বাঙালির অবিস্মরণীয় গৌরবগাঁথা মুক্তিযুদ্ধ নিয়মিতই কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে শিল্প-সাহিত্যের। শিল্পকলার বিভিন্ন শাখা-উপশাখাতেই আমরা তার সাক্ষাৎ পাই- উপন্যাস, গান, কবিতা সর্বত্রই। বাদ পড়েনি সাহিত্যের অপেক্ষাকৃত নবীনতর শাখা ছোটগল্পও। সমকালীনতার সাক্ষীস্বরূপ বহু মননশীল রচনায় যুদ্ধদিনের কাহিনী ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকারেরা। বাংলা কথাসাহিত্যে হাসান আজিজুল হক এক প্রবাদপ্রতিম নাম। ছোটগল্পের রাজপুত্র হিসেবে তিনি অধিষ্ঠিত বাংলা সাহিত্যের মন ও মননে। মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্যপূর্ণ অভিঘাত পরিলক্ষিত হয় তার ছোটগল্পেও। মুক্তিযুদ্ধকে প্রাণে ধারণ করে তার লেখা, তেমনই একটি গ্রন্থ ‘নামহীন গোত্রহীন’।
‘নামহীন গোত্রহীন’ বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখিত সাতটি গল্পের সংকলন। ১৯৭৫ সালে বইটি প্রকাশিত হয় ‘সাহিত্য প্রকাশ’ থেকে। ষাটের দশকে ‘শকুন’ গল্প রচনার পর তার সাহিত্যপ্রতিভার উন্মেষ ঘটতে থাকে। সেদিক থেকে বিচার করলে ধরে নেওয়া যায় ‘নামহীন গোত্রহীন’ একজন পরিণত সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকেরই রচনা, এবং বস্তুতও তা-ই। সাহিত্যমনীষার চূড়ান্ত উৎকর্ষের সাক্ষ্য বহন করে অসাধারণ এই গল্পসপ্তক। ‘ভূষণের একদিন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’, ‘আটক’, ‘কেউ আসেনি’, ‘ফেরা’ এবং ‘ঘরগেরস্থি’— এই সাতটি গল্প সংকলিত হয়েছে ‘নামহীন গোত্রহীন’ গ্রন্থে। মোটা দাগে এদের ভাগ করা যায় দু’ভাগে। প্রথম তিনটি গল্পে খুঁজে পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিকে, আর শেষ চারটি গল্পে বর্ণিত হয়েছে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের অবস্থাক্রম।
‘ভুষণের একদিন’ গল্পে বলা হয়েছে একজন প্রান্তিক কৃষকের যুদ্ধদিনের কথা। দরিদ্র চাষী ভূষণের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আহবান কোনো বিশেষ তাৎপর্য বয়ে আনে না, কিন্তু অনিবার্যভাবে সপুত্রক সে জড়িয়ে পড়ে তার ধারাপ্রবাহে। ভূষণের চোখে হাসান দেখান একাত্তরের এপ্রিলে গণহত্যার মর্মভেদী চিত্র। ‘নামহীন গোত্রহীন’ বইটির নামগল্প। ধারণা করা যায়, বইয়ের প্রচ্ছদে অঙ্কিত ব্যাগ কাঁধে ব্যক্তিটি এ গল্পেরই প্রধান চরিত্র। সে মূলত এক ব্যগ্র পথচারী, স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের খোঁজে চেনা শহর তার কাছে অচেনা মনে হয়। দোকানপাট ঘরবাড়ি বন্ধ— জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই। থেমে থেমে শুধু বুটের গটগট শব্দ, হানাদারদের হুংকার “তুম হিন্দু হো?”, “সালা বোলো, তুম জয় বাংলা হো?”, “জরুর জয় বাংলা হো”, “বাঙালি কুত্তা”— কখনো বা এরই মাঝে স্বজাতির গোঙানির আওয়াজ।
বিপর্যস্ত শহরে সে দেখে হানাদারদের অব্যাখ্যাত নির্যাতনের চিত্র— আর নিজের বাড়ির উঠানে খুঁজে পায় নামহীন গোত্রহীন কতগুলো হাড়, কঙ্কাল। বইয়ের সবচেয়ে বড় গল্পটি হলো ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’; শুধু আকারেই নয়, ভাব এবং বিস্তৃতিতেও। এখানে বর্ণিত হয়েছে পাঁচ তরুণ মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা। পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা গ্রামাঞ্চলে অগ্নিসংযোগ, নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা, ধর্ষণ, ধনসম্পদ লুটপাট ইত্যাদির মর্মান্তিক বর্ণনার পাশাপাশি এতে পাওয়া যায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ, হার না মানা সাহসী তৎপরতা ও রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের জীবন্ত চিত্র।
‘আটক’ গল্পে সাধারণ জনগণের প্রতিনিধি নজমুলের চোখে দেখানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম পর্বকে। মিত্রবাহিনীর বিমান আক্রমণে পর্যুদস্ত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নাজুক অবস্থা এবং সেসময়ে জনমানুষের মনে ভাবী অর্জনের উল্লাসের কথা পাওয়া যায় এখানে। পাশাপাশি হাসান দেখিয়েছেন বোমাবর্ষণে কেবল পাকিস্তানী সেনারা নিহত হয়নি, ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষও। বোমা বিস্ফোরণ ও দেয়াল ধ্বসে জনৈক শ্রমিকের মৃত্যুর বিবরণও অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী।
‘কেউ আসেনি’, ‘ফেরা’, ‘ঘরগেরস্থি’— গল্প তিনটি অনেক বেশি দার্শনিক এবং মনস্তাত্ত্বিক। এ তিনটি গল্পের পটভূমি যুদ্ধোত্তর কাল, চরিত্রেরা কেউ যুদ্ধফেরত, কেউবা ফিরে এসেছে শরণার্থী শিবির থেকে। এখানে উত্থাপিত হয়েছে স্বাধীনতা এবং তার তাৎপর্য নিয়ে দার্শনিক ভাবনা। ‘কেউ আসেনি’ গল্পে যুদ্ধফেরত গফুর খাকি পোশাক আর রাইফেল হাতে হাসপাতালে দাঁড়িয়ে থেকে প্রত্যক্ষ করে তার সহযোদ্ধা আসফ আলীর মৃত্যুকে। তার মনে প্রশ্ন জাগে, মুক্তিযুদ্ধ করে কী পেল আসফ? কী পেল সে নিজে? একই ভাবনা দেখা যায় ‘ঘরগেরস্থি’র রামশরণ এবং ‘ফেরা’র আলেফের মধ্যে।
প্রত্যাগত আলেফ প্রত্যাশা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধ করায় তার অবস্থার উন্নতি হবে। তার ভিটের অবস্থা বদলাবে। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের কঠিন বাস্তবতায় আলেফ অনুভব করে, এখনো প্রকৃত স্বাধীনতা আসেনি। তাই সে অস্ত্র জমা না দিয়ে লুকিয়ে রাখে ডোবার মধ্যে। আবার ধর্মান্ধগোষ্ঠীর নির্মমতায় চার সন্তান এবং পুত্রকে নিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রামশরণ দেশে ফেরে স্বপ্নের সোনালি জাল বোনে, কিন্তু ক্ষুধা-দারিদ্র্য আর আশাভঙ্গের বেদনা তার কাছে স্বাধীনতাকে ব্যর্থ প্রতিপন্ন করে। তার কণ্ঠে ঝরে পড়ে আক্ষেপ—
“স্বাধীন অইছি তাতে আমার বাপের কী? আমি তো এই দেহি, আগ বছর পরাণের ভয়ে পালালাম ইন্ডেয়- ন’টা মাস শ্যাল কুকুরের মতো কাটিয়ে ফিরে আলাম দ্যাশে। আবার সেই শ্যাল কুকুরের ব্যাপার।….স্বাধীনটা কি আঁ? আমি খাতি পালাম না- ছোওয়াল মিয়ে শুকেয়ে মরে, স্বাধীনটা কোঁয়ানে? ”
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্য রচনা করে যারা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাদের মধ্যে হাসান আজিজুল হক অন্যতম। উদ্দিষ্ট ছোটগল্পগুলো তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধের নানাবিধ দিককে, নানাবিধ প্রসঙ্গচরিত্রে— কখনো একজন গরীব চাষী, কখনো যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা, ত্রাণ বয়ে আসা শরণার্থী, তো আবার কখনো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার দৃষ্টিতে।
গল্পগুলো প্রথাগত টানটান ‘উত্তেজনা’র ফিকশন নয়; বরং মুক্তিযুদ্ধের বিশালতার মধ্যে আত্মগোপনকারী নানাবিধ চরিত্রে মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের নির্মোহ চেষ্টা। এসব গল্পের ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আনুষঙ্গিক নানা দিক মূর্ত হয়ে ওঠে পাঠকের চোখে। কখনো কখনো তা রুক্ষ-কর্কশ, কখনো তা ব্যঞ্জনাময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। কখনো কখনো মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে গল্পকারের নিজস্ব আবেগ এবং জীবনবোধ সচকিত করে পাঠকের মনকে। হাসানের গভীর জীবনদর্শন এবং মননশীলতার সমানুপাতিক মিশ্রণে সংঘটিত জনযুদ্ধ এবং তার সুগভীর তাৎপর্য পাঠক অন্তরের গহীনে অনুভব করতে পারবেন— সেকথা বলাই বাহুল্য।