আঁখি ছলছল জল টলমল স্মৃতি: আমি তপু

বাংলাদেশি কিশোর কথাসাহিত্য নিয়ে কথা হবে, কিন্তু মুহাম্মদ জাফর ইকবালের নাম আসবে না- এমনটা অসম্ভব। সেবা প্রকাশনীর পেপারব্যাক, জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস দিয়েই বাংলাদেশে বই-পড়ুয়াদের হাতেখড়ি হয়। জাফর ইকবালের লেখার মধ্যে একই ধরনের গল্প, চরিত্র, কাঠামোর পুনরাবৃত্তি ঘটলেও লেখকের লেখার মান বা জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। ‘আমি তপু’ উপন্যাসটি, বিশেষত যারা এই বইটি একদম বয়ঃসন্ধিতে পড়েছেন, তাদের মনে সবসময়ই একটা বিশেষ জায়গা নিয়ে থাকবে। কিশোর বয়স অত্যন্ত ভঙ্গুর এক সময়, এই সময়েই মানুষ সবচেয়ে নাজুক মানসিক অবস্থায় থাকে। আর ‘আমি তপু’তে কিশোর মন প্রভাবিত করার সকল উপাদানই আছে।

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

আমি তপু মুহাম্মদ জাফর ইকবালের লেখা কিশোর উপন্যাস। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বইপড়ুয়া যারা কিশোর বয়সে এই বই পড়েছে তারা সবাই বইটি পড়ে চোখের জল ফেলেছে, এটা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়! উপন্যাসটি বর্ণিত হয়েছে আরিফুল ইসলাম তপুর জবানীতে, যে একজন মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলছাত্র । অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে- সে নিজেকে চল্লিশ বছর বয়স্ক ভাবে, যদিও তার বয়স মাত্র তের! এই ছোট বয়সেই সে অনেক মানসিক ও পারিবারিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।

সে আমাদের তার দৈনন্দিন বন্ধুহীন জীবন, স্কুল, অংকের প্রতি তার ভালোবাসার কথা বলে। আরো বলে, তার বাবার মৃত্যুর পর কীভাবে তার মমতাময়ী মা চোখের সামনে বদলে গেল। হ্যাঁ, এটাই সেই মানসিক ও পারিবারিক ঝামেলা, যার কথা একটু আগে বলা হলো। মা তাকে শারীরিক ও মানসিক দু’ভাবেই নির্যাতন করত। কারণে-অকারণে মারধর করত, অনেক কথা শোনাত। এক রাতে সে আর সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু পরদিন স্কুলে এমন এক ঘটনা ঘটে যার ফলে তার পালিয়ে যাওয়া পিছিয়ে যায়। কিছুদিন পর, তপু এক নতুন বন্ধু পায় যে তার মানসিক অবস্থা ঠিক রাখতে অনেক সাহায্য করে। তার মা-ও শেষপর্যন্ত ভুল বুঝতে পেরেছিল, এবং নিজের মৃত্যুশয্যায় তপুর কাছে ক্ষমা চেয়েছে। এই কি শেষ? তপু কি পেরেছিল তার সেই বান্ধবীর সাথে সুখে-শান্তিতে থাকতে? হুম, তার সেই মানসিক টানপোড়েনের ত্রাণকর্তা বন্ধুটি ছিল প্রিয়াংকা নামের এক কিশোরী। তপু আর প্রিয়াংকার পরিণতি কী হয়েছিল- এটা জানতে হলে লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে!

বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: Baatighar

ভালো দিক

বাংলাদেশি লেখকরা কিশোর-কিশোরীদের মনস্তাত্ত্বিক স্তরগুলো নিয়ে কখনো ভাবেননি। বয়ঃসন্ধির নিজস্ব এক জটিল জগত আছে, পৃথিবীর খুব কম লেখকই সেই জগত নিজের লেখায় তুলে ধরতে পেরেছেন। ‘আমি তপু’ বইয়ে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল চেষ্টা করেছেন অসংখ্য টানপোড়েনের মাঝে বাস করা এক কিশোরের মনের জটিলতা মেপে দেখতে। এবং বলতেই হবে, তিনি তের বছর বয়সী এক ছেলের নিজস্ব চিন্তা বেশ ভালোভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। এই বই আমাদের দেখায়- পরিবারে একটি মৃত্যু প্রতিটি সদস্যদের উপর কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলে। সেই সাথে আমাদের দেখায়- নিজের ‘প্যাশনের’ প্রতি তীব্র ভালোবাসা চরম মন খারাপ, দুঃসময়ের মধ্যেও একটু স্বস্তি দিতে পারে।

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল; Image Source: UNDP Bangladesh

এই বই আরো দেখায়, একজন বন্ধুর সহমর্মিতায় কীভাবে জীবন একেবারে পাল্টে যেতে পারে। তবে বইটির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো: যেকোনো কিশোর-কিশোরী অনেক সহজেই তপুর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে পারে, সংযোগ স্থাপন করতে পারে, যদিও তপুর জীবন অন্য আর দশটা কিশোরের মতো স্বাভাবিক নয়, তারপরও। যখন কোনো ছেলেকে তাদের মা একটু শাসন করে, তারা ভাবে তাদের মা বুঝি তপুর মায়ের মতো হয়ে যাচ্ছে! মুহম্মদ জাফর ইকবাল অনেক জটিল একটি গল্প খুবই সপ্রতিভভাবে তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে। এই রকম জটিল প্লটে এত স্বাভাবিকভাবে গল্প বলে যাওয়া মোটেই সহজ না।

খারাপ দিক

লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল একজন অসাধারণ গল্পকার এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার লেখা প্রতিটি কিশোর উপন্যাসে তিনি বিরক্তিকর একটা কাজ করেন। সেটা হচ্ছে— অপ্রয়োজনীয় অ্যাডভেঞ্চার ঢুকিয়ে দেন, সেটা গল্পের কাঠামোতে কোনো প্রভাব রাখুক বা না রাখুক। ‘আমি তপু’ও ব্যতিক্রম না। এখানেও তপু ও তার বন্ধুরা প্রিয়াংকার জন্মদিনের সারপ্রাইজ পার্টির পরিকল্পনা করে, যেখানে প্রিয়াংকা দুর্ঘটনায় হাত ভেঙে ফেলে। এটার কোনো অবদান বা প্রভাব মূল গল্পে পড়ে না। এছাড়া সবকিছু মোটামুটি ছিমছাম ছিল।

বিষণ্নতা; Image Source: Everyday Health

চরিত্র বিশ্লেষণ

তপু

আরিফুল ইসলাম তপু, ক্লাস এইট, রোল ৪৩, বয়স ৪০। ভুল মনে হচ্ছে, তাই না? এই বইয়ের মূল চরিত্র তপু নিজেকে ৪০ বছর বয়স্কই ভাবে। একজন সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা দেয়া কিশোর দুর্ঘটনায় নিজের বাবাকে হারিয়েছে এবং যার মা তাকে দোষারোপ করে তার স্বামীর মৃত্যুর জন্য। এমনকি, সে নিজেও মাঝে মাঝে নিজেকে দোষী ভাবে, মনে করে একই দুর্ঘটনায় সে-ও তো মরে যেতে পারত তার বাবার সাথে, তার জেদেই তো বাবা তাকে নিয়ে গিয়েছিল ব্যাট কিনতে, দুর্ঘটনায় তার নিজের কিছুই হলো না আর বাবাটা মরে গেল! সে নিজের ভাই-বোনের সাথে নিজেকে তুলনা করে সবসময় নিজেকে ক্ষুদ্র ভাবত। তার নিজেরই নিজের কথা বলার ভঙ্গি, চেহারা ভালো লাগত না। এমনি সে ঠিক হলেও তার নিজের পক্ষে কিছু বলার ইচ্ছাও তার ছিল না। হ্যাঁ, এতই জটিল ছিল তার মনোজগত।

সে কাঁচা বয়সে নিজের কাছের মানুষদের আদর-স্নেহ ছাড়াই বড় হচ্ছিল। তার মনের অবস্থা কেউ বুঝতেও চেষ্টা করেনি। ফলে যা হবার তা-ই হয়েছিল, সে নিজের একসময়ের ভালো ছাত্র এবং ভালো ছেলের চরিত্র থেকে অনেক অনেক দূরে সরে এসেছিল। নিজের পরিবারের মানুষদের সাহায্য ছাড়া জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সে পিছিয়ে যাচ্ছিল। তবে তার গণিতের প্রতি ভালোবাসাই তাকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। বান্ধবী প্রিয়াংকা তাকে দেখিয়েছিল, গণিতের সমস্যায় ডুব দিয়ে সে তার বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলো ভুলে থাকতে পারবে। তপুও প্রিয়াংকার সমস্যায় তার পাশে দাঁড়িয়েছে, মূলত তপু সবসময়ই একজন ভালো ছেলে ছিল, কিন্তু পরিস্থিতিই তাকে অন্যরকম ব্যবহার করতে বাধ্য করত। সে নিজের সমস্যা কারো কাছে খুলে বলতে চায়নি, যার কারণে নিজের চারপাশে শক্ত দেয়াল তুলে রেখেছিল। প্রিয়াংকার আগে সেই দেয়াল কেউ ভেদ করতে পারেনি। প্রিয়াংকার সাহায্যেই মূলত তপু কিছুটা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছিল।

বয়ঃসন্ধিকালে মানুষের চিন্তাধারা গড়ে ওঠে; Image Source: imyc

প্রিয়াংকা

বইয়ে তপুর পর প্রিয়াংকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। প্রিয়াংকাও ভাঙা পরিবার থেকে এসেছে। তার মা সে ছোট থাকতে এক দুর্ঘটনায় মারা যায়, এবং বাবা পঙ্গু হয়ে পড়েন। কিন্তু তার পরিস্থিতি মোটেও তপুর মতো ছিল না। তপুর বাবা মারা যাবার পর তার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না। কিন্তু, প্রিয়াংকা আর তার বাবা দুজনে মিলে তাদের লড়াই করেছে, একে অপরের অবলম্বন হয়েছে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রিয়াংকাকে এক প্রাণবন্ত কিশোরী হিসেবে তুলে ধরেছেন, যে সবসময় নিজের চারপাশে হাসিমুখ দেখতে ভালোবাসে। সে অনেক নাছোড়বান্দা স্বভাবের, তপুকে অংকের একটা বই দেওয়ার জন্য তপুর পিছু পিছু তার বাড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছিল, এবং তপুকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। প্রিয়াংকাকে ছাড়া তপু কখনোই গণিতের প্রতি তার ভালোবাসাকে পরিণতি দিতে পারত না। প্রিয়াংকা কোনো বিদ্রোহী ছিল না, কিন্তু সে অন্যায্য নিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলত, সে নিজের কাছে যা ঠিক মনে হয় তা-ই করতে ভালোবাসত, মানুষকে সাহায্য করতে পছন্দ করত। প্রিয়াংকা হলো এক সহানুভূতিশীল মানুষের আদর্শ উদাহরণ।

তপুর মা ও দুলি খালা

‘আমি তপু’ নিয়ে আলোচনা হবে, অথচ তপুর মাকে নিয়ে কথা হবে না- তা তো হতেই পারে না। এই বইয়ের গল্প-কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র তপুর মা-ই। তিনি এমন এক নারী, যিনি দুর্ঘটনায় নিজের স্বামীকে হারিয়ে একই দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া নিজের সন্তানকেই দোষী ভাবেন। বাস্তবতা পরিবর্তন করতে না পেরে সব রাগ তপুর ওপর ঝাড়েন। নিজের কপালের ফের মেনে না নিয়ে দায়ী করেন নিজের সন্তানকে। বইটি প্রথমবার পড়ার সময় খুব রাগ হচ্ছিল তপুর মায়ের উপর। অথচ দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার বই পড়বার সময় রাগ তো হয়ই না, উল্টো কেমন যেন মায়া হয় তপুর মায়ের প্রতি, সহানুভূতি জন্মায়। দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারানোর পর একটু হলেও তার মানসিক ভারসাম্য নড়ে গিয়েছিল, অথচ কেউ তা খেয়াল করেনি। তার বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নেওয়ার অক্ষমতার শিকার তপু। জীবনের অবশ্যম্ভাবী এক ঘটনাকে মেনে না নিয়ে, বর্তমান ছেড়ে অতীত আকড়ে ধরলে কীভাবে নিজের ও আশেপাশের মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে- তার লাগসই উদাহরণ তপুর মাকে নিয়ে দেয়া যায়।

তপুর মায়ের দেখাদেখি তার ভাই-বোনও তপুকে উপেক্ষা করতে থাকে। একজন মানুষ, যিনি সাধ্যমতো তপুর পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন, তিনি দুলি খালা। তিনি তপুর জীবনে মমতাময়ী মায়ের ভূমিকা পালন করেছেন, যা তার আসল মা পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। নিজের কাছের মানুষদের অবহেলায়, অনাদরে তপুর কাছে দুলি খালার রান্নাঘরই ছিল শান্তিতে নিঃশ্বাস নেবার মতো জায়গা। তপু যেমন দুলি খালার উপর ভরসা করতে পারত, তেমনি দুলি খালাও তপুর প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল ছিল।

মানসিক প্রশান্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ; Image Source: Tiny Buddha

অন্যান্য

প্রত্যেক পার্শ্ব-চরিত্রই যথোপযুক্ত ছিল। ছিল লেখকের বহু গল্পের সাধারণ উপাদান দাড়িটুপিওয়ালা রাজাকার চরিত্র। তাকে ‘প্রোটাগনাইজ’ করার জন্য ছিল বন্ধুবৎসল স্কুল প্রিন্সিপ্যাল, যিনি একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার আপন বোন। আরও ছিল প্রিয়াংকার লেখক বাবা যার লেখা বই কেউ পড়ে না। ছিল তপুর সুদর্শন বড় ভাই, যে তপুকে দিয়ে নিজের কাজ যেকোনো মূল্যে করিয়ে নিতে চাইত। বইয়ের প্রতিটি চরিত্রই মূল গল্প এগিয়ে নিতে ভালো ভূমিকা রেখেছে।

যবনিকা

‘আমি তপু’ সবসময়ই কিশোর-কিশোরীদের জন্য লেখা হৃদয়স্পর্শী গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম জায়গা দখল করে রাখবে। এর কারণ মনে হয় লেখার ধারের চেয়ে, যে বয়সে বইটি প্রথমবার পড়া হয়, সেই বয়স। ওই বয়সে এই বই অনেক গভীর প্রভাব ফেলে পাঠকের উপর। এই বই আমাদের বন্ধুত্ব, পরিবার, সম্পর্ক, সম্পর্কের টানাপোড়েন, সহমর্মিতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। কিশোর বয়সে ‘আমি তপু’ পড়েছে। কিন্তু কাঁদেনি, এমন মানুষ মনে হয় না খুঁজে পাওয়া যাবে।

This article is a bangla review of the book 'Ami Topu', written by Md. Zafar Iqbal.

Feature Image Source: colun-jani.com

Related Articles

Exit mobile version