সময় ১৯৬৯ সাল। এক খানকে হটিয়ে তখন সবেমাত্র আরেক খান পাকিস্তানের ক্ষমতায় এসেছেন। আন্দোলনের বেগ তখনও হ্রাস পায়নি। এমন উত্তাল সময়ে একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স ক্যান্টিনে তিন অধ্যাপক বন্ধুর সাথে পরিচয় হয় আজগর মালিক নামে আরেক তরুণ অধ্যাপকের।
পরিচয়ের শুরুটা সন্দেহ থেকেই, যেহেতু আজগর মালিক ছিলেন বেলুচ বংশোদ্ভূত বাঙ্গালি। কিন্তু সন্দেহ দূরীভূত হতে বেশি দেরি হয় না। আজগর মালিক তার জীবনে ঘটে যাওয়া এক অবিশ্বাস্য কাহিনী শুনিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেন তার নতুন তিন অধ্যাপক বন্ধুকে।
জানা যায়, আজগর মালিকের বাবা ছিলেন সিন্ধুর মহেঞ্জোদারো সভ্যতা আবিষ্কারের পেছনে থাকা আর্কিওলজিক্যাল টিমের একজন তরুণ গবেষক। স্মৃতি হিসেবে তিনি সেখানকার একটি নিরীহদর্শন চ্যাপ্টা পাথরখণ্ড বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর সেই পাথরখণ্ডই পাল্টে দেয় আজগর মালিকের জীবনকে।
দেখতে সাধারণ হলেও একদিন তার হাতের স্পর্শে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে পাথর খণ্ডটি। প্রচণ্ড কম্পনে এর পাথরের খোলসটি ঝরে পড়ে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে স্বর্ণের তৈরি চ্যাপ্টা বাক্সের আকৃতির অত্যন্ত জটিল একটি ডিভাইস।
আজগর মালিকের হাতের স্পর্শে যখন ডিভাইসটির স্ক্রিন সচল হয়ে ওঠে, তখন তিনি বুঝতে পারেন, এটি আসলে অত্যন্ত উন্নত কোনো সভ্যতার তৈরি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির একটি কম্পিউটার সদৃশ যন্ত্র, যার মেমোরিতে অদ্ভুত এক ভাষায় সংরক্ষিত আছে এক নভোচারীর ডায়েরি।
শুরু হয় আজগর মালিকের গবেষণা। ধীরে ধীরে তার সামনে উন্মোচিত হতে থাকে এক নতুন দিগন্ত। ডিভাইসটি এমন এক সময়ের, যখন পৃথিবী জিম্মি অক্সিরেটদের হাতে। কারা এই অক্সিরেট? যারা পৃথিবীর প্রতিটি অক্সিজেনের অনু-পরমাণুকে নিয়ন্ত্রণ করে।
মানুষের জীবনধারণের জন্য অপহিরার্য এই অক্সিজেনকে কুক্ষিগত করেই টিকে আছে অক্সিরেটদের শোষণমূলক সমাজব্যবস্থা। কিন্তু একইসাথে তাদের বিরুদ্ধে দানা বেঁধে উঠছে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। একদল স্বাধীনতাকামী অ্যান্টি-অক্সিরেট প্রস্তুতি নিচ্ছে বিদ্রোহ করার।
সময় পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে এমন সময় অবতার হিসেবে এক নভোচারী হাজির হয় তাদের মাঝে। সে কি পারবে অক্সিরেটদের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনকে পরিপূর্ণতা দিতে? নাকি এক তরুণীর প্রেম বাধা হয়ে উঠবে তার লক্ষ্য অর্জনে? তাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করবে অন্য কোনো গ্রহে, কিংবা অন্য কোনো সময়ে?
তারচেয়েও বড় কথা, এই ৫,০০০ বছর আগের মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষে এই অত্যাধুনিক ডিভাইস এলো কী করে? অক্সিজেন কুক্ষিগত করা, আলোর কাছাকাছি গতিতে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়ানো, সময়ের মধ্য দিয়ে পরিভ্রমণ করা – এগুলো কোন সময়ের কাহিনী? তবে কি অতীতে এমন কোনো উন্নত সভ্যতা ছিল, যারা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছতে পেরেছিল? এরপর কোনো কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে? আমরা কি তাদেরই উত্তরসূরি?
১৯৬৯-এর উত্তাল দিনগুলোর মধ্য দিয়েই শুরু হয় চার অধ্যাপক বন্ধুর এক অবিশ্বাস্য জার্নি। তারা কি পারবে এই অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে করতে? পারবে সেই হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার কোনো নিদর্শন খুঁজে বের করতে? জানতে হলে আপনাকে পড়তে হবে এবারের একুশে বইমেলায় নালন্দা থেকে প্রকাশিত মোহাম্মদ সাইফূল ইসলামের সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস ‘ও টু’। অক্সিজেনকে নিয়ে সংঘাতের কারণেই বইয়ের এই নামকরণ, যেখানে “ও টু” হচ্ছে অক্সিজেনের সংকেত (O2)।
‘ও টু’ মোহাম্মদ সাইফূল ইসলামের প্রকাশিত দ্বিতীয় বই। কিন্তু সায়েন্স ফিকশনের জগতে তার বিচরণ দীর্ঘদিনের। সামহোয়্যার ইন ব্লগের যুগে যে অল্প কিছু তরুণ লেখক সায়েন্স ফিকশন লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, সাইফূল ইসলাম তাদের অন্যতম। সেখানে ‘শান্তির দেবদূত’ ছদ্মনামে তিনি দীর্ঘদিন লেখালেখি করেছেন। যে তরুণ লেখকদের হাত ধরে অনলাইনে বাংলা সায়েন্স ফিকশনের নতুন ধারা সূচিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে সাইফূল ইসলাম অন্যতম। এছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু সাহিত্য বিষয়ক সাময়িকীতেও তার সায়েন্স ফিকশন প্রকাশিত হয়েছে।
সায়েন্স ফিকশন লেখকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে অভিযোগটি থাকে, সেটি হলো তাদের লেখায় ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্রভাব স্পষ্ট থাকে। সাইফূল ইসলাম এই অভিযোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। ব্লগে প্রথমদিকে তার লেখা কয়েকটি গল্পে হয়তো মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্রভাব পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু দীর্ঘদিনের চর্চায় তিনি সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তার ‘ও টু’ বইটির বর্ণনাভঙ্গি হয়তো জাফর ইকবালের মতো আকর্ষণীয় নয়, কিন্তু কাহিনীর গভীরতা, মৌলিকতা, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সফল ব্যবহার- কোনোদিক থেকেই তিনি সমসাময়িক অন্য কোনো সায়েন্স ফিকশন লেখকের থেকে পিছিয়ে নেই।
‘ও টু’ উপন্যাসে লেখক একাধিক কাহিনী সমান্তরালে বর্ণনা করে গেছেন। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের কাহিনী এখানে পাশাপাশি এগিয়ে গেছে। উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়টি পাঠকের কাছে খুবই গতানুগতিক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয় অধ্যায়ের মাঝামাঝি থেকেই পাঠক নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হবেন। লেখকের ভাষা অত্যন্ত সাবলীল, কাহিনী গতিশীল এবং গল্পের শেষে তিনি যে টুইস্ট দিয়েছেন, সেটা মনোযোগী পাঠককেও চমৎকৃত করবে।
‘ও টু’ উপন্যাসের ত্রুটি খুঁজতে গেলে বেশ কষ্ট করতে হবে। এর প্রথম অধ্যায় হয়তো পাঠকের কাছে বিরক্তিকর মনে হতে পারে, শুরুর দিকে কিছু কিছু বর্ণনাকে বাহুল্য বলেও মনে হতে পারে, কিছু কিছু কথোপকথনকে হয়তো দীর্ঘ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর পাঠক যখন উপন্যাসের জটিল কাহিনীর ভেতরে প্রবেশ করবেন, তখন তার কাছে এই ত্রুটিগুলো ম্লান হয়ে আসতে বাধ্য।
‘ও টু’ উপন্যাসের সবচেয়ে বড় গুণ হলো, লেখক এখানে নিছক বিজ্ঞানের কঠিন কঠিন থিওরির মধ্যে তার কাহিনীকে আবদ্ধ রাখেননি। তিনি একইসাথে এর মধ্যে টেনে এনেছেন রাজনীতি, ধর্ম এবং পৌরাণিক কাহিনীকে। এবং স্বাভাবিকভাবেই এনেছেন মানবিক সম্পর্কগুলোকে, প্রেম এবং ভালোবাসাকে। উপন্যাসের ফাঁকে ফাঁকে উঠে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব আন্দোলনমুখর চিত্রও। উঠে এসেছে মানবজাতির অভ্যুদয় এবং মানব সভ্যতার বিকাশের সাথে ধর্মের এবং পৌরাণিক কাহিনীর রহস্যময় এবং জটিল সম্পর্কের কথাও, যা কৌতূহলী পাঠককে নতুন ভাবনার খোরাক দিবে।
বৈজ্ঞানিক ‘কল্পকাহিনী’ হলেও পুরো উপন্যাসে লেখক বিজ্ঞানের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন। লেখক নিজে একজন প্রকৌশলী এবং পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক, কাজেই বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো সম্পর্কে তার ধারণা পরিষ্কার। প্রচলিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর সীমারেখার মধ্যে থেকেই লেখক তার কল্পনার ডানা ছড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে এটি সত্যিকার অর্থেই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী হিসেবে সফল হয়ে উঠেছে।
বইয়ের রিভিউতে লেখকের পরিচয়ের ক্ষেত্রে ‘প্রচারবিমুখ’ শব্দটা অতি ব্যবহারের ফলে ক্লিশে হয়ে গেছে। কিন্তু সাইফূল ইসলাম সত্যিকার অর্থেই একজন প্রচারবিমুখ লেখক। তার নিজস্ব কোনো ব্যক্তিগত ব্লগ নেই, ফেসবুকের গ্রুপগুলোতে তিনি নিজের বই নিয়ে কখনোই পোস্ট দেন না, এমনকি নিজের আইডিতেও তিনি তার এই বই সম্পর্কে স্ট্যাটাস দিয়েছেন মাত্র তিনটি। কিন্তু তার ‘ও টু’ এখন পর্যন্ত যে কয়জন পড়েছেন, তাদের প্রায় সকলেই এর বেশ প্রশংসা করেছেন। যারা ভালো, মৌলিক কাহিনীর সায়েন্স ফিকশনের সন্ধান করেন, তাদের কাছে বইটি ভালো লাগতে পারে।
বইটি প্রকাশিত হয়েছে নালন্দা থেকে। এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৭৫। পাওয়া যাচ্ছে একুশের বইমেলায় ২৬ নম্বর প্যাভিলিয়নে।
অনলাইনে বইটি কিনতে ভিজিট করতে পারেন এই লিঙ্কে
১) ও টু