পৃথিবীর প্রথম সফল সায়েন্স ফিকশন হিসেবে অভিহিত ‘আধুনিক প্রমিথিউস’ এই বইটির মূল কাহিনীকে ঘিরে সময়ের আবর্তনে রচিত হয়েছে আরো অসংখ্য সায়েন্স ফিকশন, নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত সেরা একশত উপন্যাসের তালিকায় ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন রয়েছে অষ্টম অবস্থানে।
ইঙ্গলস্টাট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানে অধ্যয়নরত ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। অসম্ভবকে সম্ভব করার অদম্য স্পৃহা আর খ্যাতির আস্বাদ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় সুদীর্ঘ সময় ধরে আবিষ্কারের নেশায় মগ্ন ছিলেন এই তরুণ বিজ্ঞানী। তার আশা ছিল সৃষ্টির সৌন্দর্য্যকে প্রত্যক্ষ করা। অবশেষে একদিন কাঙ্ক্ষিত ফলাফল এসে ধরা দেয় তার মুঠোয়। দীর্ঘদিন ধরে আপনজনদের ছেড়ে থাকার তপস্যা একদিন সফল হয়। তিনি উদঘাটন করলেন প্রাণের রহস্য, মৃত মানবদেহে ঘটালেন প্রাণের সঞ্চারণ। প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে বিজ্ঞানের এক নতুন ধারার সূচনা হলো তার হাত ধরে।
তবে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন পরিকল্পনা মোতাবেক অতিমানবের কাঠামো সৃষ্টি করলেও তাতে এক বীভৎস দানবের রূপ দেখতে পান। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় পড়ে যান তিনি। আতঙ্ক আর ঘৃণায় তৎক্ষণাৎ সৃষ্টিকে ত্যাগ করে চলে যান তার স্রষ্টা। আর এভাবেই সূচনা ঘটে কাহিনীর প্রধান রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের।
তবে এখানে প্রশ্নের উদয় ঘটে, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের শখের সৃষ্টি কি আদতেই ভয়াবহ দানব? না, অন্যান্য সৃষ্টির মতো সেও ছিল নির্মল বৈশিষ্ট্যধারী। মানবিক প্রবৃত্তির অধিকারী এই সৃষ্টিরও ঘুম পায়, ক্ষিদে পায়, আঁধারে ভয় লাগে। সেও প্রকৃতির স্বরূপে মুগ্ধ হয়। ধীরে ধীরে তার সামাজিক প্রবৃত্তিও প্রকাশ পায়। সে চায় মানুষের সাহচর্য। কিন্তু তার কদাকার অবয়ব কেউ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। মানবিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সে হয় সমাজচ্যুত। স্রষ্টা আর মানব সমাজের প্রত্যাখ্যান তার মানবিকতাকে ধ্বংস করে জন্ম দেয় পাশবিক প্রবৃত্তি।
নিঃসঙ্গ, পরিত্যক্ত, ক্রোধান্বিত দানবটি সিদ্ধান্ত নেয়, নিজের স্রষ্টাকে ছাড়বে না সে। এরপর থেকেই প্রতিশোধস্বরূপ চালিয়ে যায় একের পর এক গুপ্ত হত্যা। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বুঝতে পারেন, এই অশান্তি আর নৃশংসতার মূলে রয়েছে তারই শ্রমের ফসল, তারই নিজের হাতের আবিষ্কার। যাকে দেবদূতরূপে সৃষ্টি করার জন্য নিজের জীবনের পাঁচটি বছর বিসর্জন দিয়েছেন, সেই সৃষ্টিরই আবির্ভাব ঘটেছে মৃত্যুদূতরূপে, বয়ে এনেছে চরম অভিশাপ। মনের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, নৈরাশ্য আর আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটতে থাকে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের।
তবে কথায় আছে না, একই মুদ্রার দুই পিঠ আলাদা? ঠিক সেই সূত্রেই প্রতিটি গল্পেরই ভিন্ন আঙ্গিক থাকে। সময়ের আবর্তনে, কিংবা ভাগ্যচক্রে আবার সাক্ষাৎ ঘটে স্রষ্টা আর সৃষ্টির মাঝে। দানবটি তার স্রষ্টার কাছে একটি ইচ্ছা পূরণের দাবি জানায়। কি ছিল সেই দাবি? কী ছিল পরিণতি?
গল্পের লেখক মেরী শেলী ছিলেন বিখ্যাত কবি পার্সি বিসি শেলীর স্ত্রী। ১৮১৮ সালে প্রকাশিত উপন্যাসটির প্রথম সংস্করণে তিনি নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছিলেন। পরবর্তীতে ১৮২৩ সালে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলে এর লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন মেরী শেলী। ১৮ বছর বয়সী সদ্য তারুণ্যে পা দেয়া লেখিকা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন রচনা করেন তার দেখা একটি স্বপ্নের উপর ভিত্তি করে। মূলত ঘরোয়া পরিবেশে একটি ভৌতিক কাহিনী লেখার প্রতিযোগিতার জন্যই তার এ সৃষ্টিকর্ম।
বাংলায় একে অনুবাদ করেছেন খসরু চৌধুরী। বাংলাদেশের সফল অনুবাদকদের মধ্যে তিনি একজন। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ছাড়াও তার অনুবাদের তালিকায় রয়েছে এইচ. জি. ওয়েলসের ‘টাইম মেশিন’, রাডইয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘দ্য জাঙ্গল বুক’-এর মতো বেশ কিছু বিখ্যাত গ্রন্থ। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বইটির পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের পাশাপাশি মূল বইয়ের কাব্যিক আমেজ ধরে রাখায় তিনি যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
পৃথিবীটা স্বর্গ হবে, নাকি নরক? এর উত্তর আছে মানুষেরই কাজের মাঝে। হিটলারের কর্মকাণ্ড যেমন মানবজাতির জন্য বয়ে এনেছে বিভীষিকা আর তাণ্ডব, তেমনি মাদার তেরেসার অবদানে আমরা আবিষ্ট হয়েছি মানবিকতার আচ্ছাদনে। দুজনেই মানুষ, অথচ কাজের মধ্যে কী বিস্তর তফাৎ! এছাড়াও একাকীত্ব আর অসহায়ত্ব যে কী বিরূপ ফল বয়ে আনতে পারে, তার একটি ঝলক দেখতে পাওয়া যায় কাহিনীতে। অপরিণামদর্শীতা যে কী দুর্ভাগ্য বয়ে আনতে পারে, তারই একটি বলিষ্ঠ উদাহরণ দেখা যায় কাহিনীজুড়ে।
অপরদিকে, দুই শতাব্দী পেরোনো এ উপন্যাস পড়তে গিয়ে পাঠক দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করেন দানবের অসহায়ত্ব। মেরী শেলীর এই সাহিত্যিক সৃষ্টি একইসাথে আনন্দ আর চাপা কষ্টের এক দারুণ সম্মেলন। চরম উত্তেজনাপূর্ণতা আর ভাষার শৈল্পিক গাঁথুনি বিরতিহীনভাবে বইটি পড়ে ফেলার তাড়না সৃষ্টি করেছিল আমার মনে। এই আধুনিক যুগে এসে দুইশত বছর আগে লেখা একটি বই আমার মনে যে মুগ্ধতার সৃষ্টি করেছে, তার কৃতিত্ব মূল লেখক এবং অনুবাদকের। চমৎকার এই কল্পকাহিনীটি পাঠককে নিয়ে যাবে এক ভিন্ন জগতে।