গণমাধ্যম যে সবসময় সত্য সংবাদ প্রচার করে না, সেটা অনেকেই জানে। অনেক সময়ই গণমাধ্যম সত্য গোপন করে যায়, অনেক সময় পক্ষপাতমূলক সংবাদ প্রচার করে, এবং অনেক সময় অতিরঞ্জিত বা সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্যও প্রকাশ করে।
তারপরেও অনেকেই বিশ্বাস করতে চায়, কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও বহুল প্রচারিত শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলো কিংবা প্রশংসিত টিভি চ্যানেলগুলো মূলত সঠিক তথ্যই তুলে ধরার চেষ্টা করে, যদিও কখনো কখনো চাপে পড়ে তারা মিথ্যা প্রচারণা চালাতে বাধ্য হয়।
কিন্তু বিখ্যাত লেখক, অধ্যাপক, রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট এবং দার্শনিক নোম চমস্কি এবং অধ্যাপক এডওয়ার্ড এস হারম্যানের মতে, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত। তাদের মতে গণমাধ্যমের, বিশেষ করে শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেলগুলোর মূল কাজই হলো গণস্বার্থবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষা করা।
শুনতে কন্সপিরেসি থিওরির মতো শোনালেও চমস্কি এবং হারম্যান ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তাদের Manufacturing consent: the political economy of the mass media বইয়ে তাদের বক্তব্য এত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং বক্তব্যের পক্ষে এত বেশি প্রমাণ দিয়েছেন যে, বইটি পড়লে নিতান্ত সংশয়বাদীও এই বাস্তবতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবেন।
‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’ অর্থ হচ্ছে সম্মতি উৎপাদন। চমস্কি এবং হারম্যানের মতে, গণমাধ্যমের কাজ হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন প্রচারণা চালিয়ে নাগরিকদেরকে বিভ্রান্ত করে তাদের কাছ থেকে রাষ্ট্রের গণস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের পক্ষে সম্মতি আদায় করে নেওয়া।
রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকে, কিংবা দেশের অর্থনীতি যারা নিয়ন্ত্রণ করে, নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তাদেরকে প্রতিনিয়তই জনস্বার্থবিরোধী কাজ করতে হয়। সেটা হতে পারে অর্থনৈতিক সংস্কারমূলক কোনো আইন পাশ করা কিংবা অনৈতিক কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া কিংবা সমাজের বিশেষ কোনো শ্রেণীর উপর দমন-নিপীড়ন চালানো।
একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বৈরশাসকরা যেমন জোরপূর্বক যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে পারে, তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না। তাদেরকে শেষ পর্যন্ত জনগণের সম্মতির উপরেই নির্ভর করতে হয়। আর জনগণের কাছ থেকে এই সম্মতি আদায় করে নেওয়ার কাজটিই করে গণমাধ্যম।
চমস্কি এবং হারম্যানের মতে, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেকোনো সংবাদকে ধাপে ধাপে সর্বমোট পাঁচটি ফিল্টারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে, শেষপর্যন্ত যে সংবাদটি জনগণের কাছে পৌঁছাবে, সেটি হবে মূল সংবাদের একটি সেন্সরকৃত সংস্করণ।
তাদের এই প্রস্তাবিত মডেলের নাম তারা দিয়েছেন ‘প্রপাগান্ডা মডেল’। এই মডেল অনুযায়ী গণমাধ্যমগুলো যদি বেসরকারিও হয়, তবুও এই পাঁচটি ফিল্টারের কারণে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থবিরোধী কোনো সংবাদ তারা প্রকাশ করবে না, বা করতে পারবে না।
চমস্কি-হারম্যানের প্রপাগান্ডা মডেলের প্রথম ফিল্টারটি হলো গণমাধ্যমের মালিকানা। তারা দেখিয়েছেন, বইটি লেখার সময় সমগ্র আমেরিকা জুড়ে যে হাজার হাজার পত্র-পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল ছিল, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো মাত্র ২৪টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে এই সংখ্যা হ্রাস পেয়ে মাত্র ৯টিতে নেমে আসে।
ফলে এটা খুবই স্বাভাবিক, পুরো আমেরিকার কোথাও মূলধারার কোনো গণমাধ্যমে এই নয়টি বিশাল, বহুজাতিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থবিরোধী কোনো সংবাদ প্রকাশিত হবে না। এবং এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা যেহেতু তাদের বিভিন্ন ব্যবসার জন্য সরকারের উপর নির্ভরশীল, তাই নিজেদের স্বার্থেই তারা সরকারের সমালোচনার ব্যাপারেও খুব সাবধানী হবেন।
দ্বিতীয় ফিল্টারটি হলো বিজ্ঞাপন। গণমাধ্যম চালাতে যে বিশাল খরচ প্রয়োজন হয়, গ্রাহকদের কাছ থেকে সরাসরি তার ক্ষুদ্র একটা অংশই কেবল উঠে আসে। বাকিটুকুর জন্য গণমাধ্যমগুলোকে নির্ভর করতে হয় বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের উপর। ফলে তাদেরকে শুধু নিজেদের মালিকদেরকে না, অন্যান্য বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও, অর্থাৎ দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকদেরকে সন্তুষ্ট রেখে চলতে হয়।
গণমাধ্যম শুধু যে গ্রাহকদের কাছে পণ্য বিক্রি করে, তা-ই না, একইসাথে তারা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও নির্দিষ্ট মানসিকতার, নির্দিষ্ট শ্রেণীর পাঠক বা দর্শককে বিক্রি করে।
তৃতীয় ফিল্টারটি হলো সংবাদের উৎসের সীমাবদ্ধতা। কোনো পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের পক্ষেই দেশের সকল স্থানে প্রতিবেদক নিয়োগ করা সম্ভব হয় না। সংবাদের জন্য তাদেরকে অধিকাংশক্ষেত্রেই নির্ভর করতে হয় সরকারি সংস্থাগুলোর উপর। স্বাভাবিকভাবেই এখানে একটি পক্ষপাতমূলক অবস্থার সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা হয়, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরাগভাজন হয়ে সংবাদের এই উৎস যেন হাতছাড়া না হয়ে যায়, সেজন্য গণমাধ্যমগুলো এই উৎস থেকে পাওয়া সংবাদগুলোর ব্যাপারে দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করে না।
চতুর্থ ফিল্টারটি হলো সমালোচনা। কোনো সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনে যদি স্বাধীনচেতা কোনো কলামিস্ট বা আলোচক ক্ষমতাসীনদের কিংবা অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকদের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দিয়েই বসেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে অন্য সবগুলো গণমাধ্যমে এত বেশি সমালোচনা শুরু হয় এবং তাকে এমনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় যে, তার পক্ষে টিকে থাকাই কঠিন দাঁড়ায়।
প্রপাগান্ডা মডেলের সর্বশেষ ফিল্টারটি হলো কমিউনিজম। জনসম্মতি উৎপাদনের জন্য একটি জাতীয় শত্রুর প্রয়োজন হয়। কর্তৃত্ববাদী শক্তি সেই জুজুর ভয় দেখিয়ে সহজেই জনগণের সম্মতি আদায় করে নিতে পারে। চমস্কি এবং হারম্যান যখন বইটি লেখেন, তখন আমেরিকাতে এই শত্রু ছিল কমিউনিজম। বর্তমানে অবশ্য বৈরিতার অগ্রাধিকার মোড় নিয়েছে সন্ত্রাসবাদ, অভিবাসন, মৌলবাদের মতো বিষয়গুলোর দিকে।
চমস্কি তার এই বইটি নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রচুর বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেগুলোতে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, এতগুলো ফিল্টারের উপস্থিতির পরেও সংবাদমাধ্যমে অনেক সৎ সাংবাদিক চাকরি করে, যারা সুযোগ পেলেই তাদের সততার প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করে।
এছাড়াও নগরের বাইরের এলাকার ছোটখাট পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলগুলোও অনেক সময়ই এসব ফিল্টারের বাইরে থেকে অনেকটা স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টসহ সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং প্রশংসিত সংবাদপত্রগুলো খুব কম সময়ই ক্ষমতাসীনদেরকে অসন্তুষ্ট করে ভিন্নমতের সংবাদ প্রকাশ করে।
ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট বইটির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি শুধু প্রপাগান্ডা মডেলের তত্ত্ব উপস্থাপন করেই নিজের দায়িত্ব শেষ করেনি, চমস্কি এবং হারম্যান আক্ষরিক অর্থেই মূলধারার বিভিন্ন পত্রিকার হাজার হাজার সংবাদ বিশ্লেষণ করে তাদের প্রতিটি পয়েন্ট প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, কোন পরিস্থিতিতে পত্রিকাগুলো কোন ধরনের সংবাদ প্রচার করেছে, এবং কোন ধরনের সংবাদ প্রচার করেনি, কিংবা বিকৃতভাবে প্রচার করেছে।
‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’ শব্দ দুটি মূলত চমস্কি এবং হারম্যানের কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও এর আবিষ্কারক কিন্তু তারা নিজেরা না। এক বক্তৃতায় চমস্কি জানান, মার্কিন সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক লেখক ওয়াল্টার লিপম্যান প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, জনগণ হচ্ছে বিভ্রান্ত পশুর পালের মতো। তাদেরকে যদি বল প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ না থাকে, তাহলে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ‘ক্যালকুলেটেড ম্যানুফ্যাকচার অফ কনসেন্ট’-এর মাধ্যমে।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ভাষাবিদ্যা ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক নোম চমস্কি তার দীর্ঘ অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ারে গণমাধ্যমের আসল চরিত্র, মার্কিন আগ্রাসী রাজনীতির বাস্তবতা, নব্য উপনিবেশবাদের স্বরূপ প্রভৃতি বিষয়ে শতাধিক বই লিখেছেন। তাকে এই সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী চিন্তাবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কিন্তু তারপরেও মার্কিন মূল ধারার গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে খুবই কম আলোচনা করা হয়েছে। তার কারণও কিন্তু এই ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট। চমস্কির বক্তব্য ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে যাওয়ায় সেগুলো প্রতিবারই তাদের ফিল্টারে আটকে যায়।
কিন্তু তারপরেও শেষপর্যন্ত চমস্কি ইতিহাসে তার নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছেন। তাকে কভারেজ না দিলেও তার বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্য খুব কম সমালোচকই হাজির করতে পেরেছে। সমসাময়িক বিষয়ে লেখা তার বইগুলোও দেশ এবং কালের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট বইটি নিঃসন্দেহে নোম চমস্কির সবচেয়ে প্রভাবশালী বইগুলোর মধ্যে একটি। সত্তর এবং আশির দশকের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও এটি এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, বরং বলা যায় অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
কেন কিছু কিছু ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পরেও গণমাধ্যমে পাত্তা পায় না, কেন ‘ক্রসফায়ারে’ নিহতদের ক্ষেত্রে পত্রিকায় শুধু পুলিশের ভাষ্যই আসে, ‘সন্ত্রাসী’দের আত্মীয়-স্বজনদের বক্তব্য আসে না, কেন বিশেষ কোনো জাতির বিরুদ্ধে, শরণার্থীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক সংবাদ প্রচার করা হয়, ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট পড়লে এর অনেকগুলোর উত্তরই পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করা গণমাধ্যমের আসল চরিত্র বোঝার জন্য এবং গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রপাগান্ডা থেকে বেঁচে থাকার জন্য এই বইটি অবশ্যপাঠ্য।
বইয়ের নাম: ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট || লেখক: নোম চমস্কি
প্রকাশক: প্যানথিওন বুকস্ || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম