মেরিল প্রথম আলো ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ডে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা এবং সেরা অভিনেত্রী এই চার শাখায় শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার অর্জন করে নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ-এর চলচ্চিত্র লাইভ ফ্রম ঢাকা। সাদের ডেব্যু ফিল্ম SIFF এবং রটারডাম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মতো প্ল্যাটফর্মে বাজিমাত করে আসলেও সেসময় তাকে নিয়ে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় কোনো শোরগোল হয়নি। যার ফলে নিভৃতচারী ডিরেক্টর আড়ালেই থেকে গেছেন। নির্মাতা সাদ এবং তার চলচ্চিত্র আমাদের আগ্রহ জানিয়েছে কানের (Cannes) অফিসিয়াল সিলেকশন ক্যাটাগরি আন সারতেইন রিগারদে রেহানা মরিয়ম নূর-এর অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের প্রথম কোনো চলচ্চিত্র, কানের অফিসিয়াল সিলেকশন হিসেবে মিডিয়া এবং দর্শক দু’পক্ষই যেন নড়েচড়ে বসেছে। তবে কেউ কেউ জেনে অবাক হবেন যে, তার প্রথম চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই কিন্তু ‘রেহানা’ চরিত্রের যাত্রারম্ভ! রেহানার প্রেমিক সাজ্জাদের সাথে শহুরে যাপিত নাগরিক জীবনের গল্পই লাইভ ফ্রম ঢাকা।
২০১৬ সালে সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে লাইভ ফ্রম ঢাকার ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হলেও চলচ্চিত্রটির বাংলাদেশ প্রিমিয়ার হয় ২০১৯ সালে। মেদহীন ও ফোকাসড স্ক্রিপ্টের লাইফ ফ্রম ঢাকার বিশেষত্ব হচ্ছে প্রথম সাড়ে পাঁচ মিনিটেই এই ফিল্ম সাজ্জাদ এবং রেহানার মধ্যকার বিরাজমান সম্পর্কের ব্যাপারে দর্শকদের একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেয়। একই সময়ে গল্পটি সামনে কীরূপ সঙ্কটের সম্মুখীন হবে সে বার্তাও প্রদান করে। অর্থাৎ গল্পের কাঠামো নির্মাণে শুরুতে মোটেও বেশি সময় নেয়া হয়নি। গ্রেইনি ইফেক্টসে ভরপুর প্রায় দেড় ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের লাইভ ফ্রম ঢাকা পুরোপুরি সাদাকালোয় নির্মিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম। হয়তো এর থেকে ভাল অন্য কোনো শিরোনাম এই সিনেমার জন্য হতে পারত না। বরং নিখুঁত এক চলচ্চিত্রের সর্বোপযুক্ত নাম বলতে যা বোঝায়, লাইভ ফ্রম ঢাকা আদতে তা-ই! এখানে যে ঘটনাবলী দৃশ্যমান হয়ে ধরা দেয়, তা ঢাকার স্থবিরতার গল্প নয়। এই গল্প আবহমান যান্ত্রিক শহর ঢাকার। এ গল্প শত শত সাজ্জাদের আকুতির। ঢাকা-জীবনের হতাশাগ্রস্ত এক যুবকের একটুখানি ভালবাসা আর স্বস্তি খুঁজে পাবার প্রয়াস, জীবনের দুঃখ-কষ্ট থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাওয়ার যে স্পৃহা, তা-ই ফুটে ওঠে সাজ্জাদ চরিত্রের মধ্যে। এ চরিত্রটি তার শহুরে জীবনের নানা প্রতিকূলতায় এ শহর ছেড়ে পালাতে চায়। সাজ্জাদ গলা ছেড়ে চিৎকার দিয়ে বলে— “I’m not a prophet; I’m just an ordinary man! I have a limit to endure!”
পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ গ্র্যাজুয়েশন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (IER) থেকে। অতঃপর ‘শিক্ষা’ বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট একজন তার ক্যারিয়ার ফিল্মমেকিংয়ে সুইচ করে প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে উপস্থাপন করলেন আপন শহরের গল্পকে। নগরায়নের সেই হতাশার গল্প বলতে তাকে ক্যামেরায় সাহায্য করেছেন সিনেমাটোগ্রাফার তুহিন তামিজুল। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মে অল্প সংখ্যক চরিত্র ও তাদের উত্থান পতনের যে বিশেষত্ব দাঁড়িয়ে গেছে, তার সাথে এই ফিল্মে যোগ হলো সের্গেই আইজেনস্টাইনের মন্তাজের সফল কিছু প্রয়োগ। বরাবরই সাজ্জাদকে ক্যামেরার পেছন থেকে তাড়া করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে গোটা সিনেমায়। বিশেষ করে যখন সাজ্জাদ তার গাড়ি ড্রাইভ করে। পুরো সিনেমাতে লক্ষ্য করা যায় শহরের প্রতি বিতৃষ্ণা আর পালিয়ে বেড়ানোর অভিপ্রায়। অন্যকে ঠকিয়ে ভাল থাকতে চাওয়া, পারিবারিক বন্ধনের সুতো ঢিলে হয়ে যাওয়া, মিথ্যা কথার শহরে সত্যের ভয়ে লুকিয়ে আশ্রয় খোঁজা, অথবা বিশ্বাস নামক অনুভূতির অসহায় অনুপস্থিতি! ঝঞ্ঝাটের এ শহরের সর্বত্র বিরাজমান দুর্নীতি আর অনিয়ম যেন স্ক্রিন ভেদ করে এসে আমাদের মধ্যে হরর অনুভূতির শিহরণ জাগাতে চায়।
সাজ্জাদ সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটে, স্বভাবতই তার এই দুর্বলতা তাকে গতানুগতিক চাকরির চিন্তাভাবনা থেকে দূরে রাখে। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ আর পৈতৃক সম্পত্তিই তার সম্পদ। গার্লফ্রেন্ড রেহানার সাথে চলে তার সার্বক্ষণিক দ্বন্দ্ব, বাকবিতণ্ডা। প্রতিনিয়ত সন্দেহ কাজ করে সে সম্পর্কে। পজেসিভ বয়ফ্রেন্ডের মতো নজরদারি করতে নিজ গাড়িতে করে অফিসে নামিয়ে দিয়ে যায়। রেহানাকে সাজ্জাদ নিশ্চিতভাবেই ভালবাসে। তবে তার থেকে হয়তো বেশি ভালবাসে সে তার নিজেকে!
যা সিনেমার শেষ দৃশ্যতে আরও স্পষ্টতা পায়। ট্রাভেল এজেন্সির প্রতারণার শিকার সাজ্জাদ, শেয়ার মার্কেটের ধস আর ঋণ পরিশোধ করতে করতে ক্লান্ত, দিনশেষে বাসায় এসে সামলায় মাদকাসক্ত ভাই মাইকেলকে। মাইকেল ড্রাগের নেশায় বুঁদ থাকে। ডোজ নেবার সময় হলে হিংস্র উন্মাদনায় ছুরি ধরে টাকার জন্য। অবাধ্য মাইকেলের মৃত্যুও হয় ঐ ওভারডোজেই। সাজ্জাদ নিজ হাতে দাফন করে আপন ছোট ভাইকে। চরিত্রগুলো এত নিখুঁত! এত সাবলীলভাবে কথা বলে, এক্সপ্রেশন দেয়- যেন সিনেমা ভুলে লাইভ ফ্রম ঢাকাকে চিরচেনা শহরের একান্ত আপন গল্প বলে মনে হয়।
এডিটিং টেকনিকেও নতুনত্ব দেখিয়েছে এই সিনেমা। ছোট ছোট শট খুব সূক্ষ্মভাবে সংকলন করে গল্পের গতিকে ধরে রাখতে পেরেছে। পাশাপাশি শব্দের ব্যবহারে নির্মাতা দেখিয়েছেন অভিনবত্ব। ঢাকাকে উপস্থাপন করতে গিয়ে ঘিঞ্জি পরিবেশ শত শত মানুষের চলাচল আর ট্র্যাফিক জ্যাম দেখানো যে আবশ্যক নয়- তার প্রমাণ দিয়েছেন নির্মাতা। উপরন্তু, স্রেফ আজানের শব্দই ঢাকাকে উপস্থাপন করতে যথেষ্ট, তার জন্য যে জুম-ইন করে বারে বারে মসজিদ বা এর উঁচু গম্বুজ দেখানো লাগে না, কিংবা রেললাইনের শট নিয়েই কেবল জনবহুল জীবন দেখাতে হয় না। অন্যভাবে অ্যাম্বিয়েন্স আর ফলি সাউন্ডের সমন্বয় দিয়ে ভিজ্যুয়ালাইজ করানো যায়, সেই সাক্ষ্যও দেয় লাইভ ফ্রম ঢাকা।
আমার ধারণা, ফিল্মটি দেখে সন্দেহাতীতভাবে সিনেমাবোদ্ধারা একমত হবেন—“This cinema has left a profound mark on film enthusiasts and budding filmmakers, possibly by making a declaration that matters of the soul don’t necessitate hefty budget.” কারণ, মাত্র দশ হাজার মার্কিন ডলার খরচেই একটি শৈল্পিক শহুরে গল্প বলতে পেরেছেন নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। সে গল্প বলায় চোখে পড়ার মতো কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়নি। বরং ত্রুটি বলে যে ভ্রম হতে পারে আমার কাছে তা মনে হয়েছে পরিকল্পিত পরীক্ষণ। উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে, শুরুর দৃশ্যে একটি গলিতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে যখন সাজ্জাদ পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখতে চায়— তার পাওনাদার তাকে অনুসরণ করছে কিনা, তখন ক্যামেরা সে যেদিক দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়, সেদিক থেকে না ঘুরে বরং এন্টি-ক্লকওয়াইজ ঘুরে এসে রাস্তায় সাজ্জাদের ভিউপয়েন্টে দৃষ্টিকে স্থির করে। গলির কথা বলতেই চলে আসে গল্পের চক্র— যে গলি থেকে সাজ্জাদের গল্পের শুরু, সেরকম গলি থেকেই সাজ্জাদ অজানায় মিলিয়ে যায়। সে মিলিয়ে যাওয়াতে কোনো পিছুটান ছিল কি? নাকি ছিল অতীতকে ঝেড়ে ফেলে ঘুণে ধরা শহর ছেড়ে নতুন করে বাঁচতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা!
শেষ শটে রেহানা চরিত্রের অসমাপ্ত সংলাপের মাঝে অন্ধকারে প্রটাগনিস্টের আচমকা মিলিয়ে যাওয়ার ওপেন এন্ডেড এই ফিনিশিং বড্ড কৌতূহল সৃষ্টি করে। অস্ফুট স্বরে তখন মুখ ফসকে বের হয়ে আসে— আহা! এর থেকে তৃপ্তিদায়ক আর কী-ই বা হতে পারত!