গেল বছরের শেষভাগ থেকেই চলচ্চিত্রপাড়ায় মৃদু গুঞ্জন, “দু’হাজার কুড়িতেই বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশি সিনেমা।” একের পর এক ভিন্নধর্মী গল্পনির্ভর সিনেমার ঘোষণা, যেগুলোর সাথে জড়িত হালসময়ের পরীক্ষিত ও আস্থাভাজন শ্রেষ্ঠ নির্মাতারা এবং সম্ভাবনাময় একঝাঁক নতুন-পুরনো অভিনয়শিল্পী। দেশি চলচ্চিত্রের জন্য চরম প্রত্যাশার বার্তা বয়ে আনা বছরটা দুর্ভাগ্যবশত থমকে যায় অপ্রত্যাশিত কোভিড-১৯ এর সংক্রমণে। সুদীর্ঘ আট মাস পর স্তব্ধ জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে এলে, এই হতাশা-ব্যর্থতার মাঝেই নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল শোনালেন আশার বাণী। টিভি নাটকে দর্শককে বরাবরই ভিন্নধারার গল্প-নির্মাণ উপহার দিয়ে আসা অসম্ভব গুণী এই পরিচালক তার প্রথম সিনেমা মুক্তি দিলেন রাজধানী ঢাকার চারখানা সিনেপ্লেক্স ও চট্টগ্রামের একটি সিঙ্গেল স্ক্রিনে। একটি দারুণ সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্রের জন্য বরাদ্দকৃত হলের এই সংখ্যাটা বড়ই বেমানান, খুবই দুঃখজনক।
‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’; গত মার্চ মাসে মুক্তির তাগিদে ফেব্রুয়ারিতেই ইউটিউবে মুক্তি দেয়া হয় মুভির ট্রেইলার এবং একাধিক গান। খুবই প্রতিশ্রুতিশীল ও আশাব্যঞ্জক ছিল। তাছাড়া মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের ‘যে জীবন ফড়িঙের‘ বা ‘দাস কেবিন’ এর মতো টিভি ফিকশনগুলোর মাধ্যমে তার কাজের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা খুব ভালো করেই বুঝবেন ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ নিয়ে নিয়মিত দর্শকদের প্রত্যাশার পারদ কোন পর্যায়ে ছিল। এখন দর্শকদের এই সুউচ্চ প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পেরেছে সিনেমাটি? এ নিয়ে আলাপের সময় এসেছে।
বরাবরের মতোই মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের নিজস্ব সিগনেচার স্টাইলে সমৃদ্ধ এই সিনেমার গল্প। অর্থাৎ এই গল্পকে সুনির্দিষ্ট একখানা প্লটে আবদ্ধ করে বর্ণনা করলে মূল সিনেমা ও আগ্রহী দর্শকের প্রতি একপ্রকার অবিচারই করা হবে। তার গল্প ব্যাপক অর্থবোধক, মাল্টিলেয়ার ও সুগভীর।
মেডিকেল ছাত্রী নীরা তার গবেষণার থিসিসের জন্য খুবই নতুন ও মৌলিক একটি থিওরি বেছে নেয়। মানুষ যেহেতু চিরকালই কামনা করে এসেছে তার প্রিয়জনকে বা তার প্রিয়জনের স্মৃতি-বৈশিষ্টকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখতে, তাই গবেষণালব্ধ সায়েন্টিফিক কোনো বিশেষ ডিএনএ ক্যাপসুলের মাঝে মানুষের ‘জিন’ সংরক্ষণ করার ব্যাপারে তার আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু অ্যাকাডেমিক গতানুগতিকতা বহির্ভূত হওয়ায় তার প্রফেসর বিষয়কে বিরক্তিভরে প্রত্যাখ্যান করেন।
এরই মাঝে একদিন ঢাকার ব্যস্ত সড়কে প্রচণ্ড ভীড়ের মাঝে নীরা খুঁজে পায় এক অদ্ভুত মানুষকে, হাজার লোকের মাঝে যে খুব ভালোভাবেই নিজেকে আলাদা করে রাখতে পেরেছে। মানুষটি অয়ন। অপরিচিত বিপদগ্রস্ত দরিদ্র লোকেদের মুখে একঝলক হাসিই যার জীবনে সুখ এনে দেয়। তাদের অপ্রত্যাশিত খুশিই রঙিন করে তোলে তার অনুভবের জগতকে, স্বার্থক হয় তার বেঁচে থাকা। অয়নের প্রতি আগ্রহী হয় নীরা এবং মজাদার কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে দুজনের হৃদয়ের আদানপ্রদান ঘটে।
কিন্তু একদিন ঘোর অমানিশা নেমে আসে তাদের জীবনে। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়ে অয়ন। অতঃপর অয়নের অস্তিত্ব, তার বেঁচে থাকা এবং নীরার ‘জেনেটিক প্রিজার্ভেশন/রিক্রিয়েশন’ থিওরি কীভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তা নিয়েই গল্পের মূল ধারা এগিয়ে গেছে।
একঘেয়ে গড়পড়তা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রনির্ভর এই ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য খুবই ভিন্ন এবং পরীক্ষামূলক একখানা ধারণা। বাণিজ্যের ঝুঁকি নিয়ে এই দুঃসাহস করার জন্য পরিচালক-প্রযোজক অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। গোটা সিনেমাজুড়েই নতুনত্ব ও পরিচ্ছন্নতার জয়জয়কার। প্রতিটি দৃশ্যই সুনির্মিত, পাওয়া যায় যত্নের ছাপ। খুবই পরিচ্ছন্ন একটা ভাব লেগে আছে, যা ঢালিউডের যেকোনো সিনেমায় শুধু বিরলই নয়, বরং কল্পনাতীত। একুশে পদকপ্রাপ্ত চিন্তাবিদ ও লেখক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মূল্যায়নে যা ফুটে উঠেছে এভাবে,
মূলধারার চলচ্চিত্রকারদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে এই সিনেমায়।
অভিনয়প্রসঙ্গ আসলে এই সিনেমা দশে দশ পাবার উপযুক্ত। এতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ ও শার্লিন ফারজানা। ছোট-বড় বিভিন্ন পার্শ্বচরিত্রে দেখা যায় মানস বন্দোপাধ্যায়, ইলোরা গওহর, খাইরুল বাশার, ফারিহা শামস সেঁওতি, নেভিল ফেরদৌস হাসান, শোয়েব মনিরসহ আরো অনেককে। প্রত্যেকেই আপন আপন চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন, বেশ সাবলীল সবাই। নাটকে অল্প কিছু কাজ করে সিনেমায় নাম লেখানো তরুণ অভিনেতা ইমতিয়াজ বর্ষণ যথেষ্ট যত্নের সাথে নিজের অভিনীত ‘অয়ন’ চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন। কিঞ্চিৎ ছোটখাট বিষয় বাদ দিলে মনে দাগ কাটার মতো পারফর্মেন্স দিয়েছেন বর্ষণ।
আর অবশ্যই গোটা ফিল্মের প্রধান আকর্ষণ শার্লিন ফারজানা। নির্মাতা ও নায়কের মতো তিনিও এই সিনেমা দিয়েই চলচ্চিত্রে অভিষিক্ত হলেন এবং নিজের রাজকীয় আগমনের কথা যেন ঘটা করেই জানান দিলেন। তার চিত্রায়িত ‘নীরা’ চরিত্রের উচ্ছল তারুণ্যে ভরা প্রাণচাঞ্চল্য, অস্থিরতা, রসবোধ, দায়িত্বশীলতা এবং বিষাদ- প্রতিটি অনুভূতিকেই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্দায় প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছেন শার্লিন। সব সু-অভিনয়শিল্পীর মাঝে থেকেও যেন একা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন পুরো সিনেমা। চলচ্চিত্রে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যত এবং সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল।
সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিষয় হচ্ছে এর কারিগরি দিক। প্রথমে যদি ক্যামেরার কাজের কথা বলা হয়, এতটা ভারসাম্যপূর্ণ এবং স্মার্ট সিনেমাটোগ্রাফি খুব কমই পাওয়া যায় বাংলা সিনেমায়। এর অতি উন্নত চিত্রগ্রহণে সদরঘাট ছাড়াও ব্যস্ত ঢাকার পরিচিত সব সড়ক, অলিগলি সুনিপুণভাবে বাস্তব হয়ে উঠে এসেছে।
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সবসময়ই মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের কাজের স্বাক্ষর বহন করে। তার নাটকগুলোতেও অতি উৎকৃষ্ট আবহসঙ্গীতের ব্যবহার হয়ে এসেছে সেই এক দশক আগে থেকেই। এ সিনেমাতেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। সিনেমার গানগুলোর মতো বিজিএমও ছিল উপভোগ্য, অত্যন্ত শ্রুতিমধুর।
তাছাড়া ভিএফএক্স, কালার ডিজাইন এবং সাউন্ড ইফেক্টের চমৎকার সমন্বয়ের মাধ্যমে ছবির কিছু দৃশ্য হয়ে উঠেছে বাংলা সিনেমার জন্য দৃষ্টান্ত। এভাবে কখনো ভৌতিক, আধিভৌতিক, মায়াবাস্তব বা উত্তেজনাময় নাটকীয় আবহ সৃষ্টি করে দর্শককে চমকে দেয়ার ক্ষেত্রে শতভাগ সফল ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ টিম। তবে শব্দগ্রহণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু বেশিই আর্টিফিশিয়াল করা হয়েছে, ফলতঃ ডাবিংয়েও এর দুর্বলতার ছাপ পাওয়া গিয়েছে মাঝে মাঝে।
সার্বিকভাবে গল্প ও উপস্থাপনে মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের এই সিনেমা এক অনন্যতা লাভ করেছে। যেকোনো দর্শককে নাড়া দিয়ে যাবার মতো। উজ্জ্বলের অন্যতম বিশেষত্ব তার সংলাপ। এই সিনেমাতেও ঠিক তা-ই। সিনেমার বিভিন্ন পর্যায়ে বৈচিত্র্যময় সংলাপগুলো দর্শকের হৃদয়ে বোধের তরঙ্গ সৃষ্টি করবে। এতে আছে খুব ভালো হিউমার, আবেগ, যৌক্তিকতা এবং জীবনঘনিষ্ঠতা। তবে উজ্জ্বল তার বিভিন্ন নাটকের মতো এই সিনেমাকে শুধুমাত্র কোনো বিশেষ শ্রেণীর লোকের জন্য সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। তাই খুব বেশি দুর্বোধ্য কাব্য/দর্শনময় বাক্যের পরিবর্তে সার্বজনীন কিছু সংলাপের ব্যবহার করেছেন। এর মধ্য দিয়েও সিনেমা হয়ে উঠেছে বার্তাবহ, ব্যাপক অর্থবোধক। “লাইফ নেভার এন্ডস”- সিনেমার ম্যাজিক্যাল এই ডায়লগের প্রাসঙ্গিক গভীরতা বুদ্ধিমান দর্শকমাত্রই প্রচণ্ডভাবে অনুভব করবেন।
আর সিনেমার গানগুলোও এর প্রাণের অংশ। গল্পের সাথে খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে মিষ্টি, ছোট ও শ্রুতিমধুর গানগুলো উপস্থাপিত হয়েছে। সুমনের কন্ঠে ‘প্রথম’, সৌরিনের কন্ঠে ‘এই শহর’, এবং স্বয়ং নির্মাতা উজ্জ্বলের কথা, সুর ও কন্ঠে ‘মেঘমালা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গানের কথা, সঙ্গীতায়োজন কিংবা চিত্রায়ন সবদিকেই গানগুলো অসাধারণ।
চিত্রনাট্যের বিবেচনায় পৌনে তিন ঘন্টার এই সিনেমায় তিনটে ধারার সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম অংশে আছে নীরাকর্তৃক অয়নকে খুঁজে পাওয়া, অয়নের লাইফস্টাইল ও তাদের মধ্যকার মজাদার সব কাহিনী, যা দর্শক দারুণভাবে উপভোগ করবেন। দ্বিতীয় ভাগে তাদের প্রেম ও প্রেমপরবর্তী ঘটনাবলি অয়নের অসুস্থ হওয়া পর্যন্ত। এ অংশটা খুবই টিপিকাল ও ক্লিশে রোমান্টিক মুভির মতো হয়ে যাওয়ায় দর্শকের মাঝে বিরক্তিবোধের উদয় ঘটাবে খানিকটা।
গল্পের বিবেচনায় এই অংশের দৈর্ঘ্য পরিচালক চাইলেই কিছুটা ছোট করতে পারতেন। এতে মূল বিষয় আরো সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিত দর্শকের কাছে। এমনিতেও গল্পনির্ভর মুভি হওয়ার সুবাদে খুবই বাস্তবানুগভাবে ধীরগতিতে এগিয়ে যাওয়া। এর মাঝে আবার অতি গতানুগতিক ট্রিটমেন্ট চলে আসায় চিত্রনাট্য খুবই মন্থর হয়ে পড়ে। কোনোমতে এই অংশ পার করতে পারলেই চলে। যদিও এর মাঝেও কিছু ইন্টারেস্টিং সাবপ্লট রয়েছে। ‘অন্ধ ছেলের চিড়িয়াখানা দেখা’, ‘সামর্থ্য থাকবার ‘অপরাধে’ ধনী পরিবারের অনুতাপ’ বা ‘সূর্যকে সাক্ষী রেখে নিঃশ্বাসের বিয়ে’ ইত্যাদি খুবই চমৎকার ও হৃদয়স্পর্শী বিষয় ছিল।
শেষভাগটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও চমকপ্রদ অংশ। বাস্তব, অবাস্তব, কল্পনা ও ঘোরের মিশেলে খুবই রহস্যময়তায় মোড়া বিশ-পঁচিশ মিনিট। কিছুক্ষণের জন্য দর্শকের মনে তুমুল উত্তেজনার সৃষ্টি করে তবেই সিনেমার অদ্ভুত সুন্দর ক্লাইম্যাক্স টেনেছেন নির্মাতা। গল্প, কারিগরি দিক আর চমৎকার অভিনয়ে যা হয়ে উঠেছে জমজমাট। পরিসমাপ্তি ঘটেছে একটি সফল নিরীক্ষাধর্মী, অন্যরকম আধুনিক ‘রোমান্টিক’ চলচ্চিত্রের। দর্শকের সামনে চিরন্তন মহাসত্যের মতোই যেন বারবার উচ্চারিত হয়েছে ‘Life never ends’।
এই-ই আমাদের “ঊনপঞ্চাশ বাতাস”।
মাসুদ হাসান উজ্জ্বলসহ তার পুরো টিম কতটা যত্ন নিয়ে পেশাদারিত্বের সাথে এই সিনেমা নির্মাণ করেছেন উপরের লেখা থেকে হয়তো তার খানিকটা আঁচ পাওয়া যায়। সিনেমা দেখলে বরং পুরোটাই বোঝা যাবে। নির্মাতার ভাষায়,
সিনেমা এমন এক অদ্ভুত আবেগের নাম যা একজন সিনেমাওয়ালা ছাড়া পুরোটা কেউ বুঝবেন না! অদ্ভুত আবেগ না থাকলে কেউ কি জীবন থেকে এভাবে তিনটি বছর খরচ করে দেয়? জীবনের পুরোটা দিয়ে এই বাচ্চাকে লালনপালন করেছি। আজ থেকে ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ আপনাদের।