বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি কুড়ানো কল্পকাহিনি ‘দ্য লর্ড অভ দ্য রিংস’ এবং ‘দ্য হবিট’ জে.আর.আর টোলকিনের এক অনবদ্য সৃষ্টি। পরিচালক পিটার জ্যাকসনের কারিশমায় রূপালী পর্দায় জীবন্ত হয়েছিল দ্য লর্ড অভ দ্য রিংস ট্রিলজি। মূল গল্প ছিল শায়ারের বাসিন্দা ফ্রোডো ব্যাগিন্সকে ঘিরে। এক যুগ পর এর প্রিকুয়েল এসেছে দ্য হবিট ট্রিলজি নামে। এই গল্পের মূল নায়ক ছিল ফ্রোডোর চাচা বিলবো ব্যাগিন্স। দ্য লর্ড অভ দ্য রিং ট্রিলজির মতো না হলেও, দ্য হবিট ট্রিলজিও মোটামুটি সফলই ছিল বলা চলে। দ্য লর্ড অভ দ্য রিংয়ের ৭৭ বছর পূর্বের কাহিনি নির্মিত প্রিকুয়েল দ্য হবিট ট্রিলজির অজানা কিছু দিক নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
১.
দ্য হবিটের প্লটকে টোলকিন গল্পকারে সাজিয়েছিলেন ১৯২৮ সালের দিকে। অর্থাৎ, দ্য লর্ড অভ দ্য রিংসের কাহিনির আগে এই গল্প লিখেছিলেন বলে এটা হলো লর্ড অভ দ্য রিংসের প্রিকুয়েল। তবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, তিনি হবিটের গল্পকে অর্ধেক লিখে অসমাপ্ত করে রেখে দিয়েছিলেন। টোলকিনের ছাত্রী এলেইন গ্রিফিথ ওই খসড়া নিয়ে হাজির হয় তার এক প্রকাশক বন্ধুর নিকট। ওই বন্ধু অর্ধসমাপ্ত গল্প পড়ে যারপরনাই মুগ্ধ হয়। গ্রিফিথ টোলকিনকে গল্পে ইতি টানার অনুরোধ করলে, টোলকিন সেখান থেকে গল্প সমাপ্তির প্রণোদনা পান। তাই মিডল-আর্থের সুসজ্জিত রূপকথা টোলকিনের কল্পনাপ্রসূত মস্তিষ্ক থেকে কালো অক্ষরে রূপান্তরিত হবার পেছনে গ্রিফিথের অসামান্য অবদান রয়েছে।
২.
১৯৯৪ সালে পরিচালক পিটার জ্যাকসন দ্য হবিট বইয়ের অনুরূপে প্রথম হবিট চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কারণ, তিনি ১৯৭৮ সালে মুক্তি প্রাপ্ত লর্ড অভ দ্য রিংসের অ্যানিমেশন মুভি দেখে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হন। আর এই হবিটের গল্পের সূত্র ধরেই পর পর লর্ড অভ রিংসের দু’টি সিনেমা আসার কথা ছিল। কিন্তু এই প্রজেক্ট নিয়ে প্রোডাকশন হাউজ মিরাম্যাক্সের সাথে বনিবনা হয়নি পিটারের। তারপর সে কাজ চলে যায় নিউ লাইন সিনেমার কাছে। তারা প্রথমে লর্ড অভ দ্য রিংস ট্রিলজি, এরপর হবিট ট্রিলজিকে সেলুলয়েড পর্দায় আনতে সাহায্য করে।
৩.
২০১০ সালে হবিট নিয়ে সিনেমা নির্মাণের প্রস্তাব এসেছিল প্রখ্যাত পরিচালক গুইলেরমো দেল তোরোর কাছে। কিন্তু তিনি কাজে হাত লাগানোর আগেই একেরপর এক সমস্যা এসে ঝামেলা পাকানো শুরু করে। এর মধ্যে আর্থিক সমস্যাকে সবচেয়ে বড় জটিলতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় ফিল্ম শুট করার পর্যাপ্ত বাজেট আসছিল না। ওদিকে আবার টোলকিনের বুক পাবলিশাররা প্লটের রয়্যালটি সম্পর্কিত ইস্যুতে ওয়ার্নার ব্রোসের নামে মামলা ঠুকে দিয়েছিল। এই কারণে প্রোডাকশন কোম্পানি ওয়ার্নার ব্রোস ক্রমশ এই প্রজেক্টকে পিছিয়ে নিচ্ছিল। নানাবিধ জটিলতার সম্মুখীন হয়ে একসময় এই প্রজেক্ট ছেড়ে দেন তোরো। এরপর সে সুযোগ আসে পিটার জ্যাকসনের কাছে।
৪.
এই ট্রিলজির কেন্দ্রীয় চরিত্র বিলবো ব্যাগিন্সের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য প্রথমে অনেক বড় বড় অভিনেতার কথা ভাবা হয়েছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শিয়া লাবেওফ, জেমস ম্যাক অ্যাভয়, হ্যারি পটার খ্যাত ড্যানিয়েল র্যাডক্লিফ, স্পাইডারম্যান খ্যাত টবি ম্যাগুয়ের প্রমুখ। কিন্তু শেষমেশ পিটার জ্যাকসন জুটি বেধেছিলেন ব্রিটিশ অভিনেতা মার্টিন ফ্রিম্যানের সাথেই। সমস্যা পাকিয়েছিল মার্টিন ফ্রিম্যানের শিডিউল নিয়ে। তিনি তখন বিবিসির কালজয়ী টিভি শো দ্য শার্লকের শুটিং নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। শুধুমাত্র মার্টিনের জন্যই পিটার জ্যাকসন শুটিং শিডিউল ২০১০ থেকে পিছিয়ে ২০১১ সালে নিয়ে গিয়েছিলেন।
৫.
দেল তোরোর কাছে প্রস্তাব আসার পর তিনি প্রথম বিশালদেহী ড্রাগন স্মাগের চরিত্রে ভেবে রেখেছিলেন অভিনেতা রন পার্লম্যানকে। কিন্তু জ্যাকসন তা এসে সঁপে দিয়েছিলেন ডক্টর স্ট্রেঞ্জ খ্যাত বেনেডিক্ট কম্বারব্যাচের কাছে। বেনেডিক্ট শুধু স্মাগের কণ্ঠই দেননি, মোশন ক্যাপচারের দায়িত্ব পালন করেছেন।
৬.
ট্রিলজির অনেকটা সময় জুড়ে তীর-ধনুক হাতে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন যুদ্ধবাজ এলভিশ রমণী টাওরিয়েল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, টোলকিন রচিত দ্য হবিট সিরিজের কোথাও টাওরিয়েলের কথা উল্লেখ নেই। এই চরিত্রটি পরিচালক পিটার জ্যাকসনের কল্পনাপ্রসূত, যা শুধুমাত্র সিনেমার খাতিরেই সৃষ্টি করা হয়েছে। চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী ইভানজেলিন লিলি। তিনি লর্ড অভ দ্য রিংস ট্রিলজির প্রতিটা সিনেমার জন্যই কিছু নারী চরিত্রের জন্য অডিশন দিয়েও কোনো চরিত্রের জন্য মনোনীত হননি। কিন্তু তাকে স্মরণে রেখেছিলেন পিটার জ্যাকসন। তাই তিনি সুযোগ পেয়ে যান হবিটে।
একই ঘটনা ঘটেছিল সুদক্ষ এলভ তীরন্দাজ শাহজাদা লেগোলাসের ক্ষেত্রেও। দ্য হবিট গল্পে লেগোলাসের বংশের কথা উল্লেখ থাকলেও, তার সরাসরি কোনো বিচরণ নেই গল্পে। এলভ সম্রাট থ্রান্ডুয়িলও তার কোনো সন্তানের কথা উল্লেখ করেনি কাহিনিতে। কিন্তু এই দুজনকে গল্পে স্থান দিয়ে ভুল করেননি পিটার জ্যাকসন। উল্টো চরিত্র দুটো জায়গা করে নিয়েছে দর্শকদের প্রিয় ফ্যান্টাসি চরিত্রের তালিকায়।
৭.
ট্রিলজিতে ডোর্ফদের মুখভর্তি চুল-দাড়ি সহজেই সকলের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। তবে এই চুল-দাঁড়ি কিন্তু মানুষের নয়। তা সংগ্রহ করা হয়েছে চমরী গাইয়ের লোম থেকে। কিছু হেয়ার এক্সটেনশন বানানোর জন্য প্রোডাকশন হাউজকে ১০ হাজার ডলারের মতো খরচ করতে হয়েছে।
৮.
ট্রিলজির প্রথম সিনেমা অ্যান আনএক্সপেক্টেটেড জার্নিতে গলুম চরিত্রে ফিরে এসেছিলেন অ্যান্ডি সার্কিস। ততদিনে মোশন ক্যাপচার এবং সিজিআইয়ের প্রভূত উন্নতি ঘটার কারণে অ্যান্ডি সার্কিস এবং মার্টিন ফ্রিম্যান একসাথেই পর্বতের দৃশ্যটুকু সমাপ্ত করতে পেরেছিলেন। দশদিন সময় লেগেছিল পুরো দৃশ্যের শুটিং সারতে। রূপালী পর্দায় গলুমকে আরও মসৃণভাবে ফুটিয়ে তুলতে অ্যান্ডি এই দৃশ্যের সেকেন্ড ইউনিট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছিলেন। যেখানে তার লর্ড অভ দ্য রিংসের গলুমের অভিজ্ঞতা দারুণ কাজে দিয়েছিল।
৯.
ড্রাগন স্মাগ ছিল ট্রিলজির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। তার এক স্কেলকে রেন্ডার করার জন্য অর্থাৎ, ডিজিটালি ফটোগ্রাফ তৈরি করতে একটি প্রসেসরের সময় লাগত পুরোপুরি এক সপ্তাহ। নিউজিল্যান্ডের ভিএফএক্স কোম্পানি ওয়েটা ডিজিটাল গ্রাফিক্সের কাজ সামলানোর জন্য ৫০ হাজার সিপিইউ আর ১৭০ টেরাবাইটের র্যাম সম্বলিত একটি সিস্টেম ব্যবহার করেছিল, যেটা গড়ে ৩০ হাজার কম্পিউটারের সমান কাজ করতে পারে। অতি উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন কম্পিউটার ব্যবহারের কারণেই সময়মতো শেষ হয়েছিল সিনেমার কাজ।
১০.
দ্য হবিট বইয়ের কোথাও ফ্রোডো ব্যাগিন্সের কোনো অস্তিত্ব নেই। কারণ, হবিটের কাহিনি লর্ড অভ দ্য রিংসের আগে প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু নস্টালজিয়ার অংশ হিসেবে পিটার জ্যাকসন হবিটে ফ্রোডোর ক্যামিও রেখেছেন। দীর্ঘ এক দশক পর এলাইজা উড ফিরে এসেছিলেন তার ক্যারেক্টার ফ্রোডোতে। তবে তাকে তরুণরূপে প্রদর্শিত করার জন্য ভিএফএক্সের সাহায্য নিয়ে চামড়ার ভাঁজ দূর করা হয়েছিল।
১১.
যারা নিয়মিত ভিডিও গেম খেলে থাকে, তাদের কাছে FPS বা ফ্রেম পার সেকেন্ড খুবই পরিচিত এক শব্দ। ফ্রেম পার সেকেন্ড মানে হচ্ছে এক সেকেন্ডে কয়টা ফ্রেম দেখানো হচ্ছে। ভিডিও মূলত এই ফ্রেম বা অনেকগুলো স্থির ছবির সংযোজন, যা একের পর এক ক্রমানুসারে দ্রুত আসে বলে সেটাকে চলন্ত বা জীবন্ত বলে মনে হয়।
সাধারণ সিনেমা বা সিরিজের ক্ষেত্রে এই FPS হয়ে থাকে ২৪ থেকে ৩০টি। প্রতি সেকেন্ডে ফ্রেমের সংখ্যা বা এর ফ্রিকোয়েন্সি আরও বাড়ানো হলে ভিডিয়োতে আরও স্মুদ এক্সপেরিয়েন্স পাওয়া যায়। পিটার জ্যাকসন ‘অ্যান আনএক্সপেক্টেড জার্নি’ মুভিকে হলিউডের প্রথম সিনেমা হিসেবে ৪৮ ফ্রেম পার সেকেন্ডের হিসেবে ধারণ করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, যেহেতু এপিক সিনেমা নির্মাণ করছি, তাই দশর্কেরা আরও স্মুদ এক্সপেরিয়েন্সের স্বাদ নিক। কিন্তু ফলাফল হলো উল্টো। অনেক দর্শকের কাছে সেটার সাথে খাপ খাওয়াতে পারেননি। কেউ কেউ তো এমনও বলেছে যে, মনে হচ্ছিল কোনো বিহাইন্ড দ্য সিন ডকুমেন্টারি দেখছি। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নন পিটার জ্যাকসন। তার দৃঢ় বিশ্বাস, 48 fps একদিন হবে হলিউডের স্ট্যান্ডার্ড ফরমেট।
১২.
নতুন কোনো জিনিস উদ্ভব হলে তার সাথে নতুন ঝামেলা সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। 48 fps এ মুভিকে শুট করার ফলে মেকআপ ডিপার্টমেন্টের বাড়তি কাজের চাপ বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। এই ফ্রেমে, মেকআপে মুভিতে অভিনেতাদের হলুদ দেখা যাচ্ছিল। পুরুষদের দাঁড়িতে পড়া ছায়ার রং হয়ে যাচ্ছিল নীলচে আভা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রত্যেক চরিত্রের মেকআপের উপর আলাদা করে হালকা কমলা রঙের মেকআপ দেওয়া হয়েছিল।
১৩.
লর্ড অভ দ্য রিংসকে অনুসরণ করেই বক্স অফিসে তাণ্ডব চালিয়েছে দ্য হবিট ট্রিলজি। প্রথম সিনেমার বাজেট ১৮০ মিলিয়ন ডলার, তা আয় করেছিল ১.১৭ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় সিনেমা নির্মিত হয়েছে ২৫২ ডলারে, তা নিজ ঝুলিতে পুরে নিয়েছে ৯৬০ মিলিয়ন ডলার। সর্বশেষ মুভিটি বানাতে খরচ হয়েছিল ২৫০ মিলিয়ন, তা আয় করেছে ৯৬২ মিলিয়ন ডলার। তবে লর্ড অভ দ্য রিংসের মতো অস্কারে চমক দেখাতে পারেনি হবিট। কোনো অস্কার জোটেনি এর কপালে। মাত্র তিনটি মনোনয়ন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় দ্য হবিট ট্রিলজিকে।