দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা গোটা পৃথিবীতে এক রোমহর্ষক ভীতির সঞ্চার করেছিল। শক্তিশালী দেশগুলো এরূপ আশার বাণী শুনিয়েছিল যে, তারা আর সংঘাত চায় না। কিন্তু কার্যত এগুলো সবই ছিল কথার কথা। বরং সত্য হলো এই যে, পরপর দুই মহাযুদ্ধের পর পৃথিবী আবারও প্রস্তুত হচ্ছে, আরও বড় কোনো গ্রেট-ওয়ারের জন্য।
উন্নত দেশগুলো এখন আর সম্মুখযুদ্ধে মিলিত হয় না। ভিন্ন পন্থায় চলে ক্ষমতা আর প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা। কোনো দেশে অভ্যন্তরীণ সমস্যা দেখা দিলেই সেখানে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে। নিজেদের পক্ষের শক্তিকে জেতাতে অবৈধ, অমানবিক উপায় অবলম্বনেও পিছপা হয় না তারা।
সিরিয়া হলো এমনই একটি দেশ, যেখানে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে দেশের একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী। যাদের সবার প্রতিপক্ষ বাশার আল-আসাদ, কিন্তু তারা আবার পরস্পর বিরোধী। সিরিয়ার এই সকল আসাদ বিরোধীদের সমর্থন জোগায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। যেমন: ফ্রি সিরিয়ান আর্মির পক্ষে তুরস্ক, কুর্দি গ্রুপ ওয়াইপিজে-র প্রতি সমর্থন আমেরিকার, আর আসাদ সরকারের মিত্র হলো রাশিয়া ও ইরান।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জটিল এই সমস্যার সূত্রপাত ২০১১ সালের পর। মূলত তখনই সিরিয়ায় সরকার বিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর উত্থান। সেই সময় অন্যান্য দলগুলোর মতোই আবির্ভাব ঘটে আইএস এর (ইসলামিক স্টেট, আরবীতে দায়েশ)।
দায়েশের উত্থানে সিরিয়ার সমস্যা আরও জট পাকিয়ে যায়। আসাদ যেমন সবগুলো বিরোধী গ্রুপের কমন শত্রু, দায়েশও ছিল সেইরকম। ফলে শুরু হয় এক চতুর্মুখী যুদ্ধ। একদল আরেকদলকে হটিয়ে একেকটি শহরের দখল নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে, যে খবরগুলো পত্রপত্রিকাতে নিয়মিতই দেখা যায়।
সিরিয়া যুদ্ধের খবরাখবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে। কেউ হয়তো কুর্দি গ্রুপের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছে, কোনো প্রচার মাধ্যম হয়তো ফ্রি সিরিয়ান আর্মিদের হিরো বানিয়েছে, আবার কোথাও হয়তো বাশার আল-আসাদকে সঠিক বলে উপস্থাপন করা হয়েছে; যদিও দায়েশ নিয়ে সকলেই নেতিবাচক। কিন্তু একটা পক্ষের কথা কোথাও তেমনভাবে উঠে আসেনি, কোনো পরাশক্তিও তাদের পক্ষ নেয়নি। বলা হচ্ছে সিরিয়ার অসহায় জনসাধারণের কথা।
একাধিক পক্ষের পরস্পরবিরোধী যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কারা? এই প্রশ্নের সর্বস্বীকৃত উত্তর নিশ্চয়ই নিরস্ত্র সিরিয়াবাসী। বিবাদমান সবগুলো দলেরই কোনো না কোনো স্বার্থ রয়েছে, কিন্তু অসহায় সিরিয়াবাসীর কোনো স্বার্থ নেই। অথচ এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মূল্য চুকিয়েছে তারাই। কিন্তু এ খবর ক’জনই বা রাখে! আসলে রাখা সম্ভবও নয়। কারণ এই নরককুন্ড থেকে বেরিয়ে আসে না অসহায় মানুষগুলোর আর্তনাদ, অথবা ইচ্ছে করেই হয়তো প্রকাশ করা হয় না।
বছরখানেক আগে সামির নামের এক যুবকের ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে জানা গেছে সিরিয়ার সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কিছু রোমহর্ষক গল্প, যা ইতিমধ্যেই ভাষান্তরিত করে বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে ‘আইসিসের কবলে দিনগুলি‘ শিরোনামে।
বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মুহাইমিনুল ইসলাম অন্তিক। ‘আইসিসের কবলে দিনগুলি’ লেখকের চলমান ‘ওয়ার ডায়েরি সিরিজ’ এর দ্বিতীয় বই। যদিও এটি তার অনুবাদ গ্রন্থ, কিন্তু পড়তে গিয়ে একবারের জন্যও মনে হবে না বইটি ভাষান্তরিত। এর কারণ সাবলীল শব্দচয়ন, যা অনেক অনুবাদগ্রন্থেই দেখা যায় না। তাই বইটি খুলে বসলে কখন যে হারিয়ে যাবেন সিরিয়ার সেই বিধ্বস্ত রাক্বা শহরের বিষণ্ন বাস্তবতায়, তা হয়তো বুঝতেই পারবেন না।
আইসিসের কবলে দিনগুলি
সিরিয়ার রাক্বা শহরটি দখল করে নিয়েছে আইএস (দায়েশ)। দখলের পরই জনগণের উপর কড়াকড়ি আরোপ শুরু করে দিয়েছে তারা- ট্রাউজার অতিরিক্ত লম্বা হওয়া যাবে না, হিজাব-নিকাব পরার পর হাতের কবজি অবদি ঢাকা থাকতে হবে, টেলিভিশন দেখা মানে ধর্মত্যাগ, মোবাইল ফোন ব্যবহার মানে মহাপাপ ইত্যাদি। আর এই সকল অদ্ভুত আইন অমান্য করলে পেতে হয় কঠিন শাস্তি।
দায়েশের এরূপ কঠিন নিয়মকানুন মানতে গিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে রাক্বাবাসী। কিন্তু এসব নিয়ে প্রতিবাদ তো দূরে থাক, টুঁ শব্দ করারও উপায় নেই। কারণ চারিদিকেই গিজগিজ করছে তাদের গুপ্তচর। যারাই টুকটাক প্রতিবাদের চেষ্টা করেছে, তাদেরকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি কাউকে হত্যার পূর্বে মাইকিং করে তার নাম ঘোষণা করা হতো এবং স্থানীয়দের হত্যার জায়গায় উপস্থিত থেকে সেই দৃশ্য দেখতে হতো। কেউ দেখতে না চাইলে তাকেও শাস্তি পেতে হতো!
খাবার নেই, রান্না করার মতো তেল-গ্যাস নেই। বিদ্যুৎ আছে, কিছু দোকানও খোলা পাওয়া যায়, কিন্তু এসবের জন্য আইএস-কে ট্যাক্সের নামে মোটা অংকের চাঁদা দিতে হয়। কেউ চাইলেই আবার এই অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে পালাতেও পারছে না, পয়েন্টে পয়েন্টে চেকপোস্ট!
ভয়াবহ নরক যন্ত্রণার মাঝেও সামির নামের এক যুবক চিন্তা করলো কিছু একটা করার। কিন্তু অস্ত্রের সামনে প্রতিবাদ করার কোনো উপায় নেই। তাই সে বেছে নিল কলম-যুদ্ধের পথ। ভীষণ কৌশলে অন্য শহরে থাকা এক বন্ধুর মাধ্যমে রাক্বায় ঘটে যাওয়া অমানবিক ঘটনাগুলো তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিল সে।
দায়েশের পাশবিক অত্যাচারের ঘটনাগুলো নিজের ডায়েরিতে লিখতে শুরু করে সামির। আর সুযোগ পেলেই সেগুলো বন্ধুর কাছে পাঠায়, সেই বন্ধু আবার সেগুলো প্রকাশ করে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে।
এভাবেই চলে বেশ কিছুদিন। হঠাৎ করেই একদিন সামিরের পাশের বাসার একজনকে ধরে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয় এবং তার কাটা মস্তক রাস্তায় টাঙিয়ে রাখা হয়। এদিকে সামিরের মায়ের চিন্তার শেষ নেই। আইএস আসার পর থেকেই আসাদ সরকারের মিত্র রাশিয়া বেশ কয়েক দফা বিমান হামলা চালিয়েছে। সেই হামলাগুলোতে আইএস-এর চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ রাক্বাবাসী, মারা গেছে সামিরের বাবাও। তাই মায়ের কাছে এখন সামিরই একমাত্র ভরসা।
সামিরকে এর আগেও একবার ধরে নিয়ে গিয়েছিল আইএস-এর সদস্যরা। সেবার ৪০টি চাবুক মেরে ছেড়ে দেয় তাকে। এবার হয়তো একেবারেই মেরে ফেলতে পারে যদি কোনোভাবে জেনে যায় যে সে আইএসবিরোধী অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের সাথে জড়িত।
ইদানিং ঘুমাতে পারে না সামির। সারাক্ষণ এক উৎকণ্ঠা কাজ করে! কখন যেন ধরে নিয়ে যায়। তার ভয় মৃত্যু নিয়ে নয়, পরিবারের সামনে নির্মমভাবে হত্যা করা হলে মায়ের কী অবস্থা হবে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
কিছুদিন আগে এক বন্ধুর সাথে ফোনে যোগাযোগ হলে সে জানায়, রাক্বার অদূরেই কুর্দি গ্রুপ ওয়াইপিজে অবস্থান নিয়েছে। সামির ভাবলো, ওয়াইপিজে আসলে হয়তো আইএস-এর কবল থেকে মুক্তি মিলবে। কিন্তু তার বন্ধু জানাল, কুর্দিরা আরও ভয়ংকর! তারা রাক্বা দখল করে নেওয়া মানে এক দানবের হাত থেকে আরেক দানবের হাতে পড়া।
রাক্বাবাসীর এমন অবস্থা হয়েছিল যে তারা যেন একটি গাছের ডালে ঝুলে ছিল। সেই ডালে ছিল এক ভয়ংকর বিচ্ছু, নিচে পানি যেখানে আছে এক ক্ষুধার্ত কুমির, আর ডাঙ্গায় হিংস্র বাঘ।
সামির ভীষণ সতর্কতার সাথে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বিশ্বস্ত একজনের কাছে জানতে পারে তার নাম উঠে গেছে দায়েশের ব্ল্যাকলিস্টে। খুব শীঘ্রই তাকে আটক করা হতে পারে। এ কথার শোনার পর থেকে তার খাওয়া, ঘুম চলে গেল। দরজায় কেউ কড়া নাড়লে চমকে ওঠে সে। কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। মনে হয় ঘরের দেয়ালের ঘড়িটাও দায়েশের গুপ্তচর!
বেঁচে থেকে নির্মম এক মৃত্যুর অপেক্ষা যেন নরক যন্ত্রণা। নাহ! আর পারছে না সামির। দায়েশের হাত থেকে বাঁচার এখন একটাই উপায়, পালিয়ে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি নিয়ন্ত্রিত কোনো এলাকায় আশ্রয় নেওয়া। কিন্তু রাক্বা থেকে পালাতে গেলেও জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে যেতে হবে।
কী করবে সামির? পালিয়ে গেলে তার পরিবারের কী হবে? আর যদি দায়েশ ধরে নিয়ে যায় তাহলে মায়ের সামনে ক্রুশবিদ্ধ করে তাকে হত্যা করা হবে! সামিরের জীবনে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছিল?
সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন ‘আইসিসের কবলে দিনগুলি‘ বইটিতে। সেই সাথে একজন পাঠকের কাছে এই বইটি হতে পারে জীবনকে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে দেখার এক মাধ্যম। এমন কিছু বাস্তব সত্য জানাবে এই বই, যেগুলো পড়ার পর হয়তো নিজের অজান্তেই চোখের কোণে দু’ফোঁটা অশ্রু জমে উঠবে, মনে হবে জীবনের চেয়ে বড় নাটকীয় আর কী হতে পারে!
রোর বাংলা লাইব্রেরিতে বইটি অনলাইনে পড়তে চাইলে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে
আইসিসের কবলে দিনগুলি – নরককুণ্ড থেকে পালানোর রোমহর্ষক কাহিনি
বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে
বই: আইসিসের কবলে দিনগুলি
ভাষান্তর: মুহাইমিনুল ইসলাম অন্তিক
প্রকাশক: স্বরে অ
মুদ্রিত মূল্য: ২৪০ টাকা