বুয়েন্স আয়ার্সে সেনর ক্লেমন্তকে কেউ চিনত না। কম কথার মানুষ। পরিবার নিয়ে থাকে, কাজ করে একটা কারখানায়। কেউই চিনত না, বিষয়টা আসলে তেমন না। প্রবাসী নাৎসিরা চিনত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যারা আর্জেন্টিনায় পালিয়ে গিয়েছিল।
লোকটার আসল নামটাও তারা জানতো- অ্যাডলফ আইখম্যান।
কুখ্যাত ফাইনাল সলিউশন এই আইখম্যানের মাথা থেকে বেরিয়েছিল। সে ছিল ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যার নির্মম হলোকাস্টের অন্যতম খুনী, খুনে বাহিনী এসএস-এর মূল নেতাদের একজন।
আইখম্যান কিন্তু হিটলার ও তার অনেক সহচরের মতো আত্মহত্যা করেনি, যুদ্ধের পরে ন্যুরেমবার্গে তার বিচারও হয়নি। নাম-ধাম বদলে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে পালায় সে। ভেবেছিল, বেঁচে যাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের পরাজয়ের পর আইখম্যান স্রেফ লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায়, অনেকে ধরে নিয়েছিল- সে হয়তো মরে গেছে।
এই ভুল ভাঙে ১৯৬০ এ, যখন মোসাদ-এর কাছে জার্মানি থেকে একটা তথ্য আসে, আইখম্যান আসলে আর্জেন্টিনায় লুকিয়ে আছে। মিসরের সাথে ইসরায়েলের তখন ঝামেলা চলছে, মোসাদ আরব বিশ্ব নিয়ে ব্যস্ত, তাই সংস্থার প্রধান ইজার হারেল শুরুতে এই তথ্যকে গুজব ভেবে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। একজন তাকে বললো, ভেবে দেখেন স্যার, যদি সত্যিই আর্জেন্টিনায় দেখা যাওয়া লোকটা আইখম্যান হয়, তাহলে লোকে বলবে মোশাদের একটা ভুলের জন্য ফাইনাল সলিউশনের আর্কিটেক্টের বিচার হয়নি।
এই একজনটা হচ্ছেন পিটার মালকিন, মোসাদের এজেন্ট।
তৈরি হলো হিটলারের শেষ সহযোগীকে ধরার টিম। মোসাদের এজেন্টদের অনেকেই হলোকাস্টে পরিবারের সবাইকে হারিয়েছে, তাই কেউ কেউ, আইখম্যানকে হাতে পেলেই শেষ করে দেওয়ার পক্ষপাতী। কিন্তু তাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে লোকটাকে জীবিত ধরতে, বিচারের সম্মুখীন করতে; আর মানবিক আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারাটাই পেশাদারিত্ব।
মোসাদ আইখম্যানকে জীবিত অবস্থায় ধরতে সক্ষম হয়। সে প্রথমে নিজেকে একজন ইহুদি দাবি করে, শেষে স্বীকার করে যে সে-ই অ্যাডলফ আইখম্যান। প্রচণ্ড ধূর্ত হওয়ায় সে চেষ্টা করে ছদ্ম-দার্শনিক আলাপ তুলে নিজের চামড়া বাঁচাতে। সাময়িকভাবে পিটার মালকিনকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষমও হয় সে, কিন্তু মেডিকেল ডক্টর হান্নাহ-এর প্রয়াসে মালকিন সে বিভ্রান্তি কাটিয়ে ওঠে।
কিন্তু এবার শুরু হয় নয়া এক বিপদ। একটি ঘটনার কারণে ইসরায়েল অ্যাম্বাসি থেকে তাদেরকে জানানো হলো, লোকটি স্বেচ্ছায় ইসরায়েলে আসতে চায়, এমন স্টেটমেন্টে তার সই নিয়ে তাকে আনতে হবে। এতে টিমের কাজটা আরও কঠিন হয়ে যায়।
টিমের আরেক সদস্য ভি আহারোনি শুরুতে ভদ্রভাবে চেষ্টা করে, একসময় ধৈর্য হারিয়ে মত দেয়, প্রয়োজনে পিটিয়ে আইখম্যানের সই আদায় করা হোক। কিন্তু মালকিন জানে লোকটা এসএসপ্রধান ছিলো, পিটিয়ে লাশ বানিয়ে ফেললেও বশ মানবে না। তাই সে আইখম্যানের সাথে একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে, তাকে খাইয়ে দেয় এবং শেভ করায়, তারপর কৌশলে তার কাছ থেকে সই আদায় করে।
হলোকাস্টে পিটার মালকিন তার বোন ফ্রুমাকে হারান, ফ্রুমার তিন শিশুসন্তানকেও খুন করেছিলো নাৎসিরা। যেদিন আইখম্যানকে প্লেনে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, সেদিন শেষ মুহূর্তে, আইখম্যান তার আসল চরিত্রে আবির্ভূত হয়। সে মালকিনকে উত্তেজিত করতে একটা ঘটনা বলে।
একবার একসাথে ৫,০০০ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিলো, একটা পরিখা খুঁড়ে, সেখানে লাইন ধরে ইহুদিদেরকে দাঁড় করানো হয়। ওপর থেকে নাৎসি সৈন্যরা বন্দুক তাক করে। তারা অপেক্ষা করতে থাকে আইখম্যানের নির্দেশের অপেক্ষায়। এক ইহুদি নারী তার বাচ্চাকে উঁচু করে তুলে ধরেছিল, হয়তো ভেবেছিল আইখম্যানের দয়া হবে, ছোট্ট শিশুকে মেরে লাভ কী- এই ভেবে কোলে তুলে নেবে। আইখম্যান তার সৈনিকদেরকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিলে একটা গুলি বাচ্চাটার মাথার ভেতর দিয়ে চলে যায়, রক্ত ছিটকে এসে আইখম্যানের ইউনিফর্মে লাগে। আইখম্যান বিশ্বাস করত ইহুদিদের রক্ত নোংরা, তাই সে বিরক্ত হয়ে, ইউনিফর্ম থেকে মুছে ফেলে শিশু রক্তের দাগ। ঘটনাটা শুনিয়ে সে পিটার মালকিনকে বলে, ওই শিশুর মা-ই তোমার বোন না তো!
তারপর সে বলে, আমাকে নিয়ে তোমরা আর কী-ই বা করবে? ফাঁসিই তো দিবে! তার মানে হলো, আমার জীবন ষাট লক্ষ ইহুদির জীবনের সমান, অথচ ঐ ষাট লক্ষ ইহুদি, ওরা তো আমার থুতুরও যোগ্য না।
মালকিন হয়তো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মেরেই ফেলতো লোকটাকে, মেডিকেল ডক্টর হান্নাহ আইখম্যানকে বাঁচিয়ে দেয়। তারা প্রতিশোধ নিতে আর্জেন্টিনায় উড়ে আসেনি। এসেছে ন্যায়বিচারের জন্য।
আর্হেন্তিনার প্রবাসী নাৎসিরা জেনে গিয়েছিল মোসাদের মিশন সম্পর্কে। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে যে প্লেনে করে আইখম্যানকে ধরে আনা হচ্ছিল সেটিকে থামাতে। মালকিনের অতুলনীয় বুদ্ধিমত্তার কারণে তারা ব্যর্থ হয়।
আইখম্যান ছিল একমাত্র নাৎসি যার বিচার হয়েছিল জেরুজালেমে। যে শহরে সহাবস্থান করে পশ্চিম দেয়াল, চার্চ অফ দি হোলি সেপালক্যার, আর বায়তুল মোকাদ্দাস। এই বিচার টেলিভিশনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে দেখানো হয়।
১৯৬২ সালের ১ জুন আইখম্যানের ফাঁসি কার্যকর হয়।
সই নেয়ার সময় আইখম্যান একটা অনুরোধ জানিয়েছিলো পিটার মালকিনকে, মৃত্যুর আগে সে শেষবার তার স্ত্রীকে দেখতে চায়। মালকিন অনুরোধ রেখেছিলেন। জেলখানায় আইখম্যানের স্ত্রী তার স্বামীকে দেখতে আসেন।
আইখম্যান যখন ‘আমরা সবাই পশু’ বলে মালকিনকে বিভ্রান্ত করা চেষ্টা করেছিল, আর্জেন্টিনায়, হান্নাহ তখন মালকিনকে বিভ্রান্তিমুক্ত করে। সে মালকিনকে বলে, আমরা সবাই পশু না। কেননা, আমরা সবাই যদি পশু হতাম, তাহলে আইখম্যান এখানেই এই আর্জেন্টিনাতেই আমাদের হাতে টুকরো টুকরো হয়ে যেত।
আইখম্যানের মৃতদেহ কোথাও কবর দেয়া হয়নি। নাৎসিরা কবর দেওয়ার প্রথায় বিশ্বাস করতো না। তারা যেহেতু নিজেদেরকে আর্য মনে করত, তাই তারা বিশ্বাস করত আগুনে পোড়ানোর প্রথায়। আইখম্যানের লাশ পোড়ানো হলেও পোড়া ছাইগুলো কোথাও সমাহিত করা হয়নি, জাহাজে করে নিয়ে সমুদ্রে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তার বিদেহী আত্মা কোনো শেষ বিশ্রামস্থল না পায়।
আইখম্যানের অপহরণ আর বিচারের এই অসামান্য ঘটনাবলী নিয়ে ক্রিস ওয়েইজ নির্মাণ করেছেন তার ‘অপারেশন ফিনালে’ চলচ্চিত্রটি, যেটি মুক্তি পেয়েছে এ-বছরের অক্টোবরে। অ্যাডলফ আইখম্যান চরিত্রে বেন কিংসলে আর পিটার মালকিন চরিত্রে অস্কার ইসহাক দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন, অন্যান্য চরিত্রেও অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সাবলীল অভিনয় করেছেন।
পৃথিবীতে যতদিন মানুষ থাকবে, ততদিন মানুষের মধ্যে সহজাতভাবেই ন্যায়বিচারের আকাঙ্খা থাকবে, সেই আকাঙ্খাকে শৈল্পিকভাবে প্রকাশ করার কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই ঘটনা আর এই সিনেমাটি।