ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি ২০১৩ সালে প্রকাশ করেন ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টুয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ নামক বইটি। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান আয় ও সম্পদ বৈষম্য নিয়ে লেখা ৬৫০ পৃষ্ঠার এই বইটি খুব দ্রুতই স্থান করে নেয় নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায়। বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগানো এই বইটিতে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কী কী অর্থনৈতিক কারণে বিশ্বে আয় ও সম্পদ বৈষম্য ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর কিছু প্রতিকারও তিনি বাতলে দেন।
কিছুদিন আগে টুইটারে তিনি তার দ্বিতীয় বই ‘ক্যাপিটাল এন্ড আইডিওলোজি’ বইটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশের ঘোষণা দেন (ফরাসি ভাষায় যা ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে)। বইটি ইতোমধ্যে অনেক খ্যাতি লাভ করেছে। এই বইতেও তিনি বৈষম্য নিয়েই লিখেছেন, কিন্তু বৈষম্যের শুধু অর্থনৈতিক কারণ বিশ্লেষণই নয়, বরং গত ২৫০ বছরে কীভাবে পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের উত্থান-পতনের কারণে যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের উদ্ভব ঘটেছে, তার এক চমৎকার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। বৈষম্য হ্রাস করার কিছু উপায়ও তিনি উল্লেখ করেন তার বইটিতে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের ওপর এমন বিস্তারিত তথ্য ও প্রমাণসহ বইয়ের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল।
শিল্প বিপ্লব থেকে ১৯৮০: বৈষম্যের উত্থান ও পতন
শিল্প বিপ্লবের পর থেকে পৃথিবীতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে অর্থনৈতিক বৈষম্যও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধনীরা আরও ধনী হয় আর দরিদ্ররা থেকে যায় দারিদ্র্যসীমার আশেপাশেই। এই অবস্থা দূর করার জন্য অনেক বিপ্লবও সংঘটিত হয়, যেমন- ১৭৮৭-১৭৯৯ সালের ফরাসি বিপ্লব। ফরাসি বিপ্লব হয়েছিল ফ্রান্সের বুর্জোয়া শিল্পপতি ও উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। তাদের ধনদৌলতের বদৌলতে তারা সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে থাকে, আর সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হয় তাদের অধিকার থেকে এবং দিনের পর দিন তারা দারিদ্র্যের চরম সীমায় পৌঁছতে থাকে। সমাজের নিচু স্তরের এই মানুষগুলো নিজেদের ন্যায্য অধিকার বুঝে পাওয়ার জন্য এই আন্দোলনে যোগ দেয়। আন্দোলন শেষ হয়, কিন্তু আগের অবস্থার কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। যদিও ধনি-দরিদ্রের বৈষম্য লোপ করার জন্য এই আন্দোলন হয়, কিন্তু অবশেষে বৈষম্য হ্রাস পায়নি। ফরাসি বিপ্লবের পর ফ্রান্সে শীর্ষ ১০% ধনী জনগোষ্ঠীর সম্পদের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
তার মতে, প্রকৃত বিপ্লব সংঘটিত হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, যখন সম্পদশালী এক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এই সময়ে শীর্ষ ১০% ধনী জনগোষ্ঠীর সম্পদ কমতে থাকে, আর মধ্যবিত্ত ৪০% জনগোষ্ঠীর সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নিম্নবিত্ত ৫০% জনগোষ্ঠী কখনো ১০% এর বেশি সম্পদের মালিক হতে পারেনি। শুধু ফ্রান্সে নয়, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সারা বিশ্বে আয় বৈষম্য হ্রাস পেতে থাকে (যদিও পরে তা বৃদ্ধি পায়)।
নানা কারণে সম্পদশালী এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়। শীর্ষ ধনীদের সম্পদের দাম হ্রাস পাওয়া তার মধ্যে অন্যতম। সম্পদের যুদ্ধ সংক্রান্ত ক্ষয়-ক্ষতি ধনীদের সম্পদের মূল্য অনেকাংশে হ্রাস করে। তারা সরকারি বন্ড কেনার ক্ষেত্রে তাদের সঞ্চয় বিনিয়োগ করে, কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি ও ট্যাক্সের কারণে এই বন্ডগুলোর দাম প্রচুর পরিমাণে হ্রাস পায়। আর বাকি যে কারণে সম্পদের মূল্য হ্রাস পায় তা হলো ঐ সময়ের কিছু রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যা সম্পদের ব্যক্তি মালিকানা সীমিত করে (যেমন সম্পদের মুনাফা নিয়ন্ত্রণ)। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক বৈষম্য আরো দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে।
নিম্নের চিত্র থেকেই বলা যায় যে, ১৯৪৫ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে বৈষম্য অনেকাংশে হ্রাস পায়। বাম দলগুলো এই সময়ে অনেক প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, যার কারণে ধনীদের সম্পদ পুঞ্জিভূতকরণের প্রতিকূলে সরকার অনেক নিয়মনীতি আরোপ করতে সক্ষম হয় (যেমন- প্রগতিশীল কর, যা সম্পদের পুঞ্জিভূতকরণ হ্রাসে সহায়তা করে বৈষম্য নিয়ন্ত্রণে আনে) ।
১৯৮০ থেকে বর্তমান: নব্য-উদারনীতিবাদের বিস্তার ও বৈষম্যের উত্থান
কিন্তু ১৯৮০ এর পর নব্য-উদারনীতিবাদ (নিও-লিবারালিজম) বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, যার কারণে ব্যক্তিগত সম্পদের ওপর সরকারের প্রভাব হ্রাস পায় এবং প্রগতিশীল কর সহ অন্যান্য অনেক সরকারি নীতির বিলুপ্তি ঘটে। নব্য-উদারনীতিবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে মার্গারেট থ্যাচার ও রোনাল্ড রিগ্যান বিরাট ভূমিকা পালন করেন, যার কারণে আশির পর থেকে সরকারের আর্থিক নীতিগুলো ধনীদের অনুকূলে আসতে থাকে। বিশ্বজুড়ে এই মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়ার কারণে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে যা আজ অবধি বিদ্যমান আছে।
বাম দলগুলোর শক্তি হ্রাস ও পথভ্রষ্টতাকে তিনি নব্য-উদারনীতিবাদের উত্থান ও বৈষম্য হ্রাসের নীতি বর্জনের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। প্রথমে বাম দলগুলো খেটে-খাওয়া মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করলেও পরে তারা পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে তারা সাধারণ জনগণের বদলে ‘ইন্টেলেকচুয়াল এলিট’ বা বুদ্ধিজীবী এলিট সমাজের প্রতিনিধিত্ব করতে থাকে। নব্য-উদারনীতিবাদের প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে যদিও তাদের রুখে দাঁড়ানোর কথা, কিন্তু তেমনটি আর হয়নি। ফলশ্রুতিতে বাম দলগুলোর পক্ষে সাধারণ খেটে-খাওয়া মধ্যবিত্তদের ভোটের সংখ্যা কমতে থাকে আর শিক্ষিত এলিটদের ভোটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে নব্য-উদারনীতিবাদকে রুখে দাঁড়ানোর ও নিম্নবিত্ত সমাজের পক্ষে কথা বলার আর কেউ রইল না। এছাড়া বাম দলগুলোর শক্তি হ্রাসের পেছনে মার্ক্সবাদ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনও অনেকটা দায়ী।
শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সরকারি ব্যয় ও মনোযোগ হ্রাস পাওয়া বৈষম্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। পূর্বের বইতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে, শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনে সবার সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতই পারে বৈষম্য হ্রাস করতে। বিংশ শতাব্দীতে শিক্ষার ওপর সরকারি ব্যয় পূর্বের চেয়ে অনেকাংশে বৃদ্ধি পায় এবং ফলস্বরূপ বিশ্বব্যাপী শিক্ষার হার অনেক বৃদ্ধি পায়। আস্তে আস্তে দেশগুলো তার সকল বয়ঃগোষ্ঠীকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা-স্তরে আনতে সক্ষম হয়, কিন্তু শিক্ষার বৈষম্য হ্রাসে খুব কমই মনোযোগ দেয়া হয়। যদিও দরিদ্র জনগোষ্ঠী সরকারি খরচে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পেয়ে থাকে, কিন্তু এর বেশি আর তাদের যাওয়ার সুযোগ হয় না।
উচ্চ শিক্ষার বাড়তি খরচ শুধু ধনী পরিবারই বহন করতে পারে আর দরিদ্রদের মধ্যে খুব কম পরিবারই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে। যদিও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু তা বেশ অপর্যাপ্ত। এভাবেই উচ্চবিত্ত সমাজ থেকে যায় ধনী, আর দরিদ্র জনগোষ্ঠী থেকে যায় দারিদ্র্যসীমার আশেপাশেই। সরকার তার দায়িত্ব পূর্ণ হয়েছে ভেবে শিক্ষাখাতের প্রতি অমনোযোগী হয়ে ওঠে। ফলে এই খাতে ব্যায়ও অন্যান্য খাতের তুলনায় হ্রাস পেতে থাকে, আর শিক্ষার খাতে বৈষম্য বৃদ্ধি পাতে থাকে। আয় ও সম্পদ বৈষম্য বৃদ্ধির পেছনে শিক্ষার বৈষম্য অনেকাংশে দায়ী বলে পিকেটি মনে করেন।
উত্তরণের উপায়
ক্রমবর্ধমান এই বৈষম্য হ্রাসের কিছু উপায় তিনি উল্লেখ করেছেন তার বইতে। বইয়ের শেষের কিছু পরিচ্ছেদে তিনি দুটি কাজ করেন- প্রগতিশীল করের বিরুদ্ধে যে যুক্তিগুলো রয়েছে তা খণ্ডন করেন এবং এক নতুন ধরনের প্রগতিশীল কর আরোপের প্রস্তাব দেন।
সাধারণত নব্য-উদারবাদীরা বলে থাকেন যে, প্রগতিশীল কর অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। কারণ কর সমাজে অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু পিকেটি ১৯৪৫-৮০ এর সময়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন যে, ঐ সময়ে প্রগতিশীল কর ভালোভাবেই কাজ করেছে আর অর্থনৈতিক উন্নয়নও ঐ সময়ে ভালোভাবেই এগিয়েছে। সুতরাং এই যুক্তি ভিত্তিহীন। নব্য-উদারবাদীদের আরেকটি যুক্তি হচ্ছে, ধনীরা অনেক ব্যবসা বাণিজ্য করে তাদের সম্পদ জমিয়েছে, সুতরাং এই সম্পদে অন্য কারো অধিকার নেই। তার বইটিতে তিনি মনে করিয়ে দেন যে, বর্তমানে বিখ্যাত কর্পোরেশন আর টেক জায়ান্টগুলো একসময় সরকারি ভর্তুকি, গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমেই লাভবান হয়। তারা জনগণের টাকা দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং এখন সময় এসেছে জনগণকে তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেবার।
উপরোক্ত গ্রাফ থেকেই তার প্রস্তাবিত কর ব্যবস্থার গঠন আন্দাজ করা যায়। প্রগতিশীল কর ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনে তিনি সম্পদ ও আয়ের ওপর ৫% থেকে ৯০% পর্যন্ত কর আরোপ করেন। আর শুধু জাতীয় করই নয়, তিনি আন্তর্জাতিক কর ব্যবস্থারও প্রস্তাব দেন। সমাজতন্ত্রের মতো সম্পদের ১০০% তিনি সরকারের হাতে দেওয়ার পক্ষে না থাকলেও ৯০% কর মেনে নেওয়ার মন-মানসিকতা পৃথিবীতে খুব কম মানুষেরই আছে। তার এই প্রস্তাব অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়, কিন্তু তিনি উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে প্রচলিত আদর্শ ও মতবাদের যদি আমূল পরিবর্তন না হয়, তাহলে এই কর ব্যবস্থা প্রয়োগ হবে না, আর বৈষম্য হ্রাসও অসম্ভব হয়ে পড়বে।
পূর্বের বইয়ের মতো এই বইয়ের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এর পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্যের অভাব। পৃথিবীর খুব কম দেশের তথ্যই তার বইতে স্থান পেয়েছে, এবং এই অল্প কয়েকটি দেশের তথ্য থেকেই লেখক তার উপসংহার টেনেছেন। কিন্তু বৈষম্যের ওপর তিনি যতটুকু তথ্য ও উপাত্ত পেশ করেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম, যা আজ পর্যন্ত অন্য কোনো অর্থনীতিবিদ বৈষম্যের ওপর এত তথ্য-উপাত্ত পেশ করে এত গভীর বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়নি।
পৃথিবীকে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, বৈষম্য দূর করার জন্য যদি বর্তমান নিয়ম-নীতি আর মতাদর্শের আমূল পরিবর্তন করা না হয়, তাহলে এই শতাব্দীতে পৃথিবীর অর্থনৈতিক বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পাবে।