সুনীলের অর্ধেক জীবন

পাঁচ বছর আগে এক বৃষ্টি ভরা সন্ধ্যাবেলায় কাকভেজা হয়ে বইটা যখন ঘরে এলো, তখন এক রাতের জন্য তার স্থান হলো চুলার নিচে। তারও আগে কেউ হয়তো তাকে কোনো জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল কোনো এক পুরনো বইয়ের দোকানে। বইটার গায়ে একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরির সিল অন্তত সে স্বাক্ষ্যই দেয়। মানুষের নিউমোনিয়া যেমন ভয়ঙ্কর, বইয়ের নিউমোনিয়া আরো ভয়ঙ্কর। তার সাথে যদি হাইপোথার্মিয়া হয় তাহলে তো কথাই নেই। এক দেশ থেকে আরেক দেশ- কে জানে সে বিশাল কলকাতা শহর থেকে এই ছোট্ট মফস্বল শহর নরসিংদী অবধি আসতে আসতে বইটা এর মধ্যে কখনো বৃষ্টিতে ভিজেছে কি না।

সেদিন বইটা হাতে নিয়ে অবাক হলাম। এদ্দিন ধরে শেলফে শুয়ে বসে থাকতে থাকতে বইটা একটু মোটা হয়ে গেল মনে হয়। লম্বাও তো হয়েছে বেশ। আহা পাঁচ বছর কত দীর্ঘ সময়। 

অর্ধেক জীবন- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়; © মাহমুদুল করিম জিসান

সেই সময়, প্রথম আলো আর পূর্ব-পশ্চিম ট্রিলজির যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চিনে আমরা অভ্যস্ত, তার আসল পরিচয় কিন্তু সেটা নয়। তিনি সুখী হতে চেয়েছিলেন নীরাকে নিয়ে কবিতা লিখে। আমোদিত হতে চেয়েছিলেন বরুনার বুকের মাংসের গন্ধে। জীবনানন্দ ছিলেন তার পথের দিশারী। সুনীলের নিজের জীবন নিয়ে লেখা অর্ধেক জীবন বইটিতে এমন আভাসই দিয়েছেন তিনি।

কবিতা ছিল তার নেশা। সে নেশা লেগে ছিল মনের প্রতিটি কোনায়। নইলে মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যাবে কেন কবিতার টানে? কবিতা ছিল তার আশ্রয়, পাঠক হিসেবে আমরা দেখি কবিতা হয়েছিলও তার আশ্রয়। বিদেশে গিয়ে ক্লান্তিকর, বিস্বাদ আর অর্থহীন দিনগুলো কেটে যেত কবিতায়। একদিন কষ্টগুলো কাগজে মেলে দিয়ে লিখে ফেললেন-

“আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ
এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা!”

সমসাময়িক কবিরা বারবার ঘুরেফিরে এসেছেন বইটিতে। এসেছে কৃত্তিবাস, কবিতা সংঘ আর কফি হাউজের আড্ডা। বইটায় লেগে ছিল ছাপাখানার গন্ধ, বইয়ের দোকানের গন্ধ। বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়; কমলকুমার থেকে বিভূতি-মানিক; বনফুল থেকে সত্যজিৎ- কে নেই!

আহা কি দুর্দান্ত যৌবন কাটিয়েছেন কবিতার সাথে তিনি। বইটার জোর হয়তো সেখানেই। উপন্যাস লিখতে ভয় পেতেন, ভাবতেন- আমি কি পারব? অর্থের জন্য তবুও লিখেছেন দেশ পত্রিকায় নীললোহিত ছদ্মনামে। অর্থাভাব থাকলেও সুনীল কাটিয়েছেন এক বোহেমিয়ান জীবন। সময় পেলেই চলে যেতেন এখানে সেখানে।

বইয়ের পাতার সাথে আমিও যেন ঘুরেছি তার সাথে। দেশভাগের ব্যাপারটা এই বইয়ে ফুটে উঠেছিল রমণীর কাজল ধোয়া চোখের জলের মতো। এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের বাংলাদেশ। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আখ্যান, সমসাময়িক রাজনীতি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, নকশালবাড়ি আন্দোলন, ভারতীয় সমাজ কিছুই বাদ যায়নি। এই বই যেন এক প্যাকেজ, একের ভেতর সব। পড়ার সময় মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল প্রতিটি পৃষ্ঠা।

লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়; Image: risingbd

প্রতিদিন একটু একটু করে পড়েছিলাম বইটা। সেদিন টিউশনে গিয়ে ছাত্রকে অংক করতে দিয়ে এটা পড়া শুরু করলাম। সুনীলও এক জীবনে প্রচুর ছাত্র পড়িয়েছেন। তার সে বয়সটার সাথে আমার এখনকার বয়স মেলানোর চেষ্টা করি। কত আকাশ পাতাল সে হিসাব! 

আমি চোখে দেখেছি কম, কানে শুনেছি আরো কম। আজ পর্যন্ত আমার চোখ বা কানের সামনে কোনো বোমা ফাটেনি। আজ পর্যন্ত বিদেশ যাওয়া দূরে থাক, আধ হাত দূর থেকে কোনো প্লেন দেখিনি। আমার দ্বারা কবিতা, গল্প, উপন্যাস লেখা? কী হাস্যকর! লেফট-রাইট কোনো রাজনীতি করার মতো জ্ঞান-বুদ্ধি-মগজ আমার নেই। ভুল করেও কোনো মিছিলে যাই না।

সুনীলের সময়ে প্রেম ছিল সেলুলয়েডের ফ্রেমের মধ্যে। সময়মতো টিকিট কেটে একটা দেখে ফেলো, এবার চিঠি টিঠি কিছু পাঠিয়ে দাও, ব্যাস হয়ে গেল। আমার নেই মার্গারিটা, গিনসবার্গের মতো কোনো বিদেশী বন্ধু। ভবিষ্যতের খাতায় তাদের তুলে রেখেছি। একটা ফেসবুকীয় আমেরিকান মেয়ে বন্ধু অবশ্য জুটেছিল কিছুদিনের জন্য। পরে একদিন দেখলাম সে নাকি ঢাকা কলেজে পড়ে!

আমেরিকা থেকে এসে ঢাকা কলেজে না হয় পড়া যায়, বা ঢাকা কলেজ থেকে পড়ে আমেরিকায়ও যাওয়া যায়। কিন্তু মেয়ে হয়ে তুমি ঢাকা কলেজে পড়ো কীভাবে জিজ্ঞেস করতেই ব্লক খেলাম। সুনীল বাবুর পায়ের তলায় ছিল সর্ষে, সর্ষের ঝাঁঝে তিনি দৌড়ে বেড়িয়েছেন এখানে সেখানে। আর আমি আমার পা বেঁধে রেখেছি ঘরের কোণে। 

সুনীল; Image: ntvbd.com

এর মধ্যে ছাত্র বলল, আপেক্ষিক তাপ আর তাপধারণ ক্ষমতার মধ্যে সম্পর্ক বের করেছে সে। সহজ হিসাব। বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরাতে হলো ছাত্রের খাতায়। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। আহা, সম্পর্কের নামে কি অবৈধ সম্পর্কই না বের করেছে সে! একটা ধমক দিয়ে বললাম, সারা রাত রামায়ণ পড়ালাম এখন বলছো সীতা কার বাপ! আবার করো।

এমনই করে একটু একটু করে একদিন শেষ করে ফেললাম বইটা। আমরা সবাই কখনো কখনো আমাদের জীবনটা আয়নার সামনে এনে দাঁড় করাই। আয়নাজীবন আর বাস্তব জীবন দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে সমান হলে আমরা ভাবি, চমৎকার! এবার এই জীবনটা বন্দি করে রাখা যাক সোনার খাঁচায়।

তবে সোনার খাঁচার একটা দোষ আছে। বন্দী দিনগুলো কীভাবে কীভাবে যেন খাঁচার ফাঁক গলে পালিয়ে যায়। রবি ঠাকুর নিজেও দুঃখ করেছিলেন এ নিয়ে। উপায় বের হলো- বইয়ের পাতায় যদি তাকে আটকে রাখা যায়, তবে বেচারা অতীতকে আর হাওয়ায় পাখা মেলতে না দিয়েই সেটা জনে জনে পৌঁছে দেওয়া যায়।

সে আটকে থাকা অতীত ভরা বইকে হয়তো ট্রাকে-বাসে করে ছাড়তে হবে দেশ। সে অতীত ভরা বইয়ে হয়তো ধূলো জমবে। কিংবা তার হয়তো ঠাণ্ডা লাগবে বৃষ্টিতে ভিজে। বা সে অতীতভরা বইয়ের আভরণটা কখনো বা যাবে ছিঁড়ে। তাকে হয়তো কেউ হরণ করে নিয়ে যাবে রূপকথার রাজপুত্তুরের মতো। বা বিক্রি করে দেবে চোরাকারবারির মতো। তবে সে থাকবে অক্ষত। তিনশো বিশটি পৃষ্ঠার সাথে সুনীল তার যে জীবনকে কালি দিয়ে লেপ্টে দিয়েছেন, সে জীবন জীবনানন্দের মতো দোয়েলের বা শালিকের নয়। আমি দেখতে পেলাম সে জীবন এক কিশোরের, এক তরুণের, এক ভবঘুরে কবির, এক ব্যর্থ প্রেমিকের, এক পিতৃহীন সন্তানের, এক স্বামীর, এক পিতার, এক কালজয়ী লেখকের, আর এক হতভাগ্য লোকের- যার শেষ আস্ফালন- এটা আমার দেশ নয়! এটা আমার দেশ নয়!

নাম: অর্ধেক জীবন || লেখক: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স || অনলাইনে প্রাপ্তিস্থান: রকমারি 

This article is a review of Ordhek Jibon by Sunil Gangapadhyay

Featured Image: Mahmudul Karim

RB-SM

Related Articles

Exit mobile version