একটি রাষ্ট্রের সরকার যদি রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, যদি সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের সমালোচনাকে দমন করে রাখে, এবং একটি নির্দিষ্ট ছকে চলতে সবাইকে বাধ্য করে, তখন সেই রাষ্ট্রের নাগরিকরা কীভাবে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করে? সেটা তারা বিভিন্নভাবে করতে পারে– হতে পারে গোপনে প্রকাশিত কোনো পত্রিকার মাধ্যমে, হতে পারে অবৈধ কোনো রেডিও চ্যানেলের মাধ্যমে, হতে পারে কোনো গুপ্ত সংগঠনের মাধ্যমে। অথবা, হতে পারে কোনো কল্পিত উপন্যাস বা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। যেমনটি ঘটেছে সোভিয়েত সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র ‘কিন–ঝা–ঝা’ এর ক্ষেত্রে।
‘কিন–ঝা–ঝা’ (রুশ: Кин–дза–дза, ‘কিন–দজা–দজা’) প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে নির্মিত একটি চলচ্চিত্র। ১৯৮৬ সালের ১ ডিসেম্বর মসফিল্ম কর্তৃক প্রকাশিত এই চলচ্চিত্রটি সায়েন্স ফিকশন, কমেডি ও ডিস্টোপিয়ান ফিকশনের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটির পরিচালক ছিলেন প্রখ্যাত সোভিয়েত জর্জীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা গিওর্গি দানেলিয়া। দানেলিয়া এবং আরেকজন সোভিয়েত জর্জীয় চলচ্চিত্রকার রেভাজ গাব্রিয়াদজে এই চলচ্চিত্রটির কাহিনী লিখেছিলেন। একজন রুশ ফোরম্যান এবং একজন জর্জীয় সঙ্গীতের ছাত্রের অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে চলচ্চিত্রটির কাহিনী গড়ে উঠেছে।
ভ্লাদিমির মাশকভ একজন গম্ভীর প্রকৃতির রুশ ফোরম্যান। ব্যস্ততাপূর্ণ একটি দিন শেষে বাড়িতে ফেরার পর স্ত্রীর কথামতো কিছু জিনিস কিনতে সে বাইরে বের হয়। পথিমধ্যে গেদেভান আলেক্সিদজে নামক একজন জর্জীয় সঙ্গীতের ছাত্রের সঙ্গে তার দেখা হয়। আলেক্সিদজে মাশকভকে বলে যে, সে একজন উদ্ভট লোকের দেখা পেয়েছে এবং লোকটির সাহায্য প্রয়োজন। মাশকভ মলিন চেহারার একজন লোককে দেখতে পায়। লোকটি রাস্তার মানুষজনকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করছে,
“আপনার গ্রহটি টেন্টুরার কত নম্বরে অবস্থিত? কিংবা অন্তত স্পাইরালে আপনার গ্যালাক্সির নম্বর কত?”
মাশকভ লোকটির দিকে এগিয়ে গিয়ে লোকটির পরিচয় জিজ্ঞাসা করে। লোকটি তাদেরকে একটি টেলিপোর্টেশন যন্ত্র দেখিয়ে বলে যে, সে ‘উজম’ গ্রহ থেকে ভুল করে পৃথিবীতে এসে পড়েছে। মাশকভ তার কথা বিশ্বাস করে না এবং যন্ত্রটি নিজের হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতে উদ্যত হয়। লোকটির নিষেধ সত্ত্বেও সে ডিভাইসটির একটি বাটনে চাপ দেয়, এবং পরমুহূর্তেই সে নিজেকে ও আলেক্সিদজেকে এক ধূ ধূ মরুভূমির মধ্যে আবিষ্কার করে। এই অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার পরেও মাশকভ ধারণা করে যে, সে কোনোভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নেরই এশীয় অঞ্চলের কোনো একটি মরুভূমিতে পৌঁছে গেছে এবং মরুভূমিটি অতিক্রম করতে পারলেই কোনো একটি শহরে পৌঁছতে পারবে! এই ভেবে সে ও আলেক্সিদজে আন্দাজে একটি দিক ঠিক করে সেদিকে হাঁটতে শুরু করে।
কিছুক্ষণ পরই তাদের সামনে একটি বিচিত্র ধরনের পুরনো আকাশযান অবতরণ করে এবং সেটি থেকে দু’জন মানুষ বেরিয়ে আসে। প্রথমে তারা মাশকভ ও আলেক্সিদজের কথা বুঝতে না পারলেও টেলিপ্যাথিক ক্ষমতার মাধ্যমে শীঘ্রই রুশ ও জর্জীয় ভাষা বুঝতে সক্ষম হয়। তাদের কাছ থেকে মাশকভ জানতে পারে যে, তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো মরুভূমিতে নয়, বরং মরুসদৃশ ‘প্লিউক’ গ্রহে পৌঁছেছে, যেটি ‘কিন–ঝা–ঝা’ গ্যালাক্সির অন্তর্গত। প্লিউক গ্রহের ভাষায় অল্প কিছু শব্দ আছে, যার মধ্যে প্রধান হলো ‘কু’ আর ‘কিউ’। প্লিউকের অধিবাসীরা ভালো কিছু বোঝাতে ‘কু’ এবং খারাপ কিছু বোঝাতে ‘কিউ’ বলে।
প্লিউক গ্রহটিকে দেখে প্রযুক্তিগতভাবে পশ্চাৎপদ মনে হয়, কিন্তু বস্তুত গ্রহটি আসলে অতটা পশ্চাৎপদ নয়। প্লিউকের অধিবাসীরা ‘চাৎলান’ এবং ‘পাৎসাক’ এই দুই ভাগে বিভক্ত, যাদের মধ্যে চাৎলানদের উঁচু শ্রেণির এবং পাৎসাকদের নিচু শ্রেণির হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যদিও তাদের মধ্যে দৈহিক বা মানসিক কোনো পার্থক্য নেই। প্লিউকের অধিবাসীদের আচরণ দেখে তাদেরকে বর্বর বলে মনে হয়। ম্যাচের কাঠিকে প্লিউকের অধিবাসীরা অত্যন্ত দামী হিসেবে বিবেচনা করে।
প্লিউক গ্রহটি প্রকৃতপক্ষে মরুভূমি ছিল না, ছিল একটি সমুদ্র। প্লিউকের অধিবাসীরা পানি থেকে জ্বালানি তৈরি করতে পারে এবং এভাবে তারা সমুদ্রের পানির পুরোটাকেই জ্বালানিতে পরিণত করে ফেলেছে। এর ফলে প্লিউক পরিণত হয়েছে মরুভূমিতে এবং এখন তাদেরকে জ্বালানি থেকে পানি তৈরি করতে হয়। প্লিউকের যে শাসক, তাকে সকলেই ভয় পায় এবং তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য সকলেই ব্যস্ত থাকে, কিন্তু বাস্তবে প্লিউকের শাসক নিরীহ এবং বোকাসোকা প্রকৃতির।
মাশকভ এবং আলেক্সিদজে প্লিউক থেকে পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করে, কিন্তু নানা কারণে তাদের সে প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। প্লিউক গ্রহে তাদের বিচিত্র, হাস্যকর এবং কখনো কখনো হতাশাজনক এই অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘কিন–ঝা–ঝা’ চলচ্চিত্রটির কাহিনী।
চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাবার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের ১ কোটি ৫৭ লক্ষ মানুষ এটি দেখেছিল এবং ১৯৮৭ সালে আয়ের দিক থেকে এর অবস্থান ছিল ১৪তম। এদিক থেকে চলচ্চিত্রটিকে ব্যবসাসফল বলা যায় না। কিন্তু ক্রমে চলচ্চিত্রটি রুশ দর্শকদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং একটি ‘কাল্ট’–এ পরিণত হয়। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার তিন দশক পরও এটি রুশদের মধ্যে এখনো জনপ্রিয়। ২০১০ সালে রাশিয়ার কুরস্ক প্রদেশে আদমশুমারি চলাকালে সেখানকার বহু মানুষ নিজেদের ‘পাৎসাকামি’ নামে আখ্যায়িত করেছিল, যেটি ‘কিন–ঝা–ঝা’ চলচ্চিত্রের প্লিউক গ্রহের ‘পাৎসাক’ শ্রেণির নাম থেকে এসেছে। এই তুমুল জনপ্রিয় চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের তুর্কমেন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের (বর্তমান তুর্কমেনিস্তান) অন্তর্গত কারাকুম মরুভূমিতে।
চলচ্চিত্রটির এই ব্যাপক জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে চলচ্চিত্রটিতে প্রদর্শিত কল্পিত ‘প্লিউক’ গ্রহের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাস্তবতার সাদৃশ্য। যেমন:
(১) প্লিউকের অধিবাসীরা যেমন উঁচু ও নিচু দুইটি শ্রেণিতে বিভক্ত, তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়নেও শাসক কমিউনিস্ট পার্টি ও শাসিত জনসাধারণ– এই দুই শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও সোভিয়েত মতাদর্শ অনুযায়ী, রাষ্ট্রটিতে এরকম শ্রেণিবিভেদ সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল না।
(২) প্লিউকের অধিবাসীরা যেমন ম্যাচের কাঠির মতো সামান্য জিনিসকে অত্যন্ত দামী মনে করে, অকার্যকর রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাবিশিষ্ট সোভিয়েত ইউনিয়নেও তেমনি নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্যের সঙ্কট ছিল। ফলে সোভিয়েত জনসাধারণও আপাতদৃষ্টিতে তেমন দামী নয়, এমন অনেক জিনিসকে (যেমন: টেপ রেকর্ডার, জিন্সের প্যান্ট) দামী হিসেবে বিবেচনা করত।
(৩) প্লিউককে প্রথম দর্শনে প্রযুক্তিগতভাবে অত্যন্ত পশ্চাৎপদ মনে হয়, কিন্তু আসলে গ্রহটি পশ্চাৎপদ নয়। অনুরূপভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকেও প্রথম দর্শনে পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় প্রযুক্তিগতভাবে পশ্চাৎপদ মনে হত, যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন বরাবরই ছিল প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের দিক থেকে শীর্ষ রাষ্ট্রগুলোর একটি।
(৪) প্লিউকের অধিবাসীরা পানি থেকে জ্বালানি তৈরি করতে গিয়ে পুরো গ্রহটিকে মরুভূমিতে পরিণত করে ফেলেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নেও দ্রুত শিল্পায়ন করা হয়েছিল এবং দ্রুতগতিতে শিল্পায়ন করতে গিয়ে পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা বিবেচনা করা হয়নি (যেমন: সোভিয়েত শিল্পায়নের একটি বলি ছিল মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত আরাল হ্রদ, যেটি সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে গিয়েছিল)।
(৫) প্লিউকের শাসককে সবাই ভয় পায় ও তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য চেষ্টা করে, কিন্তু বাস্তবে সে নিরীহ ও বোকাসোকা। এর মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন শাসকশ্রেণির প্রতি তীর্যকভাবে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
বলাই বাহুল্য, ‘কিন–ঝা–ঝা’ চলচ্চিত্রটি যে প্রকৃতপক্ষে সায়েন্স ফিকশনের অন্তরালে সোভিয়েত রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার একটি স্যাটায়ার ছিল, এটি বুঝতে সোভিয়েত জনসাধারণের সমস্যা হয়নি। এজন্য বহু সোভিয়েত নাগরিকই কল্পিত প্লিউক গ্রহের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম অনুভব করেছিল। ফলে এই ডিস্টোপিয়ান চলচ্চিত্রটি কালক্রমে সোভিয়েত বা রুশ চলচ্চিত্রের একটি কাল্টে পরিণত হয় এবং বর্তমানেও এটি রুশদের মধ্যে জনপ্রিয়।