এফএম রেডিও আসবার পর থেকে রেডিও জকি, সংক্ষেপে আরজেদের ভক্ত, অনুরক্ত হয়েছেন অনেকেই। অনেকের স্বপ্ন, মাইক্রোফোনের সামনে বসে নিজেকে উজাড় করে দেয়াও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অদেখা সেই মানুষটিকে নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আরজে হয়ে ওঠে বন্ধুর মতো। আবদার, অনুরোধ চলে তাদের সঙ্গে।
এরকম কণ্ঠ ভালোবাসা, কণ্ঠের জাদুকর আরজে অর্জুন মল্লিক। ছেলে-বুড়ো, চা দোকানি, ট্যাক্সি চালক, কর্পোরেট দম্পতি থেকে সবধরনের, সব বয়সের মানুষ তার শ্রোতা। নিজের দুঃখ ভাগ করতে এরা সবাই রাত জেগে তার শো শোনে।
‘মন আমার’ শো আর অসাধারণ কণ্ঠের জোরে ব্যাপক ভালোবাসা আর জনপ্রিয়তা পায় সে। রাতে চলা এই শো-তে, অনেক মানুষ ফোন করে, নিজের মনের কথা বলে। এরকম একদিন এক কিশোরীর ফোন আসে তার কাছে। সে ছাদের কিনারে বসে আছে নিজের জীবন শেষ করে দিতে। সহেলি নামের এই কিশোরীর বাবা-মায়ের সম্পর্ক খুব একটা ভালো না। মেয়ে একা বাসায় থাকে, আর তারা বাইরে ব্যস্ত। অর্জুন মল্লিক অন এয়ার শো-তে সহেলি আর তার মায়ের কথা বলিয়ে দেন। মেয়েটা বেঁচে যায় সুইসাইড করার হাত থেকে। ব্যস্ত মা আর ক্লান্ত মেয়ে সেই অন এয়ারে নিজেদের মধ্যে থাকা ভুল বোঝাবুঝি কিংবা দূরত্ব ঘুচিয়ে নেয়।
এদিকে শো চলাকালে বেশ কাশতে থাকে অর্জুন। ভেবেছিল সাধারণ কাশি। গুরুত্ব দিল না। এরপরে একদিন সে মনোনীত হয় এক অ্যাওয়ার্ড শোয়ের জন্য। স্ত্রী পৃথা নিজেও একজন বাচিকশিল্পী। স্ত্রী-পুত্রের সাথে সেই শো-তে গেলেন। পুরস্কারও পেলেন। কিন্তু পুরস্কার হাতে নিয়ে কথা বলার সময় হঠাৎ করে গলা আটকে যায়। কথা বলতে কষ্ট হয়। বার বার কাশি, শো করতে কষ্ট, এরকম চলতে থাকল কিছুদিন। তারপর একদিন পরীক্ষা করে দেখা গেল তার ল্যারেনজিয়াল ক্যান্সার হয়েছে। অপারেশন করে বাদ দিতে হবে ‘ভয়েস বক্স’। আঁতকে উঠলেন? অর্জুন আর পৃথাও আঁতকে উঠেছিল। কণ্ঠ যার প্রাণ, সেই কন্ঠ যদি কারো বাদ যায়, সে কীভাবে স্বাভাবিক হতে পারে? অপারেশনের পরে আর কথা বলতে পারবে না। কিন্তু শেষমেশ অর্জুন রাজি হয়, রাজি হয় ছেলে টুকাইয়ের জন্য, রাজি হয় পৃথার জন্য। একদিন অপারেশন হয়, কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে অর্জুন।
তার কণ্ঠ যেখানে একলা রাতে অনেকের জীবন বাঁচিয়ে দিত, সে নিজেই তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য ডেকে কথা বলতে পারছে না। এমন অবস্থায় একজন মানুষ কতটা ভালো থাকতে পারে?
‘কন্ঠ’ মুভির পোস্টারে আছে ভূতের রাজার ছবি। কেন? বলুন তো? এটা নাহয় তোলা থাক আপনাদের জন্য।
সিনেমাটা দেখার পরে মনে হবে, প্রতিটি মানুষের কত অজানা গল্প আছে। কত মানুষ প্রতিদিন লড়াই করে চলেছে। এর মধ্যে কিছু মানুষ থাকে, যারা নিজেকে উজাড় করে দেয় অন্যকে ভালো রাখতে। সেই মানুষগুলোর জীবনে যখন কোনো ঝড় আসে তখন কি সবসময় কেউ আসে? একজন ক্যান্সার রোগী মানসিকভাবে কতটা দুর্বল হয়ে পড়ে, সেটা আসলে অনুমান করা বেশ শক্ত। তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ। জয়টা শেষমেশ কার হয়? কেউ জিততে পারে, কেউ পারে না। অনেকে তো আবার জীবনের কাছেই হেরে যায়।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এই ছবি। অর্জুন মল্লিক বা ক্যান্সার রোগী হিসেবে শিবপ্রসাদ অভিনয় করেছেন। তার স্ত্রীর চরিত্রে আছেন পাওলি দাম। আর থেরাপিস্টের ভূমিকায় জয়া আহসান। জয়া কিংবা পাওলির অভিনয় নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় ছিল অনবদ্য। অর্জুন চরিত্রটি তার নিজের সৃষ্টি।
সিনেমার এক অংশে বিদ্রোহী কবিতার আবৃত্তি আছে। এই আবৃত্তি যে কারো রক্তে আগুন ধরিয়ে দিতে পারবে। মনে হবে, অন্য এক জগতে চলে গেছেন।
উইন্ডোজ প্রোডাকশন হাউসের ব্যানারে, এই ছবির পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়। এই জুটির অন্যতম সেরা ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বেলাশেষে’। ‘কণ্ঠ’ মুক্তি পায় ২০১৯ সালে। মুক্তির পর পর দর্শকমনে ব্যাপক জায়গা করে নিয়েছে ছবিটি। ট্রেইলার রিলিজ হবার দিন থেকে শুরু করে সিনেমা হলে আসা পর্যন্ত সবাই ব্যাপক কৌতূহলী ছিল, কেন এরকম পোস্টার। সিনেমাটি দেখলেই সেসব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। সত্যজিতের ভূতের রাজা নন্দিতা-শিবপ্রসাদের কাছে এসে এক নতুন রূপ পেয়েছে, সেটি সিনেমায় এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে, ঠিক যেমন সাহিত্যের বিভিন্ন খুঁটিনাটি কথাবার্তা উঠে এসেছে অনেক সংলাপে।
আমাদের আশেপাশে অনেক এরকম ক্যান্সার কিংবা বড় বড় রোগ থেকে ফিরে আসা মানুষ রয়েছে। বেঁচে ফিরলেও তাদের মানসিক শক্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কমে যায়। কারণ, ক্যান্সার একটি পরিবারের একজনের হলেই সেই পরিবারে নেমে আসে এক আঁধার। রোগীসহ তাদের পরিবারের লোকেদেরও দরকার একটু মানসিক সমর্থন। এ সমর্থন পেলে এই রোগীরা আরো বড় কিছু করতে পারবে। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। সকল ক্যান্সার রোগী জীবন যুদ্ধে জয়ী হোক।
বিদ্রোহী কবি নজরুলের মতো যেন তারা বলতে পারে,
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির।