সিনেমা এবং সাহিত্য; দুই স্বকীয় মাধ্যমের একাত্ম হবার একটা দারুণ উদাহারণ ‘লে নোত্তি বিয়াংকে/ হোয়াইট নাইটস’। একজন গ্রেট সাহিত্যিকের টেক্সটকে একজন গ্রেট ফিল্মমেকার ইমেজারিতে অনূদিত করেছেন। ফিওদর দস্তয়েভস্কির একই নামের ছোটগল্প অবলম্বনে সিনেমাটা পরিচালনা করেছেন লুকিনো ভিসকন্তি. ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজমের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তার অভিষিক্ত সিনেমা ‘অবসেশন’ (১৯৪৩)-কেই ‘ইতালিয়ান নিওরিয়ালিস্ট’ মুভমেন্টের প্রথম সিনেমা হিসেবে ধরা হয়। ফ্যাসিবাদি ব্যবস্থা কীভাবে শ্রমিকশ্রেণীকে অপরাধীতে রূপান্তর করে, তা নিয়ে ছিল সিনেমাটা। এবং নিওরিয়ালিস্ট সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি এবং স্টাইল এই সিনেমায় যথাযথই আছে। আভিজাত্য আর বুর্জোয়াব্যবস্থার ক্ষয় তো ভিসকন্তির সিনেমার একটা কমন থিম। তবে ভিসকন্তির ক্যারিয়ারের গতিপ্রকৃতি বুঝতে এই সিনেমা গুরুত্বপূর্ণ।
নিওরিয়ালিস্ট সিনেমা দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা ভিসকন্তি পরবর্তীতে এপিক, ঐশ্বর্যময় সেটিংয়ের গল্পের দিকে ভিড়েন। এবং এই দুই ধরনের মাঝে ব্রিজ হিসেবে কাজ করেছে ‘লে নোত্তি বিয়াংকে’। এই সিনেমাতেও আক্ষরিক অর্থে একটা ব্রিজের গুরুত্ব আছে! তো ব্রিজের কথা বলছি কারণ, ‘হোয়াইট নাইটস’ সম্পূর্ণই স্টুডিওতে ধারণ করা। রোমের সিনেসিটা স্টুডিওতে বিশাল বড় এক সেট বানিয়ে, লিভর্নো শহরের রাস্তাঘাট; দোকানপাট; রেস্তোরা; খাল; ব্রিজ- এসবকিছু রিক্রিয়েট করা হয়েছে! কুয়াশাচ্ছন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড না পাওয়াতে, সেগুলোও হাতে তৈরি করেছেন! এই তথ্যগুলো দিচ্ছি কারণ, ভিসকন্তি যে উচ্চাকাঙ্খী হয়ে উঠছিলেন ধীরে ধীরে সেটা এতে পরিষ্কার। কিন্তু নিওরিয়ালিস্ট সেন্সিবিলিটি তিনি হারাননি। গোটা সেটকে তিনি যে শহরের আদলে তৈরি করেছেন, যে লোকালয় তৈরি করেছেন- তাতে শ্রমিকশ্রেণী এবং তাদের সংগ্রামের চিত্র কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ডে আছেই। এখানেই ভিসকন্তি তার নিওরিয়ালিস্ট টাচ দিয়েছেন।
এই গল্প মূলত দুটি নিঃসঙ্গ প্রাণের। একজন মারিও; তার একাকীত্বের কারণ সে এই শহরে বহিরাগত। নতুন এসেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই খুব বেশি বন্ধু সে তৈরি করতে পারেনি। আর স্বভাবের দিক থেকেও সে অনেকটা অন্তর্মুখী। আর ওদিকে সুন্দরী নাটালিয়া নিঃসঙ্গ, কারণ তার মেজাজী দাদীর কারণে কখনো সেভাবে অন্যের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় জড়ানোর সুযোগই হয়নি। সবসময় তটস্থ থেকেছে রক্ষণাত্মক দাদীর ভয়ে। কিন্তু প্রায়শই নাটালিয়া দাদীর অগোচরে রাতে রাতে বেরিয়ে পড়ত, এই শহরটা ঘুরে দেখতে। তো এই নাটালিয়ার সাথে মারিওর দেখা হয়েছিল ব্রিজের উপরে। সেই ব্রিজ, যেটা সিনেমায় ঘুরেফিরে আসে। শহরের সেন্ট্রাল ব্রিজ। কনকনে শীতের সেই রাতে, নাটালিয়াকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায় মারিওর। পড়ে যায় প্রেমে।
সেই ব্রিজে নাটালিয়া অপেক্ষা করছিল তার প্রেমিকের জন্য। তাদের ঘরে ভাড়ায় উঠেছিল এক আগন্তুক। তারই প্রেমে পড়ে নাটালিয়া। আগন্তুকও পড়ে। কিন্তু তাকে চলে যেতে হয় কোনো এক কারণে। কথা দিয়েছিল এক বছর পর ফিরবে। এক বছর হয়ে গেছে, কিন্তু প্রেমিক ফেরে না। এই নিয়ে বিষাদগ্রস্ত নাটালিয়া। আর তখন, ভগ্ন হৃদয়ের নাটালিয়ার খুঁটি হয় মারিও। দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে প্লেটোনিক ভালোবাসা। কিন্তু নাটালিয়া তার দ্বন্দ্ব থেকে স্থির হতে পারে না। স্থিরতা যখন আসে, তখনই অকস্মাৎ ফিরে আসে সেই আগন্তুক! মারিওর উবে যাওয়া একাকিত্বকে আবার ফিরিয়ে আনতে। এক অমোঘ মুহূর্তের সূচনা করতে।
দস্তয়েভস্কির গল্প থেকে ফার্স্ট পারসন ন্যারেটিভ ফেলে দিয়ে, মেয়ের চরিত্রকে আরো দ্বন্দ্বমুখর করে এবং সমাপ্তিকে আরো বিষাদময় করে এক অপূর্ব সিনেম্যাটিক টেক্সচার দিয়েছেন ভিসকন্তি। অতি সূক্ষ্মভাবে নিওরিয়ালিজমের টাচ তো আছেই, তবে সবচেয়ে গাঢ় হয়ে আছে আমেরিকান মেলোড্রামার আবেদন। এর ফলেই তো সমাপ্তিটা ওমন হৃদয় নিংড়ানো হয়েছে। শুধু সেট কিংবা সেটিংয়ে নয়, সামগ্রিক বাতাবরণে একটা থিয়েট্রিক্যাল ভাইব এতে রেখেছেন ভিসকন্তি। থিয়েটারের ভাইব তার সিনেমায় বরাবরই থাকে। কারণ তিনি নিজেও তো মঞ্চ পরিচালনা করেছেন। তাই মঞ্চ আর সিনেমা- দুটোর মাঝের মেলবন্ধন গাঢ়ভাবেই রেখেছেন এই সিনেমায়। গোটা শহরকে তিনি ব্যবহার করেছেন সিনেমা এবং মঞ্চের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ককে তুলে ধরতে। সিনেমাকে বাস্তবিক করে তোলার চেয়ে অলীক বা ইলিউসিভ করে তুলতে চেয়েছেন বেশি। এবং সেক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে সেই ব্রিজ।
খালের উপর অবস্থিত সেই ব্রিজ শুধু আক্ষরিক ব্রিজ নয়, বরং বাস্তবতা আর কল্পনার মাঝেই ব্রিজ হিসেবে কাজ করে এটি। দুই বিষয়েই, ব্রিজটি দারুণ এক প্রতীকী রূপ পেয়েছে। মারিওর ক্ষেত্রে, শেষের আগ অব্দি গোটা জার্নিই তো একরকম মায়াময় বিভ্রম হিসেবে ফাংশন করে। সেট ডিজাইনেও এই ব্যাপারটায় জোর দেওয়া হয়েছে। মারিও যেখানে থাকে, সেখানে জীর্ণ বাস্তবতার ছোঁয়া অনেক বেশি। আবার নাটালিয়ার ক্ষেত্রে ব্রিজ, তুষারপাত- এসবের স্পেসই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ নাটালিয়া তার মনোজগতে তো একটা ফ্যান্টাসিতেই বাস করছে। বাস্তবের উপর পুরোপুরি তার দখল নেই। তার আবেগও, তার ফ্যান্টাসির জায়গাটাকেই আরো বিশ্লেষণ করে। সেট নির্মাণে তাই দুজনের এই দুই রকম মনোজাগতিক অবস্থানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দুটো জগতের বৈপরীত্যকে ভিজ্যুয়ালি যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা আরো বেশি জাদুকরী। এক্সপ্রেশনিস্টিক লাইটিংয়ের ফলে এই মুড আরো সুস্পষ্টরূপে ফুটে ওঠে। এক্সপ্রেশনিস্টিক লাইটিংয়ের পাশাপাশি নানা ধরনের ড্রামাটিক ইফেক্ট তৈরি করেছেন ভিসকন্তি।
এই ব্রিজ, ছবির মতো সুন্দর খাল, ঝড়ো হাওয়ার শব্দ, কুয়াশা কেটে এগিয়ে যাওয়া কিংবা তুষারপাতের মাদকতাপূর্ণ দৃশ্য; দর্শকমনে রূপকথার অনুভূতি দেয় একরকম। মোহাবিষ্ট হয়ে থাকার মতো এক জগতের অনুভূতি হয়। এবং শেষের ওই মেলোড্রামাটিক টাচ আসলে দর্শককে ফ্যান্টাসি থেকে বাস্তবে নামিয়ে আনার কাজই করে। এই গোটা বাতাবরণটাই যে ফেব্রিকেটেড, সেটা ভিসকন্তি সুস্পষ্টভাবেই বুঝতে দেন। এবং বুঝতে দেবার মধ্যেই একরকম নিগূঢ় রসের স্বাদ তিনি লুকিয়ে রেখেছেন। তবে কল্পকথাময় জগতকে এমন মাস্টারির সাথে ভিসকন্তি তৈরি করেছেন যে, সেটা রীতিমতো জান্তব একটা রূপ পেয়েছে। সেটাই ভিসকন্তি করতে চেয়েছেন। সিনেমাকে বাস্তবের লেন্সে দেখলে কাল্পনিক লাগবে, আবার কল্পনার লেন্সে দেখলে বাস্তবিক লাগবে।
এমন স্বপ্নালু অনুভুতিই তিনি দিতে চেয়েছেন। সেট ডিজাইন, আলো-ছায়ার অনবদ্য বন্টন, ফ্রেমিং এবং কম্পোজিশনে সিনেম্যাটিক স্পেসটাকে ব্যবহার করবার অপূর্ব দক্ষতা; সব মিলিয়ে এক প্যালপ্যাবল বা বলা যায়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোয়ালিটি তৈরি হয়েছে সিনেমাটার! সাথে দুটি নিঃসঙ্গ চরিত্রের সামাজিক অবস্থান, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও বিশ্লেষণ, আকাঙ্ক্ষা; সিনেমার ইন্টারটেক্সুয়াল জায়গাটাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। সাথে, দস্তয়েভস্কির লিটারেরি স্বরকে মার্সেলো মাস্ত্রোইয়ানি এবং মারিয়া শেল এত সহজাতভাবে চরিত্রের মধ্য দিয়ে রূপায়িত করেছেন, সেটা বিস্মিত করে রীতিমতো। তাদের চাহনির গভীরতা অনায়সেই চরিত্রের মনস্তত্ত্বে ঢুকে যেতে দেয়। দর্শককে নিজ থেকে এক্সপ্লোর করতে বরং সহায়তাই করে। এতেই দুজনের ইন্টারপ্লে বহুমাত্রিকতা পেয়েছে।
ভিসকন্তির নিওরিয়ালিজম পরবর্তী এই সিনেমা, নিওরিয়ালিস্ট সিনেমার বাস্তবতাকে অনেকটা ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখেই স্বপ্ন আর কল্পনাকে সামনে ছুটতে দিয়েছে। ভিসকন্তির পরবর্তীর কাজের ক্ষেত্রে এটা তো একরকম পূর্বাভাস হিসেবেই নিজেকে মেলে ধরেছে। তবে সেসবে এমন এক ‘ট্রানসেন্ডেন্ট কোয়ালিটি’ এই সিনেমা যোগ করেছে, যেটাকে খাটো করে দেখবার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। হৃদয়ে অনুনাদ জাগানোর মতোই অপূর্ব এক সিনেমা ‘হোয়াইট নাইটস’।