নূতন: রহস্যময়ী আর লাবণ্যমাখানো এক পুরাতন মুখ

সাদামাটা একটা চেহারা, চোখে-মুখে ছড়িয়ে থাকা একটা সজীবতা; লাবণ্যময়ী বহু পুরাতন সেই নূতন। যেকোনো চরিত্রেই নিজেকে ভালো মানিয়ে নিতেন নূতন। বলা হয়, মাত্র ২০ বছর বয়সেও নিজের বয়স কিংবা সেই সময়ের চাইতে অনেক বেশি পরিপক্বতা ছিল তার অভিনয়ে। বন্দিনীর কল্যাণী কিংবা সুজাতা যেকোনো চরিত্রে প্রাণবন্ত ছিলেন নূতন। দর্শকমনে তাই আজও নূতনের অভিনয় হারায়নি আবেদনময়তা। আজ তাই বলিউডের রূপোলি পর্দার এই অভিনেত্রী সম্পর্কেই জানা-অজানা কিছু গল্প নিয়ে এসেছি তার দর্শকদের জন্য।

নূতন(১৯৩৬-১৯৯১), fantastik India

ভারতের বোম্বের এক মারাঠি পরিবারে ১৯৩৬ সালের ৪ই জুন জন্মগ্রহণ করেন নূতন। নূতনের মা শোভনা সমর্থও একজন অভিনেত্রী এবং পরিচালক ছিলেন, এমনকি নূতনের মাতামহীও। অভিনয়জগতের সাথে তাদের পরিবারের সম্পর্ক বহুদিনের। তাই অভিনয়ের বীজ নূতনের মধ্যে বংশানুক্রমেই এসেছে বলা যায়।

নূতনের অভিনয়ে প্রকাশ পেতো দৃঢ়তা

‘বন্দিনী’তে ভালোবাসা আর কর্তব্যের মধ্যে থাকা সেই দ্বিধাকে সামঞ্জস্যে পরিণত করা অথবা ‘সওদাগর’ সিনেমার নিজেকে কিছুটা হলেও সম্মান দেবার চেষ্টা ফুটে উঠেছে নূতনের দৃঢ় অভিনয়ে। তার অভিনীত চরিত্রগুলোর মধ্যে কোনো তাৎক্ষণিক আবেগী অভিব্যক্তি কিংবা ট্র্যাজেডি প্রকাশ পায়নি, তাতে সবসময়ই ছিল একধরণের আত্মোপলব্ধি, অত্যাচার থেকে আত্মমুক্তি, নব্যতার চিত্রায়ন।

‘সুজাতা’ সিনেমাটিতে তার অধিকারের লড়াই এর কথাই ধরা যাক, তাতে কি কোনো হার মেনে নেওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল? না, ছিল না। নূতনের অভিনীত চরিত্রগুলোর এটিই বৈশিষ্ট্য। খুব কঠোর কোনো নারী নয়, নারীবাদী এই অভিনেত্রী বেছে নিতেন আমাদের অতি পরিচিত নারীদেরই। কিন্তু তাদের স্থির স্বভাবের সাথে চলমান এক অদ্ভুত প্রতিবাদী চরিত্রও যে আছে- নূতন সেই চরিত্রগুলোকেই নিজের মধ্যে ধারণ করতেন। লাবণ্য মাখানো সেই মিষ্টি মুখটা যখন ঠোঁট টিপে রুখে উঠতো নিজের অধিকারের জন্যই, পর্দায় বেশ মানিয়ে যেতো তাকে! ‘সোনে কি চিড়িয়া’ সিনেমায় শোষিত সেই অভিনেত্রীর মাঝে দর্শকেরাও কি ধরতে পারেনি পর্দার বাইরে আর ভেতরের পার্থক্যটুকু?

দেবানন্দের সাথে নূতন, youtube

পর্দায় আরেক জুটি রাজ কাপুর-নূতন, youtube

পর্দার বাইরের জীবন

১৯৫৯ সালে নূতন ও লেফটেন্যান্ট-কর্ণেল রজনীশ বেহল বিয়ে করেন। বৈবাহিক বন্ধনে খুব বিশ্বাস করতেন নূতন। তার মতে যেভাবেই হোক বিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয়। তাই তার বৈবাহিক জীবনে কোনো সমস্যা ছিল কিনা অথবা তিনি সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট ছিলেন কিনা এটি নিয়ে তিনি জনসমক্ষে কোনো মন্তব্য প্রকাশ করেননি। তবে নূতন ঘোষণা দিয়েছিলেন যে বিয়ের পর তিনি আর অভিনয় করবেন না। কিন্তু তার স্বামীর জোরাজুরিতেই নূতন একেবারে অবসর নিয়ে নিতে পারেননি।

যখন বিমল রায় তার ‘বন্দিনী’ সিনেমা নিয়ে নূতনের কাছে গেলেন, নূতন তাতে অভিনয় করতে রাজি হলেন না। এদিকে পরিচালকও জেদী! নূতন হ্যাঁ না বললে ছবিই করবেন না বলে দিলেন বিমল রায়। এরপর ‘বন্দিনী’ রক্ষায় এগিয়ে এলেন খোদ রজনীশ। নূতনকে তিনি অনুরোধ করলেন অন্তত স্ক্রিপ্টটি পড়ে দেখতে। স্ক্রিপ্ট ভালো লেগে যাওয়ায় তিনি আর না করলেন না। তাই দর্শকদের বোধহয় রজনীশের কাছে কৃতজ্ঞ হওয়াই উচিত সেই নূতনকে ‘বন্দিনী’র মধ্য দিয়ে আবার রূপোলি পর্দায় ফেরত দেবার জন্য! পুত্র মণীশ বেহলকে খুব ভালোবাসতেন নূতন। মণীশও তার মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই অভিনয়জগতের ছোট ও বড় পর্দায় অভিনয় করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে বলিউডের অভিনেত্রী কাজল দেবগান এই নূতনেরই উত্তরসূরী।

পুত্র মণীশের সাথে নূতন, indiatimes

নূতনের অভিনয়জীবন

১৯৫০ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ‘হামারি বেটি’ সিনেমার মধ্য দিয়ে অভিনয়জগতে পা রাখেন নূতন। পরিচালনায় ছিলেন তার মা শোভনা সমর্থ। এরপর ঠিক কখনও থেমে থাকেননি নূতন। ১৯৫১ সালে ‘নাগিনা’ ও ‘হামলোগ’ এই দুটিতে অভিনয় করেন তিনি। ‘ছাবিলি’ সিনেমায় নূতন শুধু অভিনয়ই করেননি, তার মোহনীয় কণ্ঠে গেয়েছেন গানও! এই সিনেমার মূল চরিত্রে ছিলেন তিনি। এরপর থেকে মূল চরিত্র হয়েই তিনি অভিনয় করেন আনাড়ি, ছালিয়া, তেরে ঘর কে সামনে, সরস্বতীচন্দ্র, অনুরাগ ও সওদাগর সিনেমায়।

সেরা অভিনেত্রী হিসেবে পাঁচটি ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার রয়েছে নূতনের ঝুলিতে। যে চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন সেগুলো হলো- সীমা (১৯৫৬), সুজাতা (১৯৫৯), বন্দিনী (১৯৬৩), মিলন (১৯৬৭), মে তুলসী তেরে আঙ্গান কে (১৯৭৮)। ১৯৮০ সাল থেকে মৃত্যুর আগ অবধি তিনি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় শুরু করেন এবং এরপর আর কোনো চলচ্চিত্রে তাকে মূল চরিত্রে দেখা যায়নি। ‘নাম’, ‘মেরি জাং’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় তাকে মায়ের ভূমিকায় দেখা যায়। ‘মেরি জাং’ সিনেমা দিয়েই নূতন তার জীবনের ষষ্ঠ ও সর্বশেষ ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার অর্জন করেন সেরা পার্শ্ব-অভিনেত্রী হিসেবে।

প্রাণবন্ত একটি মুখ, filmfare

তেলেগু ভাষায় একটি ও হিন্দি ভাষায় ৭০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন নূতন। প্রায় চল্লিশ দশক ধরে চলচ্চিত্রজগতে পর্দা কাঁপিয়েছেন তিনি। এছাড়াও ১৯৮৫ সালে ‘মেরি জাং’ সিনেমায় সেরা পার্শ্ব-অভিনেত্রীর খেতাবও পান তিনি।

নূতনের আধ্যাত্মিকতা

ছোটবেলায় প্রতিদিন বিকেল পাঁচটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত নিয়ম করে কাঁদতেন নূতন! ডাক্তার দেখিয়ে লাভ হলো না। পরে এক জ্যোতিষী এসে বললেন এটি কোনো অসুখ নয়। এ এক বিশেষ আত্মা যিনি পুনর্বার জন্ম নিতে চাননি, কিন্তু তাকে ফিরে আসতে হয়েছে অসম্পূর্ণ কাজগুলো শেষ করে যেতে! এও শোনা যায় যে নূতন লেখাপড়া শুরু করবার পরই তিনি নিজে নিজে কারো সাহায্য ছাড়াই ভজন লেখা শুরু করলেন। নূতন কখনও সংস্কৃত শেখেননি, কিন্তু অবচেতনভাবেই তার ভজনগুলোয় দেখা যেত সংস্কৃত শব্দের উপস্থিতি! তিনি এই ভজনগুলো রচনা করতেন, তাতে সুর দিতেন এবং গাইতেনও। তার মা ও বোনের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় যে নূতনের হাত থেকে প্রায়ই ভেসে আসতো চন্দনকাঠের সুগন্ধ!

‘বন্দিনী’ সিনেমায় নূতন, free press journal

এমনই আধ্যাত্মিক কিংবা অলৌকিকতায় ঘিরে ছিল নূতনের জীবন, হয়ত জীবনাবসানও! ১৯৯০ সালে নূতনের স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং এ খবর জানার সাথে সাথে নূতন বলেছিলেন, “আজ আমি মুক্তি পেলাম!” এ কথা থেকে মনে হয় যেন সত্যিই এক অতৃপ্ত আত্মা এসেছিল আর তার কাজ শেষ হবার সাথে সাথে মৃত্যুভয় নয় তিনি পেয়েছিলেন মুক্তির আনন্দ। সত্যি রহস্যময়ী ছিলেন বটে নূতন! এ সকল রহস্যকে সাথে করে মুক্তির এ আনন্দ নিয়েই ১৯৯১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি নূতন চলে যান জীবনের ওপারে। তখন ‘গরজনা’ নামে তার একটি সিনেমার শ্যুটিং চলছিলো। অভিনয়ে ডুবে থাকা এই অভিনেত্রী অভিনয়ের মধ্যেই যেন ছুটি নিয়ে নিলেন অভিনয়ের এই পৃথিবী থেকে!

তার মৃত্যুর পর তার মা শোভনা বলেছিলেন, “আজ আমার মীরাবাঈ চলে গেল!”

মুক্তিকামী প্রাণ অবশেষে পৃথিবী থেকে মুক্ত হলো ১৯৯১ সালে, anmol faankar

Related Articles

Exit mobile version