ইনটু দ্য ওয়াইল্ড: মুক্ত এক মানুষের কথা

আচ্ছা, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। আপনি যে পেশাতেই থাকেন না কেন, আপনাকে প্রতিনিয়তই কাজে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। শিক্ষার্থী হলে পরীক্ষা-ক্লাস টেস্ট-অ্যাসাইনমেন্ট-কুইজ নিয়ে চিন্তিত, ব্যাংকার হলে সকালে উঠে হাতে ব্রিফকেস নিয়ে দৌড়াতে হচ্ছে, ব্যবসায়ী হলে সারাক্ষণ নিজের ব্যবসার তদারকি করতে হচ্ছে— মোটকথা এই সমাজের সবাইকে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে শুধুমাত্র তার দায়িত্ব পালন করার জন্য।

এভাবে রোবটের মতো কাজ করে যেতে যেতে একপর্যায়ে মনে হয় আর পারছি না। অনেকেরই হয়তো মনে হয় ‘ধুর, আর ভাল্লাগে না, এর চেয়ে সব ছেড়েছুড়ে বনে জঙ্গলে চলে যাই।’ কিন্তু পরক্ষণেই ভুলে যেতে হয় সেই অস্ফুট আর্তনাদের কথা, ঘুমিয়ে যেতে হয় আগামীকালের জন্য। সকাল থেকেই যে আবার শুরু হবে সেই রোবট জীবনচক্র। বেশিরভাগেরই সাহস হয় না জীবনের এই চক্রটা ভাঙার।

আবার ভাঙলেই যে সুখের সন্ধান পাওয়া যাবে তা-ও নয়। তবে একটু পরখ করে দেখতে তো সমস্যা নেই। অনেকেরই ইচ্ছে করে সিনেমার ফরেস্ট গাম্পের মতো হেঁটে হেঁটে গোটা দেশ, গোটা বিশ্বটা ঘুরে বেড়াবে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলে কোথাও থেমে জিরিয়ে নেবে, তারপর আবার হাঁটা শুরু করবে। অজানা এক জগৎ যে হাতছানি দিয়ে সবসময়ই নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা আদিম যাযাবর রক্তকে ডাকছে। 

এরকমই এক যুবকের কথা। এই যুবকের জীবন নিয়েই লেখা হয়েছে Into The wild নামের বইটি। ১৯৯২ সালের এপ্রিলের ঘটনা। আমেরিকার ইস্ট কোস্টের সম্ভ্রান্ত এক পরিবারের ছেলে, ক্রিস্টোফার জনসন ম্যাক্যান্ডেলস, গ্রাজুয়েশনের পর হাতে যে টাকা-পয়সা ছিল তার সব দাতব্য সংস্থায় দান করে দেয়। নিজের গাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। আইডেন্টিটি কার্ড, ক্রেডিট-ডেবিট সব ধরনের কার্ড পুড়িয়ে ফেলে, এমনকি নিজের সব জামাকাপড়ও ফেলে নতুন মানুষ হিসেবে জীবন শুরু করে। এরপর হাঁটা শুরু করে উত্তর আমেরিকার পথে পথে। 

এই সেই ক্রিস্টোফার জনসন
ক্রিস্টোফার জনসন (১৯৬৮-১৯৯২); Image: ladbible.com
ক্রিসের সর্বশেষ তোলা ছবি, এই বাসেই মৃত্যু হয়েছিল তার; Image: ladbible.com

তার পরিবারের কাছে এসবের কিছুই জানা ছিল না। তাদের চোখে ক্রিস্টোফার এক আদর্শ সন্তান, ভালো ছাত্র, ভালো অ্যাথলেট। তাদের কথা সে সবসময় মুখ বুজে মেনে চলেছে। তবে?

ছেলের খবর তারা পান ছেলের মৃত্যুর পর। প্রায় চার মাস পর আলাস্কার এক জনমানবহীন এলাকায় এক পরিত্যক্ত বাসে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। আলাস্কার ঠাণ্ডায় জমে নয়, বরং বুনো আলু খেয়ে মারা গিয়েছে। মেডিকেল রিপোর্ট অন্তত তা-ই বলে। সে এই চার মাস তার সেই যাযাবর স্বপ্নটা পূরণ করতে পেরেছে? পেরেছে সত্যিকারের ‘মুক্ত মানুষ’ হতে? পেরেছে প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে যেতে?

এই চার মাসে ক্রিস্টোফার প্রচুর মানুষের সান্নিধ্যে এসেছে, মুগ্ধ করেছে সবাইকেই। অচেনা ব্যক্তিও পাঁচ-ছয় মিনিট সময় কাটালে তার মায়ার জালে আটকে যেত। কিন্তু সবাইকে মায়াবন্ধনে আটকে ফেললেও নিজে কারো মায়ায় আটকে পড়েনি। সে নিজে ঘুরে বেড়িয়েছে, নিজের জীবনকে উপভোগ করেছে নিজের মতো করে। সে যা চেয়েছিল, তা করে দেখতে চেয়েছিল। 

Into the Wild চলচ্চিত্রের পোস্টার; Image: Paramount Pictures

কিন্তু তার সেই যাত্রা বেশি দিন টেকেনি। করুণ পরিণতি হয়েছিল না। তার জীবন নিয়ে লেখা Into The wild বইটি অবলম্বনে সিনেমা বেরোবার পর লোকজন ক্রিস্টোফারকে চিনতে শুরু করে এবং হিরো ভাবা শুরু করে। ইচ্ছে প্রকাশ করে তার মতো হওয়ার। 

আমার মতে, সে কিছুটা বোকামীর কাজ করেছিল। সকল দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে, সামাজিকতাকে ছুঁড়ে ফেলা ভালো জিনিস নয়। আলাস্কায় তার শেষ দিনগুলোতে সে চাইলেই পাশের লোকালয়ে হেঁটে চলে আসতে পারতো চিকিৎসার জন্য, কিংবা কিছু দরকারি জ্ঞান রাখতে পারতো বনে জঙ্গলে টিকে থাকার জন্য। কিন্তু তা সে করেনি। যার কারণে তাকে করুণ পরিণতি বরন করে নিতে হয়েছে।

বইটা বেশ চমৎকার। লেখক Jon Krakauer ছুটে বেড়িয়েছেন গোটা উত্তর আমেরিকা জুড়ে। নিখুঁতভাবে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন ক্রিস কীভাবে চারমাস কাটিয়েছে। বইয়ের ভাষা চমৎকার, অনেকগুলো ম্যাপ দিয়ে পাঠকের চোখের সামনে ক্রিসের ভ্রমণ করা জায়গাগুলো ভাসিয়ে রাখতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। ধন্যবাদ পরিশ্রমী এই লেখককে।

Into the Wild বইয়ের প্রচ্ছদ; Image: abebooks.com

বইটি কি পড়বেন? অবশ্যই। বইটি আপনাকে শিক্ষা দেবে কী কী করা উচিত নয় সে সম্পর্কে। আর মনের বুনো যাযাবর হবার তৃষ্ণা কিছুটা হলেও মিটবে এ বই পড়লে। সকলকে পড়ার আমন্ত্রণ রইল। আর হ্যাঁ, সিনেমাটাও দেখতে ভুলবেন না। বেশ চমৎকারভাবে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। 

বইয়ের নাম: Into The wild || লেখক: Jon Krakauer

প্রথম প্রকাশ: 1996 || অনলাইনে প্রাপ্তিস্থান: রকমারি 

This is a Bangla article and it's a review of Into the Wild by Jon Krakauer

Featured Image: intothewild2016.wordpress.com

RB-SM

Related Articles

Exit mobile version