১৯২০ সাল। যোদ্ধারা বাড়ি ফিরছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে। যুদ্ধের বর্বরতা কাটিয়ে ওঠেনি অনেকেই, সবকিছু বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। ব্রিটেনের বারমিংহাম শহর থেকে অসংখ্য মানুষ গিয়েছিলো এই যুদ্ধে, কেউ ফিরেছে, কেউ ফেরেনি। ফেরা মানুষদের মাঝে ছিল দ্য শেলবি ব্রাদার্স। বড় ভাই আর্থার, মেঝ টমি, কনিষ্ঠ জনি, এবং মেঝ টমি শেলবির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে চরমপন্থী এই দল। ২০১৩ সালে বিবিসি সিরিজটির প্রথম সিজন বের করে। শেলবি পরিবারের কাহিনী কাল্পনিক হলেও বাস্তবেও ছিল এই পিকি ব্লাইন্ডার্স। সিরিজটি এবং চরিত্রগুলোর বাস্তবিক রুপ নিয়ে কথা হবে আজ।
পিকি ব্লাইন্ডার্সদের পরিচয়
বারমিংহাম শহরে তাদের ঠিকানা। শেলবি পরিবারের হাতে তৈরি এই ক্রিমিনাল গ্যাং। শুরুটা হয় জুয়া খেলা দিয়ে। বুকমেকার (ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতার উপর বাজি গ্রহণ করে যারা) কোম্পানি চালাতো শেলবি পরিবার। পরিবারের বাইরে বিশ্বাসী কয়েকজনকে নিয়ে ছিল তাদের দল দ্য পিকি ব্লাইন্ডার্স। পিকি ব্লাইন্ডার্স নামকরণের পেছনেও একটি সুন্দর ব্যাখা আছে। এই দলের সবাই ক্যাপ পরতো। আর ঐ ক্যাপের PEAK অর্থাৎ অগ্রভাগে থাকতো লুকানো ব্লেড, যা দিয়ে কোনো হাতাহাতির সময় তারা প্রতিপক্ষের চোখে আঘাত করতো। এছাড়াও তাদের পোশাক ছিল অত্যন্ত জাকজমকপূর্ণ। পরনে কালো কোট, পকেটে চেইনঘড়ি, মেয়েদের গলায় রুমাল ও অলংকার। সব মিলিয়ে তারা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।
সিরিজের প্রধান চরিত্র থমাস শেলবি অর্থাৎ মেঝ ভাই টমি, যার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে সব পরিচালনা হতো, সাথে ছিল তার চাচি পলি। টমির জন্যই তারা বারমিংহামের সেরা ক্রিমিনাল গ্যাং হিসেবে পরিচিতি পায়, পুলিশ পর্যন্ত ছিল তাদের হাতে। সিরিজটিতে দেখতে পারবেন কীভাবে টমি শেলবি তার প্রখর মেধার সাহায্যে সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরাশায়ী করে ফেলছে। প্রতিটি মুহূর্ত আপনাকে রোমাঞ্চকর অনুভূতি দেবে।
কিন্তু বাস্তবের পিকি ব্লাইন্ডার্স কারা ছিল? তারাও কি এমন ভয়াবহ ছিল? উত্তর না-ই বলা যায়। বাস্তবে ছিল না কোনো টমি শেলবি, তবে পিকি ব্লাইন্ডার্স ছিল। সিরিজে ১৯২০ সালের পর থেকে তাদের উত্থান দেখানো হলেও বাস্তবে ১৮৯০ থেকে তাদের পদচারণা শুরু। দলের বেশিরভাগই ছিল যুবক। মূলত তাদের রাস্তার গুন্ডা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো। বাস্তবে তারা ছিল অতি ভয়াবহ। ডাকাতি, খুন এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবার মাধ্যমে তাদের নাম চারদিকে ছড়ায়। বাস্তবে তাদের টুপিতে কোনো ব্লেড ছিল বলে মানা হয় না, কিন্তু তারা প্রতিপক্ষের লোকদের চোখ তুলে অন্ধ করে দিত বলে জানা যায়। এই দলে যাদের নাম পাওয়া যায় তারা হলেন হেনরি ফাওলার, আর্নেস্ট বেলস, স্টিফেন মিকহিকি ও থমাস গিলবার্ট।
পিকি ব্লাইন্ডার্সরা বারমিংহামে দশক ধরে রাজত্ব করলেও ১৯১০ সালের দিকে তারা আরেক প্রতিপক্ষ বারমিংহাম বয়েজের কাছে হেরে যায়, যা সিরিজে একটু আলাদা। যেহেতু এটি স্পয়লার ফ্রি একটি রিভিউ, তাই বাকিটা আর এখানে লেখা হলো না। তবে বাস্তবে বারমিংহাম বয়েজের প্রধান বিলি কিম্বার ছিল টমি শেলবির মতো। সে ছিল বুদ্ধিমান ও বেশ দক্ষ। পরবর্তীতে সে ইংল্যান্ডের অন্যতম গ্যাংস্টারে পরিণত হয়। সিরিজের আরেকটি চরিত্র হচ্ছে ডার্বি সাবিনি। তিনিও বাস্তবে একজন নামকরা গ্যাংস্টার ছিলেন। মূলত নতুন গ্যাং এবং পিকি ব্লাইন্ডার্সের নিজেদের কলহের কারণেই তারা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। ১৯২০ সাল নাগাদ তারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় তখন তাদের নাম থেকে যায় তাদের ভয়াবহতার কারণে। সিরিজের পিকি ব্লাইন্ডার্সরা অবশ্য একেবারেই আলাদা, হেরে যাওয়া তারা জানে না।
সিরিজ রিভিউ
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম পর্ব প্রকাশ করে বিবিসি। এ পর্যন্ত সিরিজটির ৫টি সিজন বের হয়েছে। সর্বশেষ সিজন বের হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। প্রতিটি সিজনে এক ঘণ্টা করে ৬টি পর্ব আপনাকে বিমোহিত করবে প্রতি মুহূর্তে। সিরিজটি তৈরি করেছে সেভেন নাইট, প্রথম সিজনের পরিচালনায় ছিলেন অটো ব্যাথার্স্ট এবং প্রযোজনায় ছিলেন কেটি সুইন্ডেন।
অভিনয়ে প্রধান অর্থাৎ টমি শেলবির চরিত্রে রয়েছেন সিলিয়ান মারফি, যিনি ব্যাটমান বিগিন্স ও ডার্ক নাইট রাইজেস এ অভিনয় করেছিলেন। পলি শেলবি চরিত্রে হেলেন ম্যাকরয় এবং স্যাম নেইলকে আরথার চরিত্রে দেখা যায়। বুকমেকারের ব্যবসা ভালোই চলতে থাকে তাদের, কিন্তু সেজন্য তাদের কোনো লাইসেন্স ছিল না। অবৈধ ব্যবসা হওয়ায় তাদের পরিধি কম ছিল। প্রথম সিজনে বিলি কিম্বারের সাথে কিছু ঘটনা থাকলেও মূলত অস্ত্র চুরি নিয়েই বেশি কাহিনী দেখানো হয়। ইন্সপেক্টর ক্যাম্পবেল ও টমি শেলবির মেধার খেলা রয়েছে এখানে, সাথে কিছু রোমান্সও।
সিজন ২ এ এসে ডার্বি সাবিনির দেখা মেলে, তার সাথে আরেক জনপ্রিয় চরিত্র আলফি সলোমনস। ধীরে ধীরে শেলবি পরিবারের ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি পায়, বুকমেকারের বৈধ লাইন্সেন্স, অটোমোবাইল ব্যবসা সব মিলে ব্যবসায়িক দিক থেকে চলে ভালোই। কিন্তু শুধু বৈধ ব্যবসা দিয়ে টমি শেলবির মাথা ঠাণ্ডা রাখা সম্ভব না, তাই এর বাইরেও চলে চমকপ্রদ সব ঘটনা।
একটি সিজন শুরু করলে সেটা শেষ না করে আপনার উঠতে মন চাইবে না। সিজন ৩ ও ৪ এ টমির জীবনে ঘটে কিছু দুঃখজনক ঘটনা, যা সিরিজটিকে নতুন পথে নিয়ে যায়। ১৯৩০ এর দিকে রাজনৈতিক প্রভাব বেড়ে গেলে টমি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু সেটির পেছনেও রয়েছে ব্যবসায়িক কারণ। কারণ ছাড়া টমি শেলবি কিছু করে না, তাতে সামান্য হলেও থাকবে ব্যবসায়িক মনোভাব।
সব মিলিয়ে টমির প্রতিটি কাজ আপনাকে মুগ্ধ করবে। পঞ্চম সিজনে এসে আচমকা মোড় নেয় অনেক কিছু। দেখলে হয়তো পরের সিজন খুঁজতে চাইবেন। একটু অপেক্ষা করতে হবে। আরও দুটি সিজন বের হওয়ার কথা রয়েছে, যার একটির কাজ শুরু হয়ে গেছে। সিরিজটির আইএমডিবি রেটিং ৮.৮, রটেন টম্যাটোজ ৯২% ও রেটিং গ্রাফে ৮.৯। এ থেকেই সিরিজটির জনপ্রিয়তা আঁচ করা যায়। তবে বলে রাখা ভালো, এতে কিছু দৃশ্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এবং অপভাষার ব্যবহারও রয়েছে। তাই পরিবারের সাথে না দেখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যারা ক্রাইম এবং রোমাঞ্চকর অনুভূতি ভালোবাসেন, তাদের এই সিরিজ নিরাশ করবে না।
শেষ করছি সিরিজটির মনোমুগ্ধকর কিছু উক্তি দিয়ে।
This place is under new management, by order of the Peaky Blinders.
– Arthur ShelbyEveryone’s a whore, grace. We just sell different parts of ourselves.
– Tommy Shelby
You can change what you do, but you can’t change what you want.
– Tommy ShelbyHe’ll wake up. Granted he won’t have any teeth left but he will be a wiser man for it.
– Alfie Solomons