নিউ ইয়র্কের ওয়েস্ট সাইডে মারিয়া নামের এক পুয়ের্তো রিকান কিশোরী টোনি নামের শ্বেতাঙ্গ এক ছেলে প্রেমে পড়ে। তবে সে প্রেমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পুয়ের্তো রিকান আর শ্বেতাঙ্গ গ্যাংদের মধ্যকার শত্রুতা। মারিয়ার বড় ভাই বার্নারদো আবার পুয়ের্তো রিকান গ্যাং শার্কসদের লিডার, অন্যদিকে টোনি শ্বেতাঙ্গ গ্যাং জেটসদের প্রাক্তন লিডার। এই দুই গ্যাংয়ের মধ্যকার বিবাদ টোনি আর মারিয়ার রোম্যান্সকে প্রায় অসম্ভব করে তোলে। টোনি এসব গ্যাং ভায়োলেন্স থেকে দূরে সরে গেলেও নিজের বোনের সাথে এক শ্বেতাঙ্গের প্রেম বার্নারদো কোনোভাবেই মেনে নেবে না। তার উপর শার্ক বনাম জেট শত্রুতাও চরম পর্যায়ে রূপ নিয়েছে। এই উথালপাতাল বিশৃঙ্খলার মধ্যে বিপরীত বিন্দুর দুই প্রেমিক-প্রেমিকার রোম্যান্সের গল্পই ওয়েস্ট সাইড স্টোরি।
সিনেমার পরিচিতি শুনে যদি আরেক বিখ্যাত রোম্যান্টিক ট্র্যাজেডির কথা মনে পড়ে তবে ভুল হবে না। ১৯৫৭ সালে প্রথমবারের মতো ব্রডওয়ের স্টেজে সদ্য প্রয়াত স্টিভেন সন্ডহাইমের মিউজিক্যাল ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’র যাত্রা শুরু হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত রোম্যান্টিক ট্র্যাজেডি রোমিও এন্ড জুলিয়েট থেকেই অনুপ্রাণিত এই মিউজিক্যাল অসম্ভাব্য এক যুগলের ভালোবাসার গল্প বলে। ইতালির মন্টাগ আর ক্যাপুলেট পার্টির জায়গায় এখানে রয়েছে নিউইয়র্কের পুয়ের্তো রিকান গ্যাং শার্কস আর শ্বেতাঙ্গ গ্যাং জেটস। রোমিও, জুলিয়েটের জায়গায় রয়েছে টোনি, মারিয়া।
শেক্সপিয়রীয় ট্র্যাজেডি হিসেবেই বোধহয় ব্রডওয়ের প্রথিত এই মিউজিক্যালকে সঠিকভাবে বর্ণনা করা যায়। ঘৃণা ও শত্রুতার মতো মানবতার নীচতম প্রকৃতি থেকে সৃষ্টি হওয়া বিদ্বেষ, দ্বন্দ্বের বিপরীত দিকে আছে নিরীহ, বিশুদ্ধ ভালোবাসা। বিদ্বেষে আক্রান্ত কঠিন পৃথিবীতে টোনি আর মারিয়ার ভালোবাসাকে নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা মনে হয়। জায়গা দখল, নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাকে সময়ের বেশি উপযুক্ত ব্যবহার মনে করা হয় ভালোবাসার চেয়ে। সেই কর্তৃত্বের লড়াই যে শুধু ঘৃণা আর গোঁড়ামি থেকেই উৎপন্ন আর ভালোবাসা যে ঠিক তার বিপরীতে এটা মনে করিয়ে দেয়াই ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’র মূল প্রতিপাদ্য।
শার্কস আর জেটসদের শত্রুতার ব্যাকড্রপে এই রোম্যান্টিক ট্র্যাজেডি প্রথমবারের মতো বড় পর্দায় হাজির হয় ১৯৬১ সালে। জেরোম রবিন্স এবং রবার্ট ওয়াইজ পরিচালিত এই এডাপ্টেশন ১৯৬২ সালের একাডেমি এওয়ার্ডে ১১টি অস্কার নমিনেশন এবং ১০টি অস্কার লাভ করে। সর্বকালের সবচেয়ে সমাদৃত মুভি মিউজিক্যালের মুকুট এখনো পর্যন্ত এই মুভিরই। গত বছর খ্যাতিমান পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ বড় পর্দার জন্য আরেকবার এডাপ্ট করেন এই মিউজিক্যাল। গল্পের মূল আবেদন ধরে রাখার পাশাপাশি স্পিলবার্গ বর্তমান কালের জন্য যথেষ্ট উপযুক্তভাবে তুলে ধরেছেন এই কিংবদন্তি মিউজিক্যালকে। বলা যায় ’৬১ সালের মাস্টারপিসকে অনেকাংশেই অতিক্রম করে গিয়েছে নতুন এই সংস্করণ।
কিছু সিনেমা দেখলে অনুভব করা যায় এখানে বিশেষ বা অসাধারণ কিছু আছে। আপাতদৃষ্টিতে একদমই মামুলি এক প্রেমের গল্পকে বিশেষ কিছুতে পরিণত করার জন্য যেরকম পরিচালকের প্রয়োজন হয় স্টিভেন স্পিলবার্গ সেই ‘গ্রেট’দের একজন। তার সেই গ্রেটনেস এই সিনেমায় স্পষ্টভাবেই লক্ষণীয়। প্রতিটা ফ্রেমে, প্রতিটা ডায়লগে রয়েছে এক অভিনবত্ব। ক্ল্যাসিক এই গল্পের মাঝেও স্পিলবার্গ নিজের ওস্তাদি দেখানোর প্রচুর জায়গা খুঁজে নিয়েছেন। স্পিলবার্গ বললেই সবার আগে যে ক্যামেরার কারসাজি চোখে ভাসে, সেই কারসাজি পুরোদমেই উপস্থিত ছিল এই মুভিতে। সবচেয়ে মুগ্ধকর ব্যাপারটি হলো পরিচালনা আর ক্যামেরার কাজের দক্ষতায় তিনি এই সিনেমাতে ক্ল্যাসিক, ওল্ড হলিউডের একটা আবহ নিয়ে আসতে পেরেছেন। একইসাথে বর্তমানকালের প্রযুক্তির ব্যবহারে সবগুলো লোকেশন, ইফেক্ট পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।
মুভি মিউজিক্যালে অভিনয় অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কথায় কথায় নাচ-গানে মেতে উঠা একটু বেখাপ্পা লাগে যদি না অভিনেতারা সুচারুভাবে উপস্থাপন করতে পারে দৃশ্যগুলো। এদিক থেকে এই মুভি প্রায় নিখুঁত। তেমন একটি পারফরমেনন্সও ছিল না, যেখানে অভিনয়ের খুঁত বের করা যাবে। মারিয়া চরিত্রে নবাগত র্যাচেল জেগলার অপ্রত্যাশিত সুন্দরভাবে এই চরিত্রের সরলতা, রোম্যান্টিকতা তুলে ধরেছেন। এওয়ার্ড সার্কেলে আরিয়ানা ডে’বোসের নাম দেখতে দেখতে প্রত্যাশা অনেকটা উঁচুতে ছিল ডে’বোসের আনিতা থেকে। সব প্রত্যাশা পূরণ করতে সফল হয়েছেন ডে’বোস।
অরিজিনাল মুভিতে রিতা মোরেনো’র আনিতা এখনো পর্যন্ত অতি সমাদৃত সকল দর্শকদের কাছে। সেই রোলকে নিজের করা নেয়াটা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। তবে ডে’বোসের পারফরমেন্স এতটাই শক্তিশালী ছিল যে বেস্ট সাপোর্টিং এক্ট্রেসে হিসেবে তিনি খুবই পুরস্কারের দাবিদার। এছাড়াও টোনি চরিত্রে এনসেল আলগোর্ট, রিফের রোলে মাইক ফাইস্ট, বার্নারদো রোলে ডেভিড আলভারেজ সবাই অসাধারণ কাজ করেছেন। নিজের নিজের জায়গায় প্রশংসনীয় স্ক্রিন প্রেজেন্স ধরে রাখতে পেরেছেন সবাই।
‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’র মতো বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন বা সংস্কার আনতে যাওয়া অতি সাহসিক কাজ যা সফলভাবে নিষ্পন্ন করা প্রায় অসম্ভব। এটার প্রধান কারণ অরিজিনাল মিউজিক্যালটা নিজেই প্রায় নিখুঁত। তবে সময়কালের ভিত্তিতে ষাট-সত্তর দশকে অনেককিছুই পর্দায় দেখানো সম্ভব ছিল না, অথবা দেখানো গেলেও সামাজিক অনেক দিককেই কিছুটা ইঙ্গিত করা যেত পরিপূর্ণভাবে বিশ্লেষণ করার জায়গায়। ‘পরিবর্তন’ বা ‘সংস্করণ’ বলতে স্পিলবার্গ কেবলমাত্র এই কাজগুলোই করেছেন। বর্ণবাদ, জেন্ট্রিফিকেশন, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের মতো বিষয়গুলো এসেছে খোলাখুলিভাবেই। যেখানেই যা পরিবর্তন এনেছেন সবই গল্পকে আরেকটু সমৃদ্ধ করার জন্য, আরেকটু গভীরতা আনার জন্য। এককথায় অরিজিনালকে ছাপিয়ে আরেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি এই কালজয়ী শিল্পকে।
নৃশংস বাস্তবতাকে তুলে ধরে ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’ আমাদের যেন মনে করিয়ে দেয় যুদ্ধ, লড়াই থেকে শুধুমাত্র রক্তপাতই সম্ভব। সৃষ্টি, সৃজনশীলতার জন্য প্রয়োজন ভালোবাসার, সহানুভূতির। এই মৌলিক বার্তার কারণেই বোধহয় ষাট বছর পরেও এই মিউজিক্যাল আজও প্রাসঙ্গিক।
২০২২ একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’ মোট ৭টি ক্যাটাগরিতে মনোনীত হয়েছে।