বাংলাদেশ আর ১৯৭১। প্রথম শব্দটি ৫ বর্ণের, দ্বিতীয় সংখ্যাটি ৪ অঙ্কের। ভাষা বা সংখ্যাগত কোনো মিল নেই। মিল নেই ছন্দেও। কিন্তু একটির সাথে অপরটি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। একটি যেন অন্যটির পরিপূরক। কিন্তু কী জন্য এ মিল? কেন এই সখ্য? কী হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে?
নানাভাবে তাকে সংজ্ঞায়িত করা যায়, আখ্যা দেওয়া যায়। এত গৌরবময়, এত বেদনাময় অধ্যায় বাঙালির জীবনে আগে কখনো আসেনি। এই একটি বছরের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব বাংলাদেশকে চিনল, জানল এবং বুঝতে পারল। নরম বাঙালি প্রয়োজনে দেশপ্রেমে কী রকম উদ্বুদ্ধ হতে পারে।
স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার জন্য বাংলাদেশের জনগণকে যুদ্ধ করতে হয়েছে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে। এবং অবিশ্বাস্য সত্য হচ্ছে, যুদ্ধবিদ্যায় অনভিজ্ঞ এই বাঙালিই মাত্র নয় মাসে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতা। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অসংখ্য মর্মস্পর্শী, বেদনাদায়ক ঘটনা রচিত হয়েছে। তেমনই একটা ঘটনা হচ্ছে শহীদ আজাদ ও তার মায়ের ঘটনা।
ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য শহীদ আজাদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক রচনা করেন একটি উপন্যাস। নাম ‘মা‘। ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বইটি প্রকাশিত হয়। এটি একটি বাস্তব ঘটনাভিত্তিক উপন্যাস। মুক্তিযোদ্ধা ও নাট্যব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর কাছ থেকে লেখক এই কাহিনীর সন্ধান পান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আজাদ ও তার মায়ের জীবনের সত্য ঘটনা নিয়ে রচিত মর্মস্পর্শী এই উপন্যাসটি প্রচুর পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম স্থান অর্জন করে নেয়।
বিত্তশালী বাবা ইউনুস চৌধুরীর একমাত্র ছেলে মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ। মা সাফিয়া বেগমকে নিয়ে ইস্কাটনের রাজপ্রাসাদতুল্য বাড়িতে সুখেই কাটছিল তাদের দিন। কিন্তু বাবার দ্বিতীয় বিয়ে কালো মেঘ হয়ে আসে জীবনে। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন সাফিয়া বেগম কিছুতেই স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েকে মেনে নিতে পারেননি। তাই আজাদকে নিয়ে ইস্কাটনের বাড়ি ছেড়ে উঠলেন জুরাইনের এক খুপড়ি ঘরে। সেই থেকে শুরু হলো জীবনযুদ্ধ। অভাব-অনটন, দুঃখ-দুর্দশায় কেটে গেল কয়েক বছর। তবু ফিরে যাননি সেই রাজপ্রাসাদতুল্য বাড়িতে। হার মানেননি আজাদ, হার মানেননি সাফিয়া বেগম।
এমনই সময় স্বাধীনতার ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজাদও এর মধ্যে এম. এ. শেষ করেছেন। সারা দেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল মুক্তিযুদ্ধে। দেশমাতৃকাকে রক্ষা করতে আজাদের মনও চাইছে যুদ্ধে যেতে। বারবার এ কথা মাকে বলতে চাইতেন তিনি, কিন্তু পারতেন না। কিন্তু প্রতিনিয়ত বিবেকের দংশনে প্রচণ্ডভাবে জর্জরিত হতেন। তাই একদিন বলেই ফেললেন মাকে। মা কী যেন চিন্তা করলেন। অবশেষে বললেন- ‘‘আমি কী তোকে শুধু আমার জন্যই মানুষ করেছি। এদেশটাও তোর মা। যা দেশটাকে স্বাধীন করে আয়।’’ মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে আজাদ গেলেন মুক্তিযুদ্ধে। শুরু হলো আজাদের নতুন আরেক জীবনযুদ্ধ।
ঢাকার ক্র্যাক প্লাটুনের একজন গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন আজাদ। মুক্তিযুদ্ধের মাঝখানে আগস্ট মাসে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লেন তিনি। হানাদাররা তথ্য জানার জন্য অকথ্য নির্যাতন করত। নির্মম অত্যাচারের মুখেও আজাদ কিছু বলেননি। তখন তার মাকে বলা হয়, ছেলে যদি সবার নাম-পরিচয় বলে দেয়, তাহলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তা শুনে আজাদের মা ছুটে গেলেন আজাদের কাছে। না, ছেলেকে মুক্ত করার জন্য নয়! বরং তিনি আজাদকে বললেন, “বাবারে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য করো। কারো নাম যেন বলে দিও না।” আজাদ তাকে কথা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন জেলের দুর্বিষহ জীবনের কথা, প্রচণ্ড নির্যাতনের কথা। আরও বলেছিলেন, “মা, ভাত খেতে ইচ্ছা করে। দুইদিন ভাত খাই না। কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগে পাই নাই।” আজাদের মা তাকে অভয় ও সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, “কালকে আমি ভাত নিয়ে আসবো।”
কথামতো ভাত নিয়ে গিয়েছিলেনও তিনি। কিন্তু আজাদ চলে গিয়েছিল না ফেরাদের দেশে। আর কখনোই তিনি আজাদকে খুঁজে পাননি। আজাদের মা যাওয়ার পরপরই আজাদকে জেল থেকে সরানো হয়।
তারপর ১৪ বছর বেঁচে ছিলেন সাফিয়া বেগম। প্রতীক্ষায় ছিলেন তার ছেলের ফিরে আসার জন্য। কিন্তু আজাদ আর ফেরেননি। আজাদের শোকে স্বাধীনতার পর যে ক’বছর বেঁচে ছিলেন আর কখনও তিনি ভাত খাননি, হাপাঁনী থাকা সত্ত্বেও শোতেন মাটিতে, মাদুর বিছিয়ে। কারণ তার ছেলে মৃত্যুর আগে জেলে মাদুরে শুতেন। ১৯৮৫ সালের ৩০ শে আগস্ট, মারা যাওয়ার আগেই তিনি বলে গিয়েছিলেন তার কবরের ফলকে পরিচয় হিসেবে লিখতে ‘শহীদ আজাদের মা’। তাই আজও জুরাইনে একটি কবর দেখা যায়। যাতে লেখা ‘মোসাঃ সাফিয়া বেগম, শহীদ আজাদের মা’।
এই কাহিনীকে কেন্দ্র করে আনিসুল হক রচনা করেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘মা’। প্রকাশের পর থেকে এখন পর্যন্ত অনেকগুলো মুদ্রণ হয়েছে। দেশ-বিদেশে অনেক প্রশংসিত হয়েছে। দেশপ্রেমী সকলকে বইটি পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।
বইয়ের নাম: মা || লেখক: আনিসুল হক
প্রকাশকাল: ২০০৩ || প্রকাশক: সময় প্রকাশক
অনলাইনে প্রাপ্তিস্থান: রকমারি