পপ-কালচারের দুনিয়ায় সুপারহিরো আর কমিকস বইয়ের অস্তিত্ব খুব সাম্প্রতিক মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও আমাদের কল্পনার জগতে তা মিশে আছে ৮০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। কমিকসের রঙ-বেরঙের পাতায় ফুটে উঠা এই চরিত্রগুলোর সৃষ্টি এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনেও আছে নানা গল্প। কখনো কখনো সে গল্পগুলো মূল চরিত্রগুলোর চাইতে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। যেমনটা আছে ডিসি কমিকসের শ্যাজাম এবং মারভেল কমিকসের ক্যাপ্টেন মারভেলকে নিয়ে।
এই বছরেই মাত্র একমাসের ব্যবধানে এই দুই সুপারহিরোর একক সিনেমা মুক্তি পায়। প্রকৃতপক্ষে দুজন দেখতে সম্পূর্ণ আলাদা, দুজনের সুপার পাওয়ারগুলোও প্রায় ভিন্ন এবং দুজন দুটি আলাদা কোম্পানিরও। কিন্তু এক জায়গাতেই তাদের মিল, তারা দুজনই ক্যাপ্টেন মারভেল!
এই দুই ক্যাপ্টেন মারভেলের গল্পটি বলতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে একদম শুরুতে। গল্পটির শুরু তাকে ঘিরেই যার হাত ধরে আজ সুপারহিরো কমিকস এত জনপ্রিয়। কমিকস জগতে সুপারম্যানের আগেও যে সুপারহিরো ছিল না তা নয়, তবে সুপারম্যানের মত কেউ এতটা সাড়া ফেলতে পারেনি। ১৯৩৮ সালে ডিটেকটিভ কমিকস (যেটা বর্তমানে পরিচিত ডিসি কমিকস হিসেবে) থেকে প্রকাশিত একশন কমিকসের প্রথম ইস্যুর পর থেকেই মূলত কমিকসে সুপারহিরোদের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। যে কারণে সেই সময়টাকে বলা হয় কমিকসের সোনালী যুগ। মাত্র ১৩০ ডলার দিয়ে কিনে নেয়া এই চরিত্রটি এতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, কমিকস ছাপিয়ে সে চলে যায় রেডিও প্রোগ্রামে, অ্যানিমেশনে এবং টিভি শোতে। কিন্তু সিনেমা জগতে প্রথম সুপারহিরো হিসেবে নাম লেখাতে পারেনি সুপারম্যান, তার আগেই সে স্থানটি নিয়ে নেয় সেইসময়ে সুপারম্যানের চাইতেও অধিক জনপ্রিয় একটি চরিত্র!
সুপারম্যানের বিরাট সফলতা অন্যান্য কমিকস প্রকাশনীগুলোকেও উদ্বুদ্ধ করে সুপারম্যানের মত চরিত্র সৃষ্টি করতে। তাই একের পর এক আসতে থাকে স্কাইম্যান, ক্যাপ্টেন ফ্রিডম, দ্য ফ্লেইম, স্টারডাস্ট দ্য সুপার উইজার্ড অথবা গ্যারি কনকর্ড দ্য আল্ট্রাম্যানের মত সুপারহিরো। কিন্তু তাদের কেউই ক্যাপ্টেন মারভেলের মত সফল হয়নি।
ফসেট কমিকস ১৯৪০ সালে উইজ কমিকসের দ্বিতীয় ইস্যুতে এমন একটি চরিত্রের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় যা জনপ্রিয়তার দিক থেকে সুপারম্যানকে হারাতে সক্ষম হয়। সে চরিত্রটি সৃষ্টি করেন লেখক বিল পার্কার এবং আর্টিস্ট সি.সি. বেক। প্রথমে তারা চরিত্রটির নাম দিতে চেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন থান্ডার। কিন্তু সে নামটি আরেকটি প্রকাশনী তখন ব্যবহার করছিল। তাই তারা তাদের চরিত্রটির নাম রাখেন ক্যাপ্টেন মারভেল।
ক্যাপ্টেন মারভেলের কমিকসে আবির্ভাব থেকে পরবর্তী গল্পগুলো ভরপুর ছিল জাদু এবং ফ্যান্টাসির মিশ্রণে। ক্যাপ্টেন মারভেল আদতে ১২ বছর বয়সের বিলি ব্যাটসন। অল্প বয়সেই বাবা-মাকে হারানো বিলি তার অদ্ভুত সব ক্ষমতা পায় শ্যাজাম নামক এক বুড়ো জাদুকরের কাছ থেকে। বিলি যখনই চিৎকার করে জাদুকরের নাম বলত, তখনই তার উপর বজ্রপাত হত এবং সে ক্যাপ্টেন মারভেলে পরিণত হত। তারপর সে শুরু করে দুষ্ট লোকদের হারিয়ে সাধারণ নাগরিকদের রক্ষার মিশন। এখানে ক্যাপ্টেন মারভেল যেন তার পাঠকদেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। কারণ তখনকার কমিকস পড়ুয়াদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল শিশু কিশোর। তাদের মত একই বয়সের বিলি ব্যাটসন জাদুর একটি শব্দ বলে সুপারহিরোতে পরিণত হয়, এই বিষয়টি শ্যাজামের জনপ্রিয়তায় অনেক বড় প্রভাব ফেলে। ততটা কখনোই ফেলতে পারেনি ভিন্ন গ্রহে জন্মানো সুপারম্যান, যে একজন সাংবাদিকের ছদ্মবেশে থাকে। তাইতো উইজ কমিকসের সেই ইস্যুটির ৫ লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়।
ক্যাপ্টেন মারভেলের বাদবাকি চরিত্রগুলোও ছিল অনেক মজার। তার প্রধান শত্রু ডক্টর শিভানা, যে টাক মাথার এক পাগল বিজ্ঞানী। আরো ছিল মিস্টার মাইন্ড, যে আদতে একটি শুঁয়োপোকা এবং কথা বলতে পারা বাঘ টকি টউনি। এদিকে ক্রাইম ফাইটে ক্যাপ্টেন মারভেল কিছু সঙ্গী খুঁজে পায়, যেটাকে বলা হতো মারভেল ফ্যামিলি। সে ফ্যামিলিতে একে একে যোগ দেয় মেরি মারভেল, আংকেল মারভেল, হপি দ্য মারভেল বানি এবং ক্যাপ্টেন মারভেল জুনিয়র, যে এলভিস প্রিসলির প্রিয় একটি চরিত্র ছিল।
ক্যাপ্টেন মারভেল সেই বছরেই সুপারম্যানকে ছাড়িয়ে যায় কমিকস বিক্রির দিক দিয়ে। জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল, প্রথম কমিকস বই সুপারহিরো হিসেবে নাম লেখিয়ে ফেলে সিনেমার পর্দায়। দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ ক্যাপ্টেন মারভেল নামক সিনেমাটি মুক্তি পায় রিপাবলিক পিকচারস থেকে। তবে তারা আগে থেকেই ন্যাশনাল কমিকস (যার একটি অংশ ছিল ডিটেকটিভ কমিকস) এর সাথে কাজ করছিল সুপারম্যানের একটি সিনেমা নির্মাণ করতে। কিন্তু ন্যাশনাল কমিকস প্যারামাউন্ট পিকচারসের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিল সুপারম্যানের এনিমেশন সিরিজটির জন্য। যার কারণে তারা সিনেমার জন্য চুক্তি করতে পারেনি। তাই রিপাবলিক পিকচারস সুপারম্যানের বদলে ক্যাপ্টেন মারভেলকে বেছে নেয়।
কিন্তু ফসেট কমিকস হয়তো সুপারম্যানকে একটু বেশিই অনুকরণ করে ফেলেছিল। ক্যাপ্টেন মারভেলের যতই নতুন ইস্যু প্রকাশিত হতে লাগলো ততই সুপারম্যানের সাথে তার মিল সবার নজর কাড়তে থাকলো।অবশেষে ১৯৪১ সালের জুন মাসে, ন্যাশনাল কমিকস, ফসেট কমিকসের উপর মামলা ঠুকে দেয় কপিরাইট আইন লঙ্ঘনের জন্য। তারপর শুরু হয় ন্যাশনাল কমিকস বনাম ফসেট কমিকসের মধ্যে আইনি যুদ্ধ। দুই পক্ষই বারো বছর ধরে লড়াই করে এই যুদ্ধে, যেটা কমিকস বইয়ের ইতিহাসে সবচাইতে দীর্ঘ। ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরে ন্যাশনাল কমিকস মামলা করলেও সেটা আদালতে যায় ৭ বছর পর।
ডিসির দাবি ছিল ক্যাপ্টেন মারভেলের ক্ষমতা এবং তার বৈশিষ্ট্যগুলো সুপারম্যানের সাথে খুব বেশিই মিলে যাচ্ছিলো, যেটা কপিরাইটের আইনের লঙ্ঘন। অপরদিকে ফসেটের দাবি, যদিও এই দুই সুপারহিরোর মধ্যে মিল আছে, তারমানে এই না যে এটা আইন লঙ্ঘন করেছে। এরকম মিল আরো অনেক কাল্পনিক চরিত্রের মধ্যেই আছে, যেমন টারজান বা পাপায়।
নিজেদের সত্যতা প্রমাণ করতে, ন্যাশনাল কমিকস প্রায় ১৫০ পৃষ্ঠার একটি বাইন্ডার প্রস্তুত করে, যেখানে পাশাপাশি ভাবে সাজানো হয় সুপারম্যান আর ক্যাপ্টেন মারভেল কমিকসের কিছু প্যানেল। সেটাতেই বোঝা যায় ক্যাপ্টেন মারভেল আসলেই সুপারম্যানের কতটা কাছাকাছি। তাদের কস্টিউম থেকে শুরু করে, বুট, কেপ, লাফ দিয়ে অনেক লম্বা দূরত্ব অতিক্রম করার ক্ষমতা, প্রচণ্ড শক্তিশালী, খুব দ্রুত দৌড়াতে পারা এবং তাদের বুলেটে কিছুই হয়না সব কিছুতেই মিল পাওয়া যাচ্ছিল। তারা এটাও দাবি করে যে ক্যাপ্টেন মারভেলের চেহারাও সুপারম্যানের আদলে আঁকা; যদিও বেক মারভেলের চেহারায় ফ্রেড ম্যাকমারেকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
আদালতের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার, কিন্তু সেই মামলায় ফসেট কমিকস জিতে যায় ডিসির একটি ছোট্ট ভুলে। ফসেট কমিকসের আইনজীবীরা দেখতে পেলেন যে ম্যাকক্লেয়ার সিন্ডিকেট, যারা পত্রিকায় সুপারম্যানের কমিকস ছাপাত, তারা সেসব কমিকসে কপিরাইটের চিহ্ন বসাতে ভুলে গিয়েছিলেন। তখন আইনজীবীরা দাবী করেন, আসলে ন্যাশনাল কমিকসের কাছে সুপারম্যানের কোন রাইট নেই। আদালত এ বিষয়ে সম্মতিও জানায়।
এটি ডিসির জন্য বেশ বড় ধাক্কা ছিল। কারণ এর অর্থ হলো, সুপারম্যান ডিসির কোন সম্পত্তি নয়, যে চায় সেই সুপারম্যানকে ব্যবহার করতে পারবে কোন রকম আইনি জটিলতা ছাড়াই। ডিসি তৎক্ষণাৎ আদালতে আপিল করে। যদিও এর মাঝে তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপিলের শুনানি ডিসির পক্ষেই যায়। বিচারক লার্নড হ্যান্ড ঘোষণা দিলেন যে, ক্যাপ্টেন মারভেল কমিকসগুলো অবশ্যই সুচিন্তিত এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই সুপারম্যানের নকল।
১৯৫০ সালের দিকে কমিকসের সোনালী যুগের অবসান হয়। বিশ্বযুদ্ধ পরিবর্তী এই সময়টায় কমিকস বিক্রির হার অনেক কমে গিয়েছিল। তাই ফসেট কমিকস বুঝতে পারলো এই লড়াই চালিয়ে যাওয়া এখন বৃথা। তাই তারা ডিসিকে ৪ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়, এবং পরের বছর মারভেল ফ্যামিলির শেষ একটি ইস্যুর প্রকাশের মধ্য দিয়েই তারা তাদের সব রকমের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। এর ফলে বারো বছর ধরে আদালতে এই দুই পক্ষের লড়াইয়ের অবসান হয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন মারভেলের নয়।
১৯৬০ সালেই ক্যাপ্টেন মারভেল ট্রেডমার্কটির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। যার অর্থ, এখন যে চাইবে সে এই ট্রেডমার্কটি ব্যবহার করতে পারবে। যে কারণে ১৯৬৬ সালে এম. পি. এন্টারপ্রাইজ নামের আরেকটি প্রকাশনী ক্যাপ্টেন মারভেল নামের এক সুপারহিরোর একটি সিরিজ প্রকাশ করে।
এদিকে সেসময়টাতে আরেকটি কমিকস ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যান লি, জ্যাক কার্বি বা স্টিভ ডিটকোর মত মেধাবীদের ছোঁয়ায় এবং স্পাইডার-ম্যান, ফ্যান্টাস্টিক ফোর বা এক্স-ম্যানের কারণে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সেই কমিকস ইন্ডাস্ট্রি প্রথমে পরিচিত ছিল টাইমলি কমিকস হিসেবে। যা ১৯৫১ সালে নাম পরিবর্তন করে এটলাস কমিকস এবং সবশেষে ১৯৬১ সালে মারভেল কমিকস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সেই মারভেল কমিকসের প্রকাশক মার্টিন গুডম্যান ভাবলেন এই ক্যাপ্টেন মারভেল ট্রেডমার্কটি তাদের ব্যবহার করা উচিত। তাই তিনি এম. পি. এন্টারপ্রাইজের কাছে যান তাদের ক্যাপ্টেন মারভেল চরিত্রটি কিনে নিতে। কিন্তু এম. পি. এন্টারপ্রাইজের প্রকাশক মায়রন ফাঁস গুডম্যানের ছয় হাজার ডলারের সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।
গুডম্যান এতে মোটেই সন্তুষ্ট হন নি। তাই তিনি স্ট্যান লি এবং আর্টিস্ট জিন কোলানকে এক প্রকারের বাধ্যই করেন মারভেল কমিকসের নিজস্ব ক্যাপ্টেন মারভেল সৃষ্টি করতে। যার ফলে মারভেল কমিকসে আসে ক্যাপ্টেন মারভেল, যার আসল নাম মার-ভেল। এই ক্যাপ্টেন মারভেল একজন ক্রি সৈনিক, যাকে পৃথিবীতে পাঠানো হয় তাদের একজন সিক্রেট এজেন্ট হিসেবে। কিন্তু মার-ভেল মানবজাতির সাথে মিশে নিজের ভুল বুঝতে পারে, এবং পরবর্তীতে নিজের জাতির সাথে প্রতারণা করে মানবজাতিকে রক্ষা করে।
১৯৬৭ সালে মারভেল সুপার-হিরোজের ১২ তম ইস্যুতে ক্যাপ্টেন মারভেলের প্রথম আবির্ভাবের পর মায়রন ফাঁস ইচ্ছাকৃতভাবে সেই ট্রেডমার্ক ব্যবহার করায়। মারভেল কমিকসের জবাব ছিল, তাদের কাছে ‘মারভেল’ শব্দটি ব্যবহার করার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। এখানে যদি কেউ আইন ভঙ্গ করে সেটা করেছে এম. এফ. এন্টারপ্রাইজ। এই মামলার খুব দ্রুত নিষ্পত্তি হয় এবং এম. এফ. এন্টারপ্রাইজ সাড়ে চার হাজার ডলারের বিনিময়ে ক্যাপ্টেন মারভেলের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়।
মারভেল কমিকসের ক্যাপ্টেন মারভেলও যথেষ্ট শক্তিশালী চরিত্র ছিল। পরের বছরই সে তার নিজস্ব সিরিজ পায়। কিন্তু চরিত্রটি অতটা জনপ্রিয়তা পাচ্ছিলো না। তা নিয়ে কমিকস হিস্টোরিয়ান ডন মার্কেস্টাইন বলেন, “মারভেল আসলে জানতো না তারা এই চরিত্রটিকে নিয়ে কী করবে! তারপরেও তারা প্রতিনিয়ত তার কমিকস প্রকাশ করেই যাচ্ছিল।”
বেশ কয়েকবার ঘষামাজা করে মার-ভেলকে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়। তাকে নতুন স্যুট দেয়া হয়, বেশ কিছু ক্ষমতাও দেয়া হয়। কিন্তু সফলতা আসেনি। তাই তারা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। ১৯৮২ সালে জ্যাক কারবির আঁকা দ্য ডেথ অফ ক্যাপ্টেন মারভেল গ্রাফিক্স নভেলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ক্যাপ্টেন মারভেল।
এখন যদি মারভেল তাদের এই ক্যাপ্টেন মারভেল ট্রেডমার্কটি ধরে রাখতে চায়, তাহলে দুইবছরে অন্তত একবার তাদেরকে ক্যাপ্টেন মারভেলের কমিকস প্রকাশ করতে হবে। তাই তারা পুরনো মার-ভেলের গল্পগুলোই নতুনভাবে লাইফ অফ ক্যাপ্টেন মারভেল কমিকসে প্রকাশ করতে থাকে। মার-ভেলের মৃত্যুর একমাস পরেই মারভেল নিয়ে আসে দ্বিতীয় ক্যাপ্টেন মারভেল মনিকা রেম্বোউকে, যে ছিল নিউ অরল্যান্সের একজন পুলিশ লেফটেন্যান্ট। এরপর তৃতীয় ক্যাপ্টেন মারভেল হিসেবে আসে জেনিস-ভেল, যে মার-ভেলের ছেলে। তারপর আসে চতুর্থ ক্যাপ্টেন মারভেল পাইলা-ভেল, পঞ্চম ক্যাপ্টেন মারভেল Khn’nr, এবং ষষ্ঠ ক্যাপ্টেন মারভেল নোহ-ভার। এই ক্যাপ্টেন মারভেলদের মধ্যে মনিকা রেম্বোউ এবং জেনিস-ভেল ভালই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হচ্ছিলো না মারভেল। কারণ তারা তখনো এমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলো না যে এই ট্রেডমার্কটির জন্য সবচাইতে উপযুক্ত।
অপরদিকে সে সময়টায় অল্প কিছু কমিকস পড়ুয়া বাদে বেশিরভাগ মানুষই ভুলে যেতে বসেছিল একসময়ের জনপ্রিয় ফসেট কমিকসের ক্যাপ্টেন মারভেলের কথা। কিন্তু ডিসি সেটা ভুলেনি। ১৯৭০ এর দিকে ডিসির কমিকস বিক্রি কিছুটা কমে যায় মারভেলের জনপ্রিয়তার কারণে। তা মারভেলের সাথে সমান তালে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ঠিক করে তারা ফিরিয়ে আনবে ১২ বছর বয়সী সুপারহিরো ক্যাপ্টেন মারভেলকে। এদিকে তখন ফসেট কমিকস ১৯৬০ এর দিকে ফিরে এসেছিল ডেনিস দ্য মেনাকের পাবলিশার হিসেবে। কিন্তু সুপারহিরো কমিকস প্রকাশে তাদের হাত বাঁধা ছিল। তখন ডিসি তাদের প্রস্তাব দেয় ক্যাপ্টেন মারভেলের লাইসেন্স তাদের দিয়ে দিতে। ফসেট কমিকস সেই প্রস্তাবে রাজি হয় এবং ক্যাপ্টেন মারভেল আর তার সবগুলো চরিত্র ব্যবহারের সবরকমের অনুমতি ডিসিকে দিয়ে দেয়।
এখন বিশ্বের সবচাইতে বড় দুটি কমিকস প্রকাশনীর কাছেই ক্যাপ্টেন মারভেল নামের সুপারহিরো আছে! কিন্তু ডিসি চাইলেও তাদের ক্যাপ্টেন মারভেলের কমিকসকে ‘ক্যাপ্টেন মারভেল’ নামে প্রকাশ করতে পারছে না। কারণ সে নামের রাইট তখন মারভেলের কাছে। তাই তারা ক্যাপ্টেন মারভেলের কমিকস বের করে ‘শ্যাজাম’ নামে, যে একই নামে একটি টিভি সিরিজও বের হয়। তবে ১৯৭৩ সালে ক্যাপ্টেন মারভেলকে নিয়ে বের করা প্রথম কমিকস সিরিজে ডিসি একটি অদ্ভুত কাজ করে। তারা কমিকসটির নাম দেয়, শ্যাজাম: দ্য অরিজিনাল ক্যাপ্টেন মারভেল ।
কিন্তু মাত্র ১৫টি ইস্যুর পর যখন মারভেল তাদেরকে সতর্ক করে চিঠি পাঠায়, তারা কমিকসটির নাম পরিবর্তন করে রাখে শ্যাজাম: দ্য ওয়ার্ল্ডস মাইটিয়েস্ট মর্টাল। এরপর থেকে ডিসি নিয়মিতভাবেই শ্যাজাম নামেই তাদের কমিকসগুলো প্রকাশ করে। যেমন ১৯৮৭ তে শ্যাজাম! দ্য নিউ বিগিনিং, ১৯৯১ তে দ্য পাওয়ার অফ শ্যাজাম! ২০০৬ এ দ্য ট্রায়ালস অফ শ্যাজাম! এবং ২০০৭ এ শ্যাজাম! দ্য মনস্টার সোসাইটি অভ ইভিল। প্রতিটি সিরিজ যদিও কিছু অল্পসময়ের জন্য জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল, কিন্তু বেশিদিন তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। এদিকে বইয়ের মলাটে শ্যাজাম নামটির কারণে অনেকে ধরেই নিয়েছিল, চরিত্রটির নামই শ্যাজাম।
২০১১ সালে ডিসি কমিকস তাদের পুরো কমিকস জগতটিকেই রিবুট করে, যেটা পরিচিত নিউ ৫২ নামে। তখন সব চরিত্র পাচ্ছিল তাদের নতুন ইস্যু এবং তাদের সাজিয়েও তোলা হয়েছিল নতুনভাবে। তখন ডিসি সিদ্ধান্ত নিলো ,যেহেতু তাকে সবাই শ্যাজাম হিসেবেই চিনে সেটাই তার আসল নাম হোক। এ বিষয়ে জেফ জোন্স বলেন, “শ্যাজাম নামটি চরিত্রটির সাথে বেশ ভালোভাবেই যায়, যদিও অনেক মানুষ জানে এটাই তার আসল নাম।” তাই ২০১২ সালে জেফ জোন্স জাস্টিস লীগের ৭ নং ইস্যুতে অফিশিয়ালি প্রথম ক্যাপ্টেন মারভেলকে শ্যাজাম হিসেবে প্রকাশ করেন।
এদিকে মার্ভেলও তখন খুঁজে পায় সেই চরিত্রটিকে, যে এই ক্যাপ্টেন মারভেল পদটির জন্য সবচাইতে উপযুক্ত। তার নাম ক্যারল ডেনভার্স। কে এই ক্যারল ডেনভার্স? সে একজন অবসরপ্রাপ্ত এয়ারফোর্স মেজর, কেনেডি স্পেস সেন্টারের অবসরপ্রাপ্ত নিরাপত্তা প্রধান, একজন পাইলট যে তিনটি ভাষায় কথা বলতে পারে, অস্ত্র চালনা এবং হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাটেও বেশ পারদর্শী। কমিকসে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় সে একই ইস্যুতে যেটায় মারভেলের প্রথম আবির্ভাব হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে সাইকি ম্যাগ্নেট্রন নামক এক যন্ত্রের বিস্ফোরণে ক্যারলের ডিএনএ মারভেলের ডিএনএর সাথে মিশে যায়। তারপর ক্যারল পায় সুপার পাওয়ার এবং নতুন পরিচয়, মিস মারভেল।
মিস মারভেল থাকাকালীন সময়েই ক্যারল যোগ দেয় অ্যাভেঞ্জারসে। এরপর মিউট্যান্ট রোগের কারণে সব ক্ষমতা হারায়, এক্স-ম্যানে যোগ দেয় আবার হোয়াইট হোলের ক্ষমতা পেয়ে বাইনারী পরিচয় গ্রহণ করে। বাইনারী ক্ষমতা হারানোর পর ক্যারল মিস মার-ভেল পরিচয়ে অ্যাভেঞ্জারসে যোগ দেয়। এরপরেই ক্যারল অসাধারণ জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং মারভেল কমিকসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রথমে মার-ভেলের সাপোর্টিং চরিত্র হিসেবে কমিকসে আসলেও ক্যারল পরে মার-ভেলের চাইতে অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পায়। মারভেল কমিকস তখন বুঝতে পারে, যে চরিত্রটিকে তারা ক্যাপ্টেন মারভেলের জন্য খুঁজছিল, সে তাদের সামনেই ছিল এতদিন। অবশেষে ২০১২ সালে অ্যাভেঞ্জিং স্পাইডার-ম্যানের নবম ইস্যুতে ক্যারল পরিণত হয় ক্যাপ্টেন মারভেল।
প্রায় ৮০ বছর ধরে সুপারহিরোদের জয়যাত্রার শুরু থেকে এই ক্যাপ্টেন মারভেল নামটি চলে আসছে। যদিও সুপারম্যানের সাথে মিল থাকায় এত বছর ধরে লড়তে হয়েছিল, কিন্তু তারপরেও শ্যাজাম সুপারম্যানের উড়তে পারায় এবং লেক্স লুথরের মত শত্রু সৃষ্টিতেও অনুপ্রেরণা ছিল। অপরদিকে মারভেলের ক্যাপ্টেন মারভেল কমিকস এবং অ্যানিমেশনে সফলতার পর রুপালী পর্দাতেও সাড়া জাগাতে পেরেছে।
তো এভাবেই একটি কপিরাইট লঙ্ঘনের মামলা এবং আদালতে ১২ বছর ধরে চলা যুদ্ধ ডিসি কমিকসে শ্যাজাম এবং মারভেল কমিকসে ক্যাপ্টেন মারভেলের জন্ম দিলো।