তিন সিনেমায় ইনারিতুর মৃত্যুকথন

“আমি সিনেমা বোঝাতে বিশ্বাস করি, সিনেমা দেখাতে নয়।
সিনেমা বোঝা আর সিনেমা দেখা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কাজ। সিনেমা দেখে সিনেমা অনুভব করা যায় না, যা সিনেমা বুঝে করা যায়। সিনেমার জন্মই হয়েছে সকলে মিলে একটি সুন্দর অভিজ্ঞতা অর্জনের উদ্দেশ্যে।”
-আলেহান্দ্রো গনজালেস ইনারিতু

পরপর ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দুটি সেরা নির্মাতা ক্যাটাগরিতে অস্কারপ্রাপ্ত আলেহান্দ্রো গনজালেস ইনারিতু ১৬ বছর বয়সে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপরই তিনি নাবিক হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন এবং কার্গো জাহাজে করে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেন। কখনো ইউরোপ, কখনো আফ্রিকা, দিনের পর দিন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়াকে পরবর্তী সময়ে নিজের সিনেমায় কাজে লাগিয়েছেন বলে স্বীকার করেন এই মেক্সিকান নির্মাতা। তিনি মেক্সিকোর এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেন এবং ১৯৮৪ সালে সেই শহরের এক রেডিও স্টেশনে ডিস্ক জকি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

২০০০ সালে আমেরিকা থেকে সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা শেষে, তার অনেকদিনের স্বপ্ন, তিনটি ইন্টারকানেক্টেড সিনেমার প্রথম সিনেমা আমাদের উপহার দেন। নাম আমোরেস প্যাররোস। বিশ্বজুড়ে সুনাম অর্জনের পরে তিনি রূপালি পর্দায় নিয়ে আসেন ২১ গ্রামবাবেল। পূর্ণতা পায় ট্রিলজি। এই তিন সিনেমাকে একত্রে বলা হয় ডেথ ট্রিলজি। ইনারিতুর জৌলুস যদি দ্য রেভেন্যান্ট দিয়ে আসে, তবে তার সিগনেচার কাজ এই ডেথ ট্রিলজি। এই তিনটি সিনেমার গল্প ভিন্ন হলেও তিনটির কাহিনীই গড়ে উঠেছে মৃত্যুকে ঘিরে। সিনেমাগুলো জীবন নিয়ে প্রত্যক্ষ আলোচনাও করে।

আমোরেস প্যাররোস (২০০০)

নিজের শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিকে কাজে লাগিয়ে ইনারিতু তার প্রথম সিনেমায় মেক্সিকো শহরের অলিগলির চিত্র তুলে ধরেছেন রূপালি পর্দায়। সিনেমার শুরুতে মনে হয়, এটি যেন বাকি আট-দশটা মেক্সিকান সিনেমার মতোই। তবে সিনেমা এগোতে থাকলে এর গভীরতায় ডুবে যেতে থাকেন দর্শক। তিনটি ঘটনাকে এক সূত্রে বেঁধে নির্মিত হয় ‘আমোরেস প্যাররোস’। সিনেমার শুরু হয় এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা দিয়ে। এ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করেই গল্পের সূচনা।

‘আমোরেস প্যাররোস’ সিনেমার পোস্টার; Image Source: impawards.com

প্রথম ঘটনা অক্টাভিয়া ও সুজানাকে নিয়ে। সুজানা অক্টাভিয়ার ভাইয়ের স্ত্রী। অক্টাভিয়া আর সুজানা এক হতে চাইলে প্রয়োজন প্রচুর অর্থের। অক্টাভিয়া জড়িয়ে পড়েন কুকুরের লড়াইয়ে আর নিজের পোষা কুকুরকে নিয়ে হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য।

দ্বিতীয় ঘটনায় আছে বিবাহিত ড্যানিয়েল, একজন সফল ম্যাগাজিন প্রকাশক আর ভেলেরিয়া- একজন সফল মডেল। ভেলেরিয়ার প্রেমে মত্ত হয়ে পূর্বের স্ত্রীকে ত্যাগ করে তার কাছে আসে ড্যানিয়েল, কিন্তু ঠিক সেদিনই এক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয় ভেলেরিয়া।

তৃতীয় ঘটনা সাবেক গেরিলা আর একসময়কার ভাড়াটে খুনি এল-ছিবো। এসব চরিত্র এসে এক বিন্দুতে মিলিত হয় আর একজন আরেকজনের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে থাকেন।

এই সিনেমাকে অনেকে বলেন মেক্সিকান পাল্প ফিকশন। কথিত আছে, কান ফিল্ম ফেস্টিভালে যখন এ সিনেমার প্রিমিয়ার হচ্ছিল, ইন্টারমিশন ব্রেকে সব দর্শক উঠে চলে যাচ্ছিলেন। এ দৃশ্য দেখে কানের সমুদ্র সৈকতে ইনারিতু হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলেন, “সিনেমা কি এতই কঠিন বানিয়ে ফেললাম যে কেউই বুঝতে পারছে না?” ওদিকে সিনেমা শেষে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল লোকজন। শেষমেশ তাকে সমুদ্রপাড় থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সিনেমার এমন প্রশংসা দেখে অবাকই হয়েছিলেন নির্মাতা। মূলত এ সিনেমা দিয়েই বিশ্ববাসীর কাছে আলেহান্দ্রো গনজালেস ইনারিতু পরিচিতি লাভ করেন। তার সবচেয়ে প্রশংসিত সিনেমা হলো ‘আমোরেস প্যাররোস’। ২০০১ সালে অস্কারে শুধুমাত্র সেরা বিদেশী চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেলেও বাফটা, কানসহ আরো অনেক পুরস্কার ঝুলিতে নিয়ে আসেন এ নির্মাতা।

২১ গ্রামস (২০০৩)

“তারা বলে, ঠিক মৃত্যুর সময়টাতে আমরা সবাই ২১ গ্রাম ওজন হারাই,
কিছু পয়সার সমান ওজন,
একটি চকলেট বারের সমান ওজন,
একটি হামিংবার্ডের সমান ওজন……”

বলা হয়, মৃত্যুর পরে মানুষের ওজন ২১ গ্রাম কমে যায়। যদিও বিজ্ঞানীরা এ কথার সত্যতা সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন। তবে সেই কথিত বাক্যের আদলেই এ সিনেমার নামকরণ করা হয়। ‘আমোরেস প্যাররোস’-এর জয়জয়কার চারিদিকে, আর তারপরই ইনারিতুর ডাক পড়ল হলিউডে। এবার তিনি হলিউডে বসে মেক্সিকান সিনেমা বানালেন। এ সিনেমাতেও তিনটি গল্প আর একটি দুর্ঘটনা। কিন্তু গল্পের সাথে সময়ের খেলাটা অন্যরকম। কখনো গল্পের চরিত্রের চেয়ে আমরা দর্শকেরা বেশি তথ্য জানি, আবার কখনো চরিত্র বেশি জানে। নোলানেরমেমেন্টো’ সিনেমার পর হয়তো ‘২১ গ্রামস’ নন-লিনিয়ার সিনেমা হিসেবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত। শন পিন, বেনিশিও ডেল টরো এবং নাওমি ওয়াটস– এই তিনজনই সিনেমায় অনবদ্য অভিনয়ের জন্য প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছেন।

‘২১ গ্রামস’ সিনেমার পোস্টার; Image Source: to-hollywood-and-beyond.fandom.com

 

শন পিন হলেন পল, একজন গণিতের শিক্ষক। হৃদরোগে আক্রান্ত তিনি, মৃত্যু যেকোনো সময় দ্বারস্থ হতে পারে। হার্ট-ট্রান্সপ্ল্যান্টের চিন্তায় মগ্ন পলের কাছে তার স্ত্রী আবদার করেছেন, তিনি মা হতে চান; যেন স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন। বেনিশিও ডেল টরো হলেন জ্যাক, যে কিনা এক প্রাক্তন আসামী। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সে তার জীবন ঈশ্বরকর্মে নিয়োজিত করেছে। নিজেকে সকল প্রকার মাদক থেকে দূরে রেখে ঈশ্বরের দেখিয়ে দেওয়া পথে চলতে থাকা জ্যাককে নিয়ে তার স্ত্রী সন্তুষ্ট, তবে তার এই হঠাৎ ঈশ্বরমোহ সন্দেহজনক মনে হতে থাকে। ক্রিস্টিনা চরিত্রে নাওমি ওয়াটসকে প্রথম দেখা যায় একটি মাদক নিরাময় সভার সদস্য হিসেবে। স্বামী ও দুই কন্যাকে নিয়ে একটি সুন্দর ও সুস্থ জীবনযাপনের উদ্দেশ্যেই এ সভার অংশ হওয়া। তবে একটি ঘটনা এই তিন চরিত্রকে একত্রে নিয়ে আসে। শুরুতে গল্পের ধাঁচ বুঝতে কষ্ট হলেও, ধীরে ধীরে রহস্যের সমাধান হতে থাকে।

ব্যাবেল (২০০৬)

বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক, দুই ভাইয়ের মধ্যকার সম্পর্ক, যৌন হতাশা, কূটনৈতিক ছলচাতুরি এবং মৃত্যু; এসবের সংমিশ্রণে নির্মিত সিনেমা ‘ব্যাবেল’। এ সিনেমার গল্পের শুরু মরক্কোর এক মরুভূমিতে। আবদুল্লাহ নামের এক মেষপালকের দুই ছেলে, ইউসুফ  ও আহমেদ। হাসান নামে এক অস্ত্রবিক্রেতার কাছ থেকে রাইফেল কেনা হলো। উদ্দেশ্য, শেয়াল তাড়ানো। হাসানকে এই রাইফেল উপহার দিয়েছিলেন এক জাপানি পর্যটক, যার কন্যা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধকার শিকার। রাইফেলের গুলি কতদূর যায়, সেই পরীক্ষা করতে গিয়ে হাওয়ায় গুলি করে ইউসুফ। তা গিয়ে আঘাত করে দূরে পশ্চিমা পর্যটকদের বাসে ভ্রমণরত সুসানের গলার কাছে। সাথে ছিলেন স্বামী রিচার্ড।

চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ল, পশ্চিমা পর্যটকের ওপর জঙ্গি হামলা হয়েছে! এবার ক্যামেরা ঘুরে চলে যায় সান ডিয়েগোতে, যেখানে সুসান আর রিচার্ডের যমজ সন্তান রয়েছে। সাথে হাউজকিপার এমিলিয়া, জন্মসূত্রে মেক্সিকান। এমিলিয়ার ছেলের বিয়ে। এদিকে সুসান বা রিচার্ডের কারোরই দেখা নেই। তাই তাদের দুই সন্তানকে নিয়েই মেক্সিকো চলে গেল এমিলিয়া। অনুষ্ঠান শেষে ফিরতিপথে হলো বিপদ। মরুভূমিতে হারিয়ে গেল সেই যমজ দুই শিশু।

‘ব্যাবেল’ সিনেমার পোস্টার; Image Source: Film Affinity

 

প্রতিটি চরিত্র, একে অপরের সাথে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। এখানেই ইনারিতুর মুন্সিয়ানা দেখতে পাওয়া যায়। গল্পের ভেতরে একটি মানবিক তাড়না দেখা যায়। শেষ দৃশ্যে জাপানি বাবা-মেয়ের দৃশ্য দর্শকের মনে দাগ কাটতে বাধ্য। ব্র্যাড পিট, কেট ব্ল্যানচেট  ছিলেন মূল ভূমিকায়। এ সিনেমা অস্কারে সাতটি মনোনয়ন পায়। এটিই ‘ডেথ ট্রিলজি’র শেষ সিনেমা।

ভিন্ন ভিন্ন গল্প এক বিন্দুতে এসে মিলিত হওয়াকে বলে ইন্টারলিঙ্কড সিনেমা। ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত নির্মাতা সত্যজিত রায় এ ধাঁচের সিনেমা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন। একজন মেক্সিকান নির্মাতা হিসেবে ইনারিতুই প্রথম, যিনি অস্কারের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ‘বার্ডম্যান’ ও ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ দিয়ে তিনি ঘরে তুলে নেন অস্কার। লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও সাতবার অস্কারে মনোনয়ন পেয়েও, অস্কারজয়ের স্বপ্ন যেন তার স্বপ্নই থেকে যাচ্ছিল। ইনারিতুর হাত ধরে তা বাস্তবায়িত হলো।

সিনেমার পাশাপাশি অনেক শর্টফিল্ম পরিচালনা ও নির্দেশনা করেছেন আলেহান্দ্রো ইনারিতু। তার প্রতিটি সিনেমাই একেকটি নতুন অভিজ্ঞতা। প্রতিটি সিনেমাই জীবনকে ভিন্নভাবে দেখায়। শুধু জীবন নয়, তিনি মৃত্যুযন্ত্রণাকেও পর্দায় গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। মানবিকবোধ সৃষ্টিকারী নির্মাতা ইনারিতু, আমাদের মুগ্ধ করে গেছেন অনেকবার আর একজন সিনেমাপ্রেমীর প্রত্যাশা, তার কাজের মধ্য দিয়ে তিনি যেন আমাদের মুগ্ধ করে যান আরো শতবার।

This article is in Bangla. It is a review of three movies known as 'Death Trilogy' directed by Alejandro Gonzalez Inarritu.

Necessary references have been hyperlinked inside the article.

Featured Image Source: im-media.voltron.voanews.com.

Related Articles

Exit mobile version