আমেরিকান চলচ্চিত্রে বিপ্লব আর তার ফলে একটা বড়সড় পরিবর্তন এসেছিল ৭০ দশকে। সেই নিউ ওয়েব সম্পর্কে তো জানেন অনেকেই। মার্টিন স্করসেজি, ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা, উডি অ্যালেন, ব্রায়ান দে পালমা, পিটার বোগদানোভিচ, জেমস ক্যামেরন, রবার্ট অল্টম্যান; এই মাস্টার ফিল্মমেকাররাই তো নিউ ফিল্মমেকিং মুভমেন্টটাকে আরো ত্বরান্বিত করেছিলেন।
তবে ৭০ দশকের এই স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রবর্তক হলেন রজার করম্যান। ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’, ‘দ্য গ্র্যাজুয়েট’, ‘নাইট অভ দ্য লিভিং ডেড’, ‘দ্য ওয়াইল্ড বাঞ্চ’; এই ক্লাসিক সিনেমাগুলোতে নতুন ফিল্মমেকিং মুভমেন্টের যে সুর ছিল, যে সুর সত্তরে আরো জোরালো হয়েছিল, সে সুর তৈরিই করে দিয়েছিলেন করম্যান। প্যাশনটাকে ধরে রেখে নামমাত্র বাজেট নিয়েই কীভাবে সিনেমা বানাতে হয়, নিজের দূরদর্শিতা আর স্বাধীনতাকে কাজে লাগাতে হয়, তার দৃষ্টান্ত তো করম্যানই স্থাপন করেছিলেন। স্করসেজি, কপোলা, ক্যামেরন, জোনাথন ডেম, জো দান্তে- এদের মেন্টর তিনিই ছিলেন।
রজার করম্যান, এছাড়াও বেশ সুপরিচিত তার ‘পো সাইকেল’-এর জন্য। বিখ্যাত সাহিত্যিক, কবি, সমালোচক এডগার অ্যালান পো’র গথিক ছোটগল্প পর্দায় সর্বোচ্চ সংখ্যক রূপ পেয়েছে করম্যানের হাত ধরেই। এ.আই.পি. প্রোডাকশনের ব্যানারে পো’র গল্প থেকে নির্মিত হয় আটটি সিনেমা; করম্যানকে দিয়েই। এটাই হলো পো সাইকেল। পো’র গল্পের টোনটাই মূলত নিতেন করম্যান। গথিক সেটিংয়ে সাজাতেন। ‘হাউজ অভ আশার’ (১৯৬০) দিয়ে এই সাইকেল শুরু হয়েছিল। ‘দ্য পিট অ্যান্ড দ্য পেন্ডুলাম’ (১৯৬১) হলো এই সাইকেলের দ্বিতীয় সিনেমা। করম্যান পরিচালিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ গথিক হরর সিনেমা।
প্যাথেকালারে নানান রকম রঙ আঁচড়ে পড়ার পর নেম ক্রেডিট দিয়ে আরম্ভ হয় এই সিনেমা। এই রঙগুলোর বিশেষত্ব বুঝতে পারা যাবে সিনেমার ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে। সিনেমার প্রারম্ভিক দৃশ্যে, সাগরে উত্তাল ঢেউ ওঠার মন্তাজও দেখতে পাওয়া যায়। এই শট ব্যবহার করা হয় আরো একাধিকবার, গল্পে আসন্ন ঝড়টা বোঝাতে। একটা সাসপেন্স ডিভাইস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পূর্বাভাস স্বরূপ।
সিনেমার গল্প ষোড়শ শতাব্দীর। আগন্তুক এসে দাঁড়িয়েছে দুর্গের দরজার সামনে। খানসামার বাধা অতিক্রম করে তাকে নিয়ে যেতে এল ক্যাথরিন নামের এক নারী। আগন্তুকের পরিচয়, ফ্রান্সিস বার্নার্ড। সে এসেছে তার বোনের মৃত্যুর খবর শুনে। এই ভূতুড়ে দুর্গের রাজা নিকোলাস মেডিনার কাছে তার বোন বিয়ে দিয়েছে। পৈতৃক সূত্রে এই দুর্গের অধিকারী নিকোলাস মেডিনা। বার্নার্ডের চোখেমুখে সন্দেহ। হঠাৎ করে কোনো রোগ ছাড়াই তার বোন এলিজাবেথ মারা যাওয়ার বিষয়টা অস্বাভাবিক। তাও মৃত্যুর প্রায় ছ’মাস পর সে খবর তাকে দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুর যথাযথ কারণ তাকে নিকোলাস কিংবা তার বোন ক্যাথরিন কেউই ব্যাখ্যা করতে পারেনি। এক দুর্লভ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে গেছে, এতটুকুই তাদের ভাষ্য।
রাতে, খাবারের টেবিলে পারিবারিক ডাক্তার জানাল ভিন্ন কথা। সে মারা গিয়েছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। আরো স্পষ্ট করলে, প্রচণ্ড ভয় পেয়ে। কেন? কীসের ভয়? সবকিছু আরো ঘোলাটে লাগল বার্নার্ডের কাছে। এরপর নিয়ে যাওয়া হলো এই বিশাল দুর্গের আন্ডারগ্রাউন্ডে। এক সুবিশাল টর্চার চেম্বার সেখানে বানিয়ে রেখেছে নিকোলাসের স্যাডিস্ট বাবা।
নিকোলাসের ভাষ্যে, এলিজাবেথ হাজার নিষেধ সত্ত্বেও নিজের কৌতূহলকে জিততে দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে এই চেম্বারে। ধীরে ধীরে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিল। বদলে গিয়েছিল তার আচরণ। এই চেম্বারে থাকা একটি টর্চার ডিভাইস, আয়রন মেইডেনের ভেতরে ঢুকেই তার মৃত্যু হয়েছিল। বার্নার্ডের সন্দেহ দূর তো বৈ, উল্টো গাঢ় হলো। নিকোলাসের মানসিক অসুস্থতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা শুরু করল সে। সবকিছুই কি শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখার অপচেষ্টা? পরিস্থিতি আরো সন্দেহনজক করে তুলতে কিছু ঘটনা ঘটতে আরম্ভ করল, যাকে যৌক্তিকতার দাগে টানা যায় না।
দ্য পিট অ্যান্ড দ্য পেন্ডুলামের শ্রেষ্ঠত্বের কিছু নজির হলো, এই সিনেমা পরবর্তীর হরর সিনেমাগুলোর ভয়ের দৃশ্য তৈরি করায় প্রভাব রেখেছিল। শুধু তা-ই নয়, ইটালিয়ান জিয়ালো হররেও এ সিনেমার প্রভাব আছে অনেক। মারিও বাভার ‘দ্য হুইপ অ্যান্ড দ্য বডি’ (১৯৬৩), দারিও আর্জেন্তোর ‘ডিপ রেড’ (১৯৭৫), ল্যাম্বার্তো বাভার ‘আ ব্লেইড ইন দ্য ডার্ক (১৯৮০) সিনেমা, সবগুলোতেই এ সিনেমার সরাসরি প্রভাব রয়েছে। তা ভয়ের উপাদান ধার নেওয়াতেও আছে, তত্ত্ব অনুসরণেও আছে।
একদম নামমাত্র বাজেটের এই সিনেমা একটা ক্যাসল হাউজ আর কয়েকটি চরিত্র নিয়েই করা। এবং করম্যানের এই সিনেমাগুলোর বাজেট এতই স্বল্প ছিল এই এক দুর্গেই পো সাইকেলের চারটি সিনেমার শ্যুটিং হয়। খুব তাড়াতাড়িই প্রোডাকশন নামানো হতো। কিন্তু গুণগত মানের দিক থেকে সেগুলো অদম্য থাকত। করম্যানের চলচ্চিত্র নির্মাণ দক্ষতা, বুদ্ধিদীপ্ততার সবটাই মিশে থাকত সিনেমাগুলোয়। এই সিনেমার কথাই বলা যাক, রিচার্ড ম্যাথেসনের চিত্রনাট্য গল্পনির্ভর নয়, এক্সটেন্ডেড ফ্ল্যাশব্যাক সিন ব্যবহার করা হয়েছে অন্তিম মুহূর্তে একটা তুমুল নাটকীয়তা তৈরিতে। তার চিত্রনাট্য শুধু আবহের বর্ণনাই দিয়ে যায়নি, সাথে ফ্রয়েডিয়ান তত্ত্ব নিয়ে আলোচনার জায়গায় রেখেছে। ফ্রয়েডের তত্ত্ব মেনে, নিকোলাস মেডিনা চরিত্রটির মনস্তত্ব বিশ্লেষণ করা যায়। নানান যৌনতা বিষয়ক মোটিফ রাখা হয়েছে ফ্রয়েডের তত্ত্ব ব্যবহার করে।
অতীতের পুনরাবৃত্তি, ভিন্ন সত্ত্বার মাঝে নিজের প্রকৃত সত্ত্বাকে হারিয়ে ফেলে দ্বান্দ্বিকতার মুখোমুখি হওয়াতেই ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের ব্যবহার ঘটে। ঘটনাবলি, বিষয়াদি, আবহ; সবকিছুতেই সমৃদ্ধ ম্যাথেসনের চিত্রনাট্য। চমক আর উত্তেজনার জায়গাগুলো একদম খাঁটি। অ্যালান পো’র গল্পের শুধুমাত্র সুরটা টেনে, মূল উপাদানকে দূরে রেখে চমৎকার প্লটলাইন, ক্যাসল, সন্দেহভরা চরিত্র, যৌনতা বিষয়ক মোটিফ, গূঢ় বিষয়, দীর্ঘ নির্যাতনের দৃশ্য- সবকিছু মিশিয়েই উদ্ভাবনী উপায়ে পরিপূর্ণ একটি শক্তিশালী চিত্রনাট্য লিখেছেন ম্যাথেসন।
এবং সেই চিত্রনাট্যকে ততোধিক উদ্ভাবনী উপায়েই নির্দেশনা দিয়ে ক্যামেরায় তর্জমা করেছেন রজার করম্যান। তার কাজ এককথায়, উন্মাদনাপূর্ণ। ইংরেজিতে সঠিক ভাবটা রেখে বলা যায়, ‘ইনটক্সিকেটিং’। গোটা সিনেমাটাকে তিনি, ধীরে ধীরে দুঃস্বপ্নে পতিত হওয়ার মতো করে নির্মাণ করেছেন। ড্যানিয়েল হলারের, পুরাতন দুর্গ আর সমাধিগৃহ সম্বলিত, সেটের নিখুঁত ডিজাইনে সেই দুঃস্বপ্নটা আরো রহসম্যয় হয়ে উঠেছে। ল্যাক্স ব্যাস্টারের গা ছমছমে আবহসঙ্গীতও সেই ভাবটি ধরে রেখেছে।
পানাভিশনের ওয়াইডস্ক্রিন লেন্সে আগের সিনেমা, হাউজ অভ আশারের সিনেমাটোগ্রাফার ফ্লয়েড ক্রসবিকে সাথে নিয়ে করম্যান একটা চাপা জগত তৈরি করেছেন, যেখানে আটকে পড়ার অনুভূতি হয়। ক্রসবি, নানান রঙের ঘূর্ণাবর্তে একটা সাইকেডেলিক ভাবের সৃষ্টি করেছেন। ন্যারেটিভে, জাঁকালো রঙের আভায় মিশ্রিত ওই ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্যগুলো আর সিনেমার শক ভ্যালু দিয়ে করম্যান নির্বাক সিনেমার একটা অনুলিপি হিসেবেও তৈরি করেছেন ‘দ্য পিট এন্ড দ্য পেন্ডুলাম’কে।
সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন কিংবদন্তি ভিনসেন্ট প্রাইস। করম্যানের পো সাইকেলের পাঁচটি সিনেমাতেই তিনি অভিনয় করেছেন। করম্যানের পছন্দের এই অভিনেতা, যিনি কিনা ‘ঘুউল প্রিন্স’ নামেও পরিচিত, তাকে তিনি পুরো স্পেস দিয়েছেন নিকোলাস চরিত্রের দুর্বলতা, অনুশোচনা, ভয় আর পাগলামির পুরো গ্যামাট পূর্ণ করতে। ভীত হওয়া থেকে ভীতিকর হয়ে ওঠা; সবটাতেই প্রাইস অনবদ্য। তার অভিনয় ‘ওভার দ্য টপ’ নয়, বরঞ্চ ওই ওভার দ্য টপটাই চরিত্রের চাহিদা এবং ওটাই স্টাইল। মুখের অভিব্যক্তিকে নিখুঁত করতে চোখ থেকে ঠোঁটের মাঝের পুরো জায়গাটাকেও তিনি ব্যবহার করেছেন। তার শারীরিক ভঙ্গীর প্রখরতাই চরিত্রটির মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার কাজটি সহজ করে। এছাড়া, ইতালিয়ান ‘স্ক্রিম কুইন’ বারবারা স্টিল ঠিক যেন পো’র গল্পের নায়িকার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত বার্নার্ড চরিত্রে জন কে’র অভিনয় প্রদর্শনের সবটুকু স্পেস পাননি। তবে তার দক্ষতা ছিল।
সিনেমার ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যটি, অর্থাৎ নির্যাতনের দৃশ্যটি গোটা সিনেমাকে অন্য একটি মাত্রা দিয়েছে। সেই সময় অনুযায়ী, প্রচণ্ড অভিঘাতপূর্ণ একটি দৃশ্য ছিল।
সুপরিচিত হরর লেখক স্টিফেন কিং তো বলেছেন, ষাটের পরবর্তী হরর সিনেমাগুলোর জন্য এটি একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য। একথার কারণ হলো, ভয়ের উপাদানের ব্যবহার পদ্ধতি এবং গোটা দৃশ্যটার মুন্সিয়ানা। ক্যামেরায় হুইপ প্যান ব্যবহার করে, প্রধান অভিনেতা ভিনসেন্ট প্রাইসের মুখের এক্সট্রিম ক্লোজ আপ নিয়ে আর রঙ পরিবর্তনে তার খল ব্যক্তিত্বের উন্মত্ততাকে ধরার মধ্য দিয়ে ৬০ দশকের হররে ভয় আর উত্তেজনার একটা নতুন সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছিল ‘দ্য পিট অ্যান্ড দ্য পেন্ডুলাম’। করম্যানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমা হওয়ার পাশাপাশি, এটি সময়ের গুরুত্বপূর্ণ হরর সিনেমা হয়ে রয়ে গেছে আজো।