‘রিকশা গার্ল’ সিনেমায় প্রধান চরিত্র নাইমা যখন তার বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে যায়, ততক্ষণে নাইমার জীবন সংগ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে স্ক্রিনপ্লে নিজেই বোধহয় হাঁপিয়ে ওঠে। গোটা সিনেমাজুড়েই ছোট ছোট এমন অসংখ্য ট্র্যাজেডিকে মিলিয়ে পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী তার মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়ে গেছেন, তৈরি করেছেন এক্সপেরিমেন্টাল এক সিনেমা, নাম ‘রিকশা গার্ল’।
পাবনার পাকশীর এক গ্রামের মেয়ে নাইমা। তার জীবন, বেড়ে ওঠা কিংবা পৃথিবী বলতে এই তার গ্রাম-সদরটুকুই। ভাড়ায় রিকশা চালানো বাবার মেয়ে নাইমা, পারিবারিক টানাপোড়েনে যে ক্লাস ফাইভের বেশি পড়াশুনা করতে পারেনি। ঘরে ঘরে ঝিয়ের কাজ করে পরিবারকে কিছুটা সাহায্য করতে চায় সে। আর এর বাইরে তার জীবন মানেই পেইন্টিং। সে ভীষণ আঁকতে ভালবাসে, ঘরের টিনের চাল, দেয়াল বা যেখানেই জায়গা পায় সে বুলিয়ে যায় রং-তুলির আঁচড়। এরই মাঝে তার রিকশাচালক বাবা সেলিম অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার ভাড়ার রিকশা নিয়ে চলে যায় রিকশার মালিক মামুন। আর সেই সাথে যেন অনটনের খড়্গ নেমে আসে পরিবারের ওপর। বাবার চিকিৎসার খরচ মেটানোর জন্য জীবিকার তাগিদে একদিন বাড়ি ছাড়ে নাইমা, ঢাকায় পৌঁছে যায় তার গ্রামের বাস কন্ডাক্টর বারেকের সাথে। সেখানে যান্ত্রিকতা আর স্বার্থপরতার ভীড়ে ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে থাকার অনেক গল্প নিয়ে এগোয় সিনেমা ‘রিকশা গার্ল’।
মিতালি পারকিন্স-এর উপন্যাস ‘রিকশা গার্ল’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে এই সিনেমাটি। অমিতাভ রেজা চৌধুরীর পরিচালনায় সিনেমাটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল বেশ আগেই। কোভিডসহ নানা কারণে এর মুক্তি ব্যাহত হয়, পরবর্তীতে অ্যাপল টিভি, অ্যামাজন প্রাইমসহ কয়েকটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পায় সিনেমাটি।
‘রিকশা গার্ল’-এর মাধ্যমে বাংলা সিনেমা নতুন কিছু এক্সপেরিমেন্ট দেখতে পেয়েছে। এই সিনেমার সংলাপগুলো বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষায় তৈরি হয়েছে। প্রায় সব সংলাপই বাংলা আর ইংরেজি একত্রে লেখা হয়েছে৷ অর্থাৎ যেকোনো আলাপেই বাংলা আর ইংরেজি দুটো ভাষাই থাকছে৷ এই ধরনের এক্সপেরিমেন্ট এর আগে বাংলা সিনেমায় দেখা যায়নি। যেমন- একজন রিকশাওয়ালা তার গ্যারেজ মালিকের সাথে যে কথা বলছে তা ইংরেজিতে বলছে, নাইমা যখন পথশিশুদের সাথে কথা বলছে তখনো ইংরেজিতে বলছে। এই ব্যাপারটা কিছুটা অদ্ভুতও বলা যায়। সারাক্ষণই দর্শককে একটা ভ্রুঁ কুঁচকে রাখার মতো অনুভূতি দিয়ে যাবে। এই কাজটা নিশ্চয়ই খুব সহজ ছিল না। অর্থাৎ নির্মাতা কেবল ঢিলেঢালাভাবেই ইংরেজিতে বলাতে চেষ্টা করেননি চরিত্রসমূহ দিয়ে, বরঞ্চ এমনভাবে ইংরেজি ভাষাটা চরিত্রদের মুখে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, মনে হবে এতেই তাদের প্রাঞ্জলতা। এভাবেই তারা কথা বলেন। ভালোভাবে বোঝা গেছে, এই ভাষার দ্বিত্ব বজায় রাখতে আশেপাশের সেট নির্মাণ থেকে শুরু করে জুনিয়র আর্টিস্ট, এমনকি সেট-ফ্রেম সবকিছু নিয়েই আগাগোড়া কাজ করতে হয়েছে ‘রিকশা গার্ল’ টিম এর। তারা সেটা যথাযথভাবেই করতে চেষ্টা করেছেন বলে প্রশংসার দাবিদার। সেইসাথে এই কাজটি দর্শককে চরিত্রদের সাথে মিশতে গিয়ে কিছুটা ভোগান্তিও দেবে, এটিও বলা যায়।
ইন্ট্রো মিউজিক, পুরো সময়জুড়ে বেদনার সুরে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর ফলির সমন্বয়ে ‘রিকশা গার্ল’ অনবদ্য সাউন্ড ডিজাইনিংয়ের কাজ দেখিয়েছে। সাউন্ড ডিজাইনার রিপন নাথের কৃতিত্ব এটা। রিপন নাথ বর্তমান সময়ে চ্যালেঞ্জিং সাউন্ড ডিজাইনিংয়ের কাজের ক্ষেত্রে একটা ভরসার নাম যেন। রাজিব আশরাফের কথায় ‘যাযাবর’ গানটিতে আরাফাত মহসিন নিধি ও আরাফাত কীর্তির মিউজিক কম্পোজিশন অসাধারণ। শারমিন সুলতানা সুমির কথায় ও কন্ঠে ‘তোমার শহর’ গানটিও ভালো। তবে কিছুটা ভুল সময়ে গানটির প্লেব্যাক হয়েছে। এই সিনেমায় অমিতাভ রেজা চৌধুরীর আরেক সিনেমা ‘আয়নাবাজি’র গান, সায়ান চৌধুরী অর্ণবের কণ্ঠে ‘এই শহর আমার’ এর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও ব্যবহার করা হয়েছে, এবং সেটা সবচেয়ে মানানসই একটা সময়ে। নাইমা যখন রিকশা নিয়ে ধীরে ধীরে ঢাকার বুকজুড়ে টিকে থাকার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে, ঢাকার খণ্ড খণ্ড চিত্র যখন পর্দায় ধরা দিচ্ছে, তখনই বেজে ওঠে এই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। এটিও এক্সপেরিমেন্টের দিক থেকে এই সিনেমাকে কিছুটা বিশেষ অবস্থানে রাখবে। দেবজ্যোতি মিশ্রের সঙ্গীত পরিচালনায় এই সিনেমা যেন এক পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে। অবশ্য ফলির কোথাও কোথাও কিছু ভুল শব্দগ্রহণও দেখা গেছে। পাখির কিচিরমিচির ডাকের সাথে পাখির নড়াচড়া মেলেনি, কিংবা রিকশা যখন গ্যারেজে ঢোকানো হচ্ছে সে সময়ে যে শব্দ তৈরি হওয়ার কথা তা নেই। আবার গ্যারেজে রান্নার সময় এত বড় ডেকচিতে রান্না হচ্ছে, বারবার ঢাকনা নাড়ানো হচ্ছে, কিন্তু তার শব্দ বুঝতে পারা যায়নি। এসব ছোটখাটো বিচ্যুতি আমাদের আলাপ থেকে বাদ দেওয়া যায় অবশ্য!
‘রিকশা গার্ল’ সিনেমার সবচেয়ে উপভোগ্য বিষয় হলো সিনেমাটোগ্রাফি। তুহিন তামিজুল ছিলেন মূল সিনেমাটোগ্রাফার। ‘রেহানা মরিয়ম নুর’ এর সিনেমাটোগ্রাফির জন্য তুহিন ইতিমধ্যেই প্রসিদ্ধ। ‘রিকশা গার্ল’-এর সিনেমাটোগ্রাফি এক শব্দে বলতে গেলে বলতে হয় মানানসই। টিনের ওপর পেইন্টিংয়ে নাইমার শুয়ে থাকা বা লরির ফাঁকে পাজল গেইমের মতো করে নাইমা আর বারেকের লুকোচুরি খেলার মতো দৃশ্য; সেইসাথে কখনো হ্যান্ডহেল্ড শট, কখনো কন্টিনিওয়াজ শট এসব দিয়ে তুহিন তামিজুল গোটা সিনেমাকেই করে তুলেছেন নজরকাড়া৷ হ্যাঁ, কখনো কখনো নাইমাকে ফিচার করতে গিয়ে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অন্য চরিত্রকে ফোকাসে রাখা হয়নি, যার কারণে বাকি চরিত্রগুলো কিছুটা ঢাকা পড়ে গেছে। তবুও এর বাইরে ঢাকার যানজট, টাইম-ল্যাপ্স কিংবা স্লো মোশনের ড্রোন শট, কোনাকুনি বিভিন্ন শটে গোটা সিনেমাই একটা উপভোগ্য বস্তুতে রূপ নিয়েছে। একটা শটে দেখা যায়, নাইমা ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে, সেই শটে সিনেমাটোগ্রাফার ক্যামেরাকে নাইমা থেকে আস্তে আস্তে তার ঘরের দেয়ালের পেইন্টিংয়ের দিকে সরিয়ে ফেইড আউট করান। যেন নাইমা চলে যাচ্ছে আর তার পেইন্টিং রয়ে গেছে-সে দৃশ্যের জীবন্ত সাক্ষী। কিংবা যখন নাইমা দৌড়াচ্ছিল তখন সারি সারি রিকশার ফাঁকে নাইমার দৌড়ের দৃশ্য- এসবকিছুই যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সিনেমাটোগ্রাফার৷
‘রিকশা গার্ল’ সম্পাদনার কাজ করেছেন নবনীতা সেন। একেবারে প্রতিটা কাটই সেখানে দারুণ ছিল। এছাড়াও অ্যানিমেশন, আলো আর প্রপস, কস্টিউমে নিপুণতার ছোঁয়া ‘রিকশা গার্ল’কে বেশ উঁচুমানের এক সিনেমা হিসেবেই দর্শকের সামনে পরিবেশন করতে সাহায্য করেছে। আলো আর রঙের ভারসাম্য মেলাতে একটা সেটে নীল রঙের টিনকে নতুনভাবে রং করিয়ে আলো ফেলা, অথবা নাইমাকে রাতের আঁধারে আবছা আবছা আলো ফেলে কনট্রাস্ট তৈরি করা এসবকিছুই ভীষণ সুন্দর ছিল। ডি আই কালারিস্ট, আর্ট ডিরেক্টর আর অ্যানিমেশন ডিরেক্টর তিনজনই বাহবা পাওয়ার যোগ্য।
নাইমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন নভেরা রহমান। তার এই চরিত্র খুব যে সহজ কোনো চরিত্র ছিল না তা বুঝতে হলে আপনাকে অবশ্যই সিনেমাটি আগে দেখতে হবে। পাকশীর সহজ-সরল এক মেয়ের চরিত্র থেকে ঢাকায় গিয়ে চুল কেটে ছেলের লেবাস নেওয়া, ছেলের মতো করে অভিব্যক্তি দেওয়া, কিংবা ইমোশন আর ক্লাইম্যাক্সের উঠতি-পড়তির ভেতর দিয়ে যাওয়ার গোটা কাজটাই নভেরা করেছেন প্রশংসনীয় উপায়ে। তার ক্যারিয়ারের জন্যই এই কাজটা একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে। ‘রিকশা গার্ল’ সিনেমায় সে অর্থে বড় কোনো ভিলেন নেই। এইখানটায় ভিলেন হিসেবে যেন উপস্থাপন করা হয়েছে আমাদের সমাজকে। যেখানে মেয়েরা কেবল মেয়ে বলেই রিকশা চালাতে পারে না। এমন একটা সংলাপও দেখা যায় যে আগে পুরুষ হও, তারপর রিকশা চালাবে। তবে আছে কিছু নেগেটিভ চরিত্র। সেসব চরিত্রের বিবেচনায় সিনেমাতে সবার আগে থাকবেন অভিনেতা নাসির উদ্দিন খান। গ্রামের এক নেতার ছত্রছায়ায় নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছড়িয়ে গ্রামে নিজের জুলুমকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে যা যা দরকার তার সবই ঢেলে দিয়েছেন নাসির উদ্দিন খান তার মামুন চরিত্রে। বাকের চরিত্রে এলেন শুভ্রও তার যতটুকু দেওয়া সম্ভব তা দিয়েছেন। এছাড়াও অশোক বেপারী, সিয়াম আহমেদ, টয়া, মোমেনা চৌধুরী, নরেশ ভুঁইয়া- তারাও ভালো অভিনয় করেছেন।
এই সিনেমার স্ক্রিনপ্লেতে আরেকটি চমৎকার এক্সপেরিমেন্ট ছিল নায়ক সিয়াম আহমেদের উপস্থিতি৷ এছাড়াও তার সিনেমা পোড়ামন ২, দহন প্রভৃতির সাথে নাইমার মিশে যাওয়া, সিনেমাগুলোর পোস্টার- এসবকিছু মিলিয়ে অমিতাভ রেজা চৌধুরী যে প্রশংসা দেখিয়েছেন অন্য নির্মাতার কাজের প্রতি, তা খুব কমই দেখা যায় বাংলা সিনেমার জগতে। অমিতাভ রেজা চৌধুরীর কাজ মানেই তাতে অসংখ্য ফিকশনাল ক্যারেক্টার একত্রে স্ক্রিনে ‘রোল প্লে’ করে যাবেই। এত সহজাত ভঙ্গিতে অমিতাভ রেজা এতগুলো চরিত্রের নিজস্ব গল্প খুব অল্প সংলাপ আর অল্প সময়ে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, যা তাকে সবসময়ই অনন্য একজন পরিচালক হিসেবে সবার সামনে হাজির করায়। ‘রিকশা গার্ল’-এও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। মাত্র দুই ঘণ্টারও অল্প সময়ে অমিতাভ রেজা কতকিছুই যেন হাজির করে ফেলেছেন ‘রিকশা গার্ল’-এ। প্রধান প্রোটাগনিস্ট নাইমার গল্প তো বটেই, সেই সাথে বাকেরের গল্প, ঢাকার দম্পতির গল্প, ঢাকার পথশিশুদের জীবনযাপন, রিকশা গ্যারেজগুলোর গল্প একত্রে এনে দারুণ এক মিশেল তৈরি করেছেন অমিতাভ।
‘রিকশা গার্ল’ সিনেমা শুরুর দিকে যে একটা আঁটসাঁট স্ক্রিনপ্লে দিয়ে শুরু হয়েছিল এবং দৃশ্যগুলোর খুব দ্রুতই রূপান্তর ঘটছিল তা একেবারেই ধীর হয়ে যায় নাইমার ঢাকায় যাওয়ার অংশ শুরু হওয়ার পর থেকেই। অনেকখানি ধীর লয়ের হয়ে যায় সবকিছু। অনেক বেশি খুঁটিনাটিসহ সব দেখাতে গিয়ে কিছুটা আস্তে এগিয়েছে গল্প। অবশ্য পরিচালক সেক্ষেত্রে একে নাইমার নিজেরই হঠাৎ ঢাকায় গিয়ে কিছুটা ভড়কে যাওয়া মানসিক অবস্থার রূপায়ন বলে দাবি করতে পারেন।
এসবকিছু মিলিয়েই ‘রিকশা গার্ল’ সিনেমাটাকে বিশেষ জায়গায় রাখছি। কারণ, এই সিনেমার সমাপ্তি, ক্লাইমেক্স, ট্র্যাজেডি কোনকিছুতেই বড় আকারের কিছু হাজির করেন নি অমিতাভ রেজা। তিনি নাইমার জীবনের ছোট ছোট ঘটনা, ছোট ছোট আনন্দ, ছোট ছোট বেদনাকে নিয়ে সাজিয়ে তুলেছেন গোটা ‘স্টোরিটেলিং’। ‘রিকশা গার্ল’-এ নাইমার বিশেষ দু:খ কী ছিল খুঁজতে গেলে পাওয়া যায় না, আবার নাইমার গোটা জীবনটাই দু:খে ঘেরা। এ তো আমাদের বেশিরভাগেরই জীবন। আমাদের জীবনের ছোট ছোট দু:খ গুলো মিলেমিশে, ছোট ছোট আনন্দগুলো ভাগ করেই আমরা কোনমতে বেঁচে থাকতে শিখে যাই, নাইমাও তেমনই। এই যে ছোট ছোট ব্যাপারগুলোর ভূমিকা, সেটা এই সিনেমা এত দারুণভাবে গল্পাকারে প্রতিষ্ঠা করে গেছে বলেই এই সিনেমাটি বিশেষ কিছু। ‘রিকশা গার্ল’ আরো অনেক ভালো সিনেমা হতে পারত, এমন এক আক্ষেপ দিয়েই বিশেষণের ইতি টানলাম!
‘রিকশা গার্ল’ সিনেমাটি দেখতে পারেন এখান থেকে: www.rickshawgirlmovie.com