগস বরাবরের মতোই শিকারিকে নাস্তানাবুদ করতে থাকে নানা কৌশলে বোকা বানিয়ে, আর শিকারি তাকে ধরতে গিয়ে প্রতিবারেই ভজঘট লাগিয়ে দেয়। অনেক বছর কার্টুনটি প্রচারিত হলেও, কৃষ্ণাঙ্গদের অতিরিক্ত বোকাসোকা হিসেবে উপস্থাপন করার অভিযোগে এই পর্বটি ১৯৯০ সালের পর থেকে টেলিভিশনে প্রচার নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়।
সানডে গো টু মিটিন’ টাইম
শেষ করা যাক ফ্রিজ ফ্রিলেং এর আরেকটি বিতর্কিত সৃষ্টির কথা বলে। তার পরিচালনায় ১৯৩৬ সালে মেরি মেলোডিজের ‘সানডে গো টু মিটিন’ টাইম’ নামের এই কার্টুনটি মুক্তি পায়। এই কার্টুনে দেখানো হয় সাধারণ একটি শহরে এক রবিবারের গল্প। গির্জার ঘণ্টার শব্দে শহরের সবাই হেলতে দুলতে গির্জার দিকে এগোতে থাকে প্রার্থনার উদ্দেশ্যে। নিকোডেমাস নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে, ধর্মকর্মে যার বিশেষ মন নেই, সে-ও অনেকের সাথে অনাগ্রহ নিয়ে এগোয়। একসময় দেখা যায়, নিকোডেমাস গির্জায় না গিয়ে খেলাধুলায় মত্ত হয়ে উঠেছে। তখন তার মায়ের তাড়ায় উঠে গিয়ে আবার সে হাঁটা ধরে। কিন্তু গির্জার দরজায় কয়েকটি মুরগিছানা ঘুরে বেড়াতে দেখে দুষ্টবুদ্ধি চাপে নিকোডেমাসের মাথায়, সেখান থেকে কয়েকটি ছানা চুরি করে নেয়ার চেষ্টা করে সে।
পরমুহূর্তে কীসের আঘাতে যেন জ্ঞান হারায় নিকো, ঘোরের মাঝেই সে দেখে সে যেন নরকের দরজায় পৌঁছে গেছে। ভীষণ চেহারার পাহারাদাররা তাকে নিয়ে যায় স্বয়ং শয়তানের কাছে, সেখানে তার যাবতীয় পাপকর্ম আর গির্জায় যাওয়া ফাঁকি দেওয়ার কথা বলে শয়তান তাকে শাস্তি দেয়। এ সময় জ্ঞান ফিরে আসে নিকোর, তাড়াতাড়ি গির্জার পথে হাঁটা দেয় সে।
গোটা কার্টুন জুড়ে কৃষ্ণাঙ্গদের দেখানো হয়েছে বেশ হীন এবং বিদ্রূপাত্মকভাবে। অস্বাভাবিকরকম বিশালাকারের ঠোঁট জুড়ে দেওয়া হয়েছে নিকোডেমাসের মুখে। শুধু তা-ই নয়, নরকের পাহারাদারদেরও আঁকা হয়েছে একইভাবে। এছাড়া কার্টুনটিতে আফ্রো-আমেরিকানদের সংস্কৃতি আর চালচলনকে দেখানো হয়েছে খানিকটা অশ্লীল আর অমার্জিতভাবে। আর তাই ফ্রিলেং এর এই কার্টুনটিকে স্থান পেতে হয় নিষিদ্ধের তালিকায়।
ফিচার ইমেজ: wall.alphacoders.com