রোদমাখা এক সকালে অনীলার হাতে চিঠি এলো। চিঠি পেয়ে সে বাকরুদ্ধ। চিঠি দিয়েছেন তার ছোটমামা, যিনি কিনা গত ৩৫ বছর ধরে নিরুদ্দেশ। একেবারে নিরুদ্দেশ বলাও ঠিক হবে না। অনীলার নানী বেঁচে থাকতে মাঝে মাঝে তিনি চিঠি লিখতেন পশ্চিমের নানা শহর থেকে। এভাবেই শুরু হয় ‘আগন্তুক’ চলচ্চিত্রের গল্প।
আজীবন জাদুকর সত্যজিৎ রায়ের শেষ চলচ্চিত্র ‘আগন্তুক’। সিনেমাটি তিনি নির্মাণ করেছেন একদমই হালকা আবহে। তার আর সব সিনেমার মতো এখানে নেই স্যাটায়ার কিংবা বেকারত্বের হাহাকার। বলতে গেলে প্রায় চার দেয়ালের মাঝেই তিনি শুনিয়েছেন সভ্যতা নামের ফাঁকা কলসির শব্দদূষণ। প্রতি মুহূর্তে, প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি সংলাপ যেন চিৎকার করে বলছে- “ফিরিয়ে দাও এ অরণ্য, লও এ নগর“।
‘আগন্তুক’ চলচ্চিত্রটির আইএমডিবি রেটিং ৮.১, রোটেন টোমেটোতে স্কোর ১০০ তে ৯৭! আজ অত্যন্ত সাধারণ দর্শকের দৃষ্টি দিয়ে গল্প করা যাক তাঁর সৃষ্টি ‘আগন্তুক’কে নিয়ে।
১৯৮৩ সালে ‘ঘরে বাইরে’ চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার সময় হার্ট অ্যাটাক হয় সত্যজিৎ রায়ের। এই ঘটনার প্রভাব পড়েছিল তাঁর শেষের বছরগুলোতে। ১৯৮৪ সালে ‘ঘরে বাইরে’ চলচ্চিত্রের কাজ শেষ করলেন তিনি। এরপর থেকে পুত্র সন্দীপ রায়ই বাবার হয়ে ক্যামেরার দায়িত্ব সামলাতেন। জীবনের শেষ সিনেমা তিনটি- ‘গণশত্রু’, ‘শাখা-প্রশাখা’, ও ‘আগন্তুক’ নির্মিত হয়েছিল আভ্যন্তরীণ মঞ্চে। সিনেমা তিনটি ছিল আগের চলচ্চিত্রগুলোর চেয়ে একেবারেই আলাদা।
‘আগন্তুক’-এর জন্ম সত্যজিৎ রায়ের ছোট গল্প ‘অতিথি’ থেকে। পরিচালক, প্রযোজক, সুরকার, চিত্রনাট্যকারও তিনিই। ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন উৎপল দত্ত, মমতা শঙ্কর, দীপঙ্কর দে, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, প্রমোদ গাঙ্গুলী, রবি ঘোষ প্রমুখ। চিত্রগ্রাহক বরুণ রাহা। ১২০ মিনিটের সংলাপনির্ভর এই নাট্য চলচ্চিত্রটি ১৯৯১ সালে ভারতে, ১৯৯২ সালের মে মাসে আমেরিকা, ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে ইংল্যান্ডে মুক্তি পায়।
আগন্তুকের আগমনী
আগন্তুকের ধারণাটি সাহিত্যে বেশ পরিচিত। এখানে আগন্তুক হলেন এক অগ্নিপরীক্ষার প্রতীক, কখনোবা মূর্তিমান প্রশ্নবোধক চিহ্ন! অনীলার ছোটমামা ৩৫ বছর ধরে নিরুদ্দেশ; এমনকি তিনি লম্বা না খাটো, সে কথাও মনে নেই অনীলার। অনীলার মধ্যবিত্ত স্বামীর তো প্রথম থেকেই সন্দেহ এই লোক বাটপার! অথচ লোকটা জোরাজুরি করেনি, ভারতবর্ষের চিরচেনা আতিথেয়তার ভরসায় সে পা রাখছে ভাগ্নীর বাড়িতে। ওদিকে অনীলা-সুধীনের ছেলে সাত্যকি বেজায় উত্তেজিত, ‘দাদু কি দাদু না’ তাদের বাড়িতে আসতে চলেছে।
এখানে দুটো বিষয় খুব স্পষ্ট হয়ে যায়, আতিথেয়তার খ্যাতির জন্য গল্পের ঝুলিটা ঠাকুরমার ঝুলি থেকেও পুরোনো, অবশ্য তার পেছনে এই তথাকথিত সভ্য সমাজ ও অতিথিরও হাত আছে। শিশু সাত্যকির কাছে যা চরম উত্তেজনার, বাড়ির বড়দের কাছে তা বেশ বিরক্তিরই। আকাশছোঁয়া দামের বাজারে একজন অনাহুতের পেছনে এতগুলো টাকা খরচ করা যা তা কথা নয়!
কেন আগন্তুক?
গত ৩৫ বছর ধরে আগন্তুক মনমোহন মিত্র ঘুরেছেন পৃথিবীর পথে, ঘর ছেড়ে, স্বজন ছেড়ে, কিন্তু কেন? প্রশ্নটা আসা অনেক স্বাভাবিক, একই প্রশ্ন এসেছিল অনীলার মনেও। উত্তরে আগন্তুক বলেন- ‘বাইসন’। লেখাপড়ায় অনেক বেশি ভাল ছিলেন তিনি। আঁকাআঁকির শখও ছিল। এক ম্যাগাজিনে একদিন দেখলেন বাইসনের ছবি! কী অদ্ভুত সুন্দর! কে এই চিত্রকর, যার এত সুন্দর শিল্পচেতনা? যার তুলির ছোঁয়ায় হাজার বছরের বিলুপ্ত প্রাণীও প্রাণ খুঁজে পায়? পরে তিনি জানলেন, এই ছবি হাজার হাজার বছর আগে এঁকেছে আলতামিরার গুহামানব! তারপর তিনি আর থেমে থাকেননি। ছুটে চলেছেন সেই জীবনের সন্ধানে, যেখানে সভ্যতা পেয়েছে অন্য এক মাত্রা। চলচ্চিত্রের এই অংশটি দর্শককে আবার ভাবায়, তবে কি হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতা পিছিয়ে নয়, বরং এগিয়েই ছিল খানিকটা?
পরিচয় কি পাসপোর্ট?
“পাসপোর্ট দিয়ে কিচ্ছু প্রমাণ হয় না”- অনীলার স্বামী সুধীনের দিকে পাসপোর্ট ছুড়ে দিয়ে বলেন মনমোহন মিত্র ওরফে আগন্তুক! অনীলার ছোটমামা আসল কি নকল তা জানতে সুধীনের আগ্রহ ছিল তার পাসপোর্টের দিকে। কিন্তু আগন্তুক তাকে সাবধান করে দেন, আজকাল জাল পাসপোর্ট বানানো তেমন কিছু খাটুনির কাজ নয়! ব্যক্তিত্বের তেজদীপ্ত মামা অনেক কিছুই আঁচ করতে পারতেন!
এখানে ফের একটি প্রশ্ন, পাসপোর্টের দুই পাতায় কি সত্যিই সম্ভব হয় মানুষ চেনা? প্রমাণ করা যায় একটা মানুষ ঠিক কতটুকু মানুষ? শুধু আসল মানুষের জাল পাসপোর্ট? মানুষও তো জাল হয় আজকাল!
ম্যাজিক!
চাঁদ সূর্যের পূর্ণগ্রহণের সময় চাঁদ অতিক্রম করে না সূর্যকে, সূর্য অতিক্রম করে না চাঁদের ছায়াকে। একইভাবে পৃথিবীও একই আকৃতির ছায়া ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর, কেন এমন হয়? আগন্তুক বলেন- “ম্যাজিক!” অনীলার ছেলে সাত্যকি তার দাদুর খুব ভক্ত হয়ে পড়ে, দাদু হলেন তার ‘ছোটদাদু’, যিনি কিনা যখন তখন ছুট লাগাবেন! দাদু সাত্যকিকে বলে দেন, আর যা-ই হোক, কখনো কূপমন্ডূক না হতে!
বোকাবাক্সের সভ্যতা
৩৫ বছরের একটা বড় অংশ মনমোহন মিত্র কাটিয়েছেন বিভিন্ন আদিবাসীদের সাথে। অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরেছেন সাথে সাথে। সুনীলের উকিল বন্ধু পৃথ্বীশ সেনগুপ্ত যখন ছোটমামাকে শায়েস্তা করতে আসেন, নানাভাবে তাকে অপদস্থ করার চেষ্টা চালান, মানুষের মাংস খেয়েছেন কিনা সে প্রশ্নের জবাবে আগন্তুক যখন জানান তার সে ‘সৌভাগ্য’ হয়নি, তখন পৃথ্বীশ এর পেছনে থাকা অসভ্যতার উল্লেখ করেন। আগন্তুক তখন প্রশ্ন করেন, তাহলে সভ্যতা কোনটি? বোমার আঘাতে হাজার হাজার মানুষ মারা? আগন্তুকের মতে আদিবাসীরা এখনো পর্যন্ত অনেক সভ্য, কারণ তাদের অন্তত কাউকে এতটা অবিশ্বাস করা লাগে না, জ্ঞানের বহর দেখিয়ে মানুষকে ছোট করা লাগে না! সত্যি বলতে, সভ্যতার এই ধারণা সত্যজিৎ রায়ের নিজের নয়, তিনি এটা পেয়েছিলেন ফরাসী নৃবিজ্ঞানী ক্লদ লেভি স্ট্রাউসের কাছ থেকে। অবশ্য এর দায় স্বীকার করতে তিনি ভোলেননি।
যে জীবন পাখির ডানার
কথায় কথায় একবার আগন্তুক বলেছিলেন ক্যাপ্টেন নিমোর কথা। সমালোচকরা বলেন, জুল ভার্নের ক্যাপ্টেন নিমোর মতন আগন্তুক মনমোহন মিত্রও মানুষের থেকে,তথাকথিত সভ্য সমাজ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ আবার আগন্তুককে বলেছেন যীশুর পুনরুত্থানের মতো। যীশু ধরণীতে আসার পর তাকে ভুল বোঝে অনেকেই, শাস্তি পেতে হয় যীশুকে, যেমন কষ্ট পেয়েছেন আগন্তুক নিজেও। কিন্তু পুনরুত্থানের মতো আবার ফেরত এসেছেন তিনি। পাখির মতো জীবন তার, আজ এখানে, তো কাল ওখানে, যেন উড়ে বেড়ানোই তার ধর্ম! বহমান হয়ে তিনি যেন সব সভ্যতা থেকে সরে গিয়ে এক বিশ্বমানব হয়েছেন।
অতিথি ও আগন্তুক
ছোটগল্প ‘অতিথি’ থেকে এলেও ‘অতিথি’ আর ‘আগন্তুক’-এর মৌলিক কিছু চোখে পড়ার মতো পার্থক্য আছে। অতিথি থেকে আগন্তুক বিনা দ্বিধায় বেশি ব্যক্তিত্ববান! শেষের দৃশ্যেও সত্যজিৎ রায় এনেছেন ভিন্নতা।
এবং ‘আগন্তুকের পরে’
২০১৫ সালে পরিচালক অর্ক সিনহা ‘আগন্তুকের পরে’ নামে একটি সিনেমা আনার কথা বলেছেন। যেখানে দেখানো হবে আগন্তুকের ২৫ বছর পর ঘটে যাওয়া ঘটনা। আবারো অভিনয় করবেন মমতা শংকর, দীপঙ্কর দে, ধৃতিমান ব্যানার্জি। তরুণ সাত্যকির ভূমিকায় অভিনয় করবেন অভিনেতা আবির চ্যাটার্জী। দেখা হয়ে যাবে কেমন আছে হাওয়ায় ভাসা পাখির ডানার গল্পটা।
ফিচার ইমেজ- oldindianphotos.in