ইতিহাসনির্ভর থ্রিলার বা উপন্যাস লেখার চেষ্টা আজকাল অনেকেই করছেন। এই ঘরানার চমৎকার এক দৃষ্টান্ত হিসেবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ এ প্রকাশিত হয়েছে ‘ধনুর্ধর‘। লেখক, সিদ্দিক আহমেদ।
গল্প পরিচিতি
ধনুর্ধর এক হারানো কালের গল্প। মূলত কোশল ও পাঞ্চাল নামে দুটি রাজ্যের এক তীব্র যুদ্ধের উপাখ্যান। স্বাভাবিকভাবেই, গল্পে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে কোশল ও পাঞ্চালের রাজা।
গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছে রুদ্রদামা নামে এক তরুণ। তরুণের পিতৃপরিচয় থেকেও নেই। কারণ, তার বাবা উঁচু জাতের হলেও মা নিচু জাতের। রুদ্রদামা তাই বেড়ে উঠেছে বাবা থেকে অনেকটা দূরে। বাবার পরিচয় লুকিয়ে। যারা জানত, তারা সেই পরিচয় শুনিয়ে, খোঁচা দিয়ে ওর বুকের ক্ষতটা কেবল বাড়িয়েছে। এই গল্পে রুদ্রদামা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তার বাবা মূলত কোশলের প্রধান সেনাপতি।
কোশলের প্রধানমন্ত্রী সেনাপতির বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। ধীরে ধীরে বিশ্বাসঘাতকতা মাথা চাড়া দিচ্ছে কোশলের রাজ-অন্তঃপুরে। সেনাপতি সুধামাকে ভীত রাজা কড়া নির্দেশ দিয়েছেন রাজধানীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। অথচ সেনাপতি সব ফেলে চলে গেছেন সীমান্তে। কেন?
দীর্ঘদিন এক গুরুর কাছে সমরবিদ্যা শিখেছে রুদ্রদামা। শিখেছে তীর চালানো। শিখেছে, শব্দ-বেধ ও চল-বেধ ব্যবহার করে কীভাবে লক্ষ্যভেদ করা যায়। শব্দ-বেধ মানে, শব্দ শুনে লক্ষ্যভেদ করার জ্ঞান। আর চল-বেধ মানে, গতিশীল অবস্থায়, প্রয়োজনে গতিশীল লক্ষ্য ভেদ করার জ্ঞান। কিন্তু আজ গুরু বলছেন অন্য কথা। বলছেন, লক্ষ্যভেদ করার আরো এক উপায় আছে। কী সে উপায়?
গুরুদেব বহিষ্কার করলেন রুদ্রদামাকে। কেন?
দুই দেশের ভয়ংকর এই যুদ্ধে রুদ্রদামার মতো এক পিতৃপরিচয়হীন ধনুর্ধরের ভূমিকা কী? কে জিতবে এই যুদ্ধে? কোশল, না পাঞ্চাল? পাঞ্চালের রাজা কোশলকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে। আক্রমণ করছে না। কিসের যেন অপেক্ষা করছে সে। কিসের?
এই সব প্রশ্ন, এত সবকিছুর চমৎকার উত্তর পাওয়া যাবে ধনুর্ধর-এ।
ইতিহাস বনাম ধনুর্ধর
মূল ইতিহাসে ‘অভিরাজা’র কথা পাওয়া যায়। এই অভিরাজা ছিলেন প্রাচীন সাম্রাজ্য কোশলের যুবরাজ। কোশল ও পাঞ্চালের যুদ্ধের গল্পও পাওয়া যায় ইতিহাসে। পরবর্তীতে অভিরাজা তাগায়ুং সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। বর্তমানে এটিই বার্মা। ইতিহাসের পরিণতি কী হয়েছিল, সেটা সরাসরি বললে গল্পের মজা কিছুটা নষ্ট হবে। এ প্রসঙ্গ আগ্রহী তাই পাঠকের জন্য তোলা রইল।
স্বাভাবিকভাবেই, ইতিহাসে রুদ্রদামা প্রায় অদৃশ্য। পিতৃপরিচয়হীন এই মানুষটির কতটা বাস্তব, সেটা বোঝার এমনিতে কোনো উপায় নেই। তবে এ ধরনের একটি চরিত্র ছিল, সেটা ইতিহাস থেকে জানা যায়।
লেখক এখানে সরাসরি ইতিহাস লিখেননি। তিনি একটা গল্প শোনাতে চেয়েছেন। ইতিহাসনির্ভর গল্প। যুদ্ধের গল্প, প্রাচীন গুপ্তচরবৃত্তির গল্প এবং কিছু চরিত্রের পরিণতির গল্প। বেশ সফলভাবে এই কাজটা তিনি করেছেন।
বইতে যেসব কথোপকথন উঠে এসেছে, বিভিন্ন চরিত্রের নানারকম কথাবার্তা- সেসব যে বানানো, তা আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়, মানে অপ্রয়োজনীয় কথোপকথন বইতে নেই বললেই চলে। অর্থাৎ বইটি শুধু বর্ণনানির্ভর নয়। কথোপকথনের ওপরে নির্ভর করেও গল্প এগিয়েছে।
ইতিহাস আর গল্পের মধ্যকার সীমারেখাটা লেখক যেভাবে মুছে দিয়েছেন, সেজন্য তিনি অবশ্যই সাধুবাদ পাবেন।
পর্যালোচনা
গল্প বলার হাত সিদ্দিক আহমেদের ভালো। বেশ সাবলীল ভাষায়, চমৎকারভাবে গুছিয়ে গল্প বলেছেন তিনি। যেটা চোখে পড়ার মতো, তা হলো, কোশল ও পাঞ্চাল- দুই পক্ষের সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকেই যথেষ্ট সময় নিয়ে চিত্রিত করা হয়েছে। চরিত্রদের মস্তিষ্কের ভেতরে পাঠককে ঢোকার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আছে পর্যাপ্ত কথোপকথন। ফলে বোঝা যায়, প্রতিটি চরিত্র কী ভাবছে, কীভাবে ভাবছে।
যুদ্ধের বিশাল কলেবরে নানা জায়গায় বিভিন্ন ঘটনা একসঙ্গে ঘটেছে। লেখক প্রতিটি ঘটনাকে সুন্দর করে মিলিয়েছেন। কোথাও অযথা ছেঁড়া সুতোর মতো কিছু বের হয়ে নেই। অন্তত পাঠকের চোখে পড়বে না।
তবে ভালোর পাশাপাশি চোখে পড়ার মতো কিছু খটকাও আছে। যেমন- গল্পে প্রাচীন ভাব আনার জন্য খটমটে বেশ কিছু শব্দ আমদানী করা হয়েছে। এটা অবশ্যই লেখকের স্বাধীনতা। কিন্তু এ ধরনের এত শব্দ ব্যবহার না করলে গল্প পড়ে যেমন আরাম পাওয়া যেত, তেমনি গল্পের আবহ নির্মাণেও খুব একটা প্রভাব পড়ত না।
এছাড়া, যুদ্ধের ক্ষেত্রে একজন রাজার অধীনে সৈন্য সংখ্যা এত বিশাল, যেমন- তিন লাখ, এটা অতিকল্পনা বলে স্পষ্টই বোঝা যায়। প্রাচীন ভারতে বাস্তব যেসব যুদ্ধ হয়েছে, এর কোনোটিতেই সৈন্য সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়ায়নি। কাজেই, বাস্তবে কোশল-পাঞ্চালের যুদ্ধে তিন লাখ সৈন্য ছিল, এমনটা সম্ভব মনে হয় না।
এছাড়াও গল্পের নায়ককে নায়ক হিসেবে দেখানোর জন্য বেশ কিছু অতিপ্রাকৃত কৌশলে পারদর্শী বলে দেখানো হয়েছে। এটির অবশ্য ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। মন্দ দিক হলো, বাস্তবতা ধাক্কা খায়। তীর বেঁকে গিয়ে ছুটছে – এমনটা বিশ্বাস করতে মস্তিষ্ক সায় দেয় না।
আবার, ভালো দিক হলো, প্রাচীন ভারতীয় ফ্লেভার। প্রাচীন ভারতের সাধুরা শূন্যে ভাসতে পারতেন। ইবনে বতুতা তার ‘ট্রাভেলস অফ ইবনে বতুতা‘ গ্রন্থে এ কথা লিখে গেছেন। কাজেই, ভারতীয় সাধক ও গুরুদেবের কাছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোনো তীরান্দাজ, যে কি না অর্জুনের চেয়েও দক্ষ, এমনটা করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক!
সবমিলে বলা যায়, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, যুদ্ধ, প্রাচীন গুপ্তচরবৃত্তি ও বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে,ধনুর্ধর তাদের হতাশ করবে না।
এবারে চলুন, যার লেখা নিয়ে এত কথা, সে মানুষটির ব্যাপারে একটুখানি জেনে নেওয়া যাক।
লেখক পরিচিতি
সিদ্দিক আহমেদ একজন শিল্পী। শিল্পীর কাজ গল্প বলা, তিনিও তাই করেন। কখনো শব্দের পাশে শব্দ বসিয়ে, কখনোবা ছবির পাশে ছবি বসিয়ে।
মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ব্যবস্থাপনায়। কিন্তু মূল আগ্রহ তার চলচ্চিত্রে। সেই স্বপ্ন থেকেই লেখার শুরু। আর, এই শুরুটা তিনি করেছেন উন্মাদে। বিখ্যাত এই পত্রিকাটির সম্পাদক আহসান হাবীব। তার হাত ধরে এদেশে অনেক চমৎকার লেখক ও আঁকিয়ে তৈরি হয়েছেন। সিদ্দিক আহমেদও তাদের একজন।
গল্প-উপন্যাস ছাড়াও, অন্যান্য গল্প বলার মাধ্যমগুলোতেও কাজ করেছেন সিদ্দিক। গ্রাফিক নভেল থেকে শুরু করে মঞ্চনাটক- বাদ যায়নি কিছুই। সেই ধারাবাহিকতায় লিখেছেন ‘মুজিব’ ও ‘ন ডরাই’ গ্রাফিক নভেলের কাহিনী বিন্যাস ও সংলাপ। তার লেখা ‘ইচ্ছে ডানা’ নামের একটি টিভি নাটক নিউ ইয়র্কের ফর্টিন টেলি অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে।
উপন্যাসের শুরুটা করেছিলেন ‘নটরাজ’ দিয়ে। আর্কিওলজিক্যাল থ্রিলারা ঘরানার সেই গল্পের চরিত্রগুলোকেই আবার ফিরিয়ে এনেছেন পরের উপন্যাস ‘দশগ্রীব’-এ। বইটি প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯-এ।
তার দ্বিতীয় এই উপন্যাসটি যথেষ্ট মনোযোগের দাবীদার। থ্রিলারের সঙ্গে বিজ্ঞান ও রামায়ণের একটা দারুণ সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, হিন্দু পুরাণের এই গল্পটির রিটেলিং করেছেন তিনি। প্রতিটা অলৌকিক গল্পের লৌকিক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন যুক্তিতে ভর করে। আর, এই ব্যাখ্যাগুলো দাঁড় করানোর জন্য যে পরিমাণ তিনি পড়েছেন, সেটা বইয়ের শেষে সংযুক্ত বইয়ের তালিকা দেখলেই বেশ বোঝা যাবে।
দশগ্রীব একটি সিরিজ গল্পের শুরু। এই গল্পের পরের অধ্যায়গুলো আসবে পরবর্তী কোনো বইমেলায়। একইভাবে ধনুর্ধরকেও একটি সিরিজ গল্পের শুরু বলেই ধরে নেওয়া যায়। যদিও বইতে গল্পটির একটি পরিসমাপ্তি আছে। কিন্তু শেষটায় লেখক গল্পের পরবর্তী অংশ আসবে, এমন ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছেন।
এত বিশাল কলেবরে, এত বিশালায়তনের ঘটনাপ্রবাহ ফুটিয়ে তোলার কাজ এই বাংলায় কমই হয়েছে। আর, খাঁটি ইতিহাসনির্ভর কাজ ও রিটেলিং তো হয়েছে হাতে গোণা। নতুন প্রজন্মের তরুণ সাহিত্যিকরা সেই অভাব পূরণে নেমেছেন। বেশ জাঁকিয়ে গল্প বলতে শুরু করেছেন তারা। তৃপ্তিকর সব গল্প। আমাদের ইতিহাস। আমাদের মহাকাব্যের যৌক্তিক ব্যাখ্যা।
তাদের এই সাহসী পদক্ষেপ বাংলা সাহিত্যে আসলেই কতটা দাগ কেটে যাবে, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে পাঠক হিসেবে খাঁটি বাংলায় তৃপ্তিকর, প্রাচীন ভারত উপমহাদেশের চমৎকার সব গল্প শোনার এই সুযোগ করে দেওয়ার জন্য লেখক কে সাধুবাদ না জানালে যে অন্যায় হবে, সেটা অনস্বীকার্য।
বইটি অনলাইনে কিনতে- ধনুর্ধর